STORYMIRROR

Nandini Pal

Abstract Fantasy Others

3  

Nandini Pal

Abstract Fantasy Others

আচার

আচার

5 mins
0

#আচার


 শ্রীতমা তাকিয়ে দেখছিল পুনমের দিকে। টিফিন বক্সটা খুলে বসেছে। স্কুলের এই রুমটা মিউজিক রুমের ঠিক পাশেই। ছোট্ট, এখানে খুব বেশী জন বসে না এই টিফিন টাইমে। এটা একসময় স্টাফ রুম ছিল। এখন মিউজিক রুমে কনভার্ট হবার পর ছোট্ট একফালি জায়গাটায় একটা টেবিল আর কয়েকটা চেয়ার রাখা আছে। শ্রীতমার পছন্দ এই জায়গাটা, কপি চেক করতে সে অফ পিরিয়ডে এখানেই চলে আসে। এখানেই টিফিন সারে সে। এখন স্টাফ রুমটা বড় হলেও দু তিনজন টিচার জড়ো হলেই কুট কাচালি শুরু হয়ে যায়। মানুষের স্বভাব, আর কথায় আছে "স্বভাব যায় না মলে"। পরচর্চাটা আচারের মতোই। কথাবার্তার মাঝে একটু চাখনা দিয়ে খেতে বেশ ভালোই লাগে। শ্রীতমার আবার ঠিক পছন্দ নয় পরচর্চা আর আচারও। মনে আছে ছোটবেলায় ওর বোন শ্রীরূপা ভাত খাবার সময় তরকারি নিয়ে নাকে কান্না করলে, মা একটা গুড় আম দিয়ে দিত ওর পাতে। আর ও সেটা চাখনা দিয়ে শেষ করে দিত ভাত। রূপা যেদিন দুধ মাখা ভাতে গুড় আম মেখে খেত সেদিন ওকে এমন দৃষ্টিতে দেখত তমা। মা বলত, "তুই খাস না তো কি হয়েছে। ওরকম হেয় দৃষ্টিতে তাকাস না ওর দিকে"। 

শ্রীতমার গুড় আম পছন্দ না হলেও, বাবা শীতকালে গাজর, আর নানা সবজি দিয়ে যে টক ঝাল আচারটা বানাত সেট ওর বেশ ভালো লাগত। ছাদে শুকোতে দিতে গিয়ে মাঝে মাঝেই খেত একটু বার করে। ওর বোন ছিল ওটা থেকে শত হস্ত দূরে। ওর পছন্দ কুল বা আমের, গুড় দিয়ে মিষ্টি আচার। 

বাবা চলে গেল হঠাৎ করে। তারপর বাবার হাতে তৈরী আচারটা রয়ে গেল। যখনই খেত ঐ আচারটা যেন বাবার স্পর্শ টের পেতে। মনে হত ঐ আচারটা যেন শেষ না হয়। 

নিজের টিফিন বক্সটা খুলে খেতে খেতে চোখ চলে যায় পুনমের দিকে। রোজই প্রায় পরোটা আনে। আর এক টুকরো আমের আচার দিয়ে বেশ খেয়ে নেয়। মনে মনে হাসে শ্রীতমা বাঙালি এত পেটুক আচারটাকে চাখনার উপরে উঠতেই দিল না। অথচ ভারতবর্ষে কত মানুষ এই শুধু আচার দিয়ে রুটি পরোটা খেয়ে ফ্যালে। কোনো তরকারি নয়। শুধু আচার আর রুটি বা পরোটা।

 রাজস্থানের মেয়ে হলেও পুনম এই শহরে ওদের বাপ ঠাকুরদা আছে অনেক বছর। পড়াশুনাও এখানে, তাই বাংলাটা ভালোই জানে। দুমাস হল জয়েন করেছে। সোসাল স্টাডি পড়ায়। মেয়েটা একটু চাপা ধরনের খুব বেশী কথা বলে না। ফোনে কিছু একটা দেখতে দেখতে খাচ্ছিল। শ্রীতমা বুঝতে পারে আসলে একটা কিছুর আড়াল নিয়ে খেতে চায়, কারো সঙ্গে সেভাবে কথা বলতে চায় না। শ্রীতমার টিফিন খাওয়া শেষ হলে কপি চেক করায় মন দিল। একটা ফোন আসতে দরজার বাইরে চলে গেল পুনম। টিফিনের সময় শেষ হওয়ার ঘন্টা পড়ে গেছে। ফিফথ পিরিয়ড অফ। ফোন শেষ করে পুনম রুমে যখন এল আড়চোখে দেখল শ্রীতমা। ওর মুখটা থমথমে, চোখের নীচে কান্নার দাগ স্পষ্ট। মেয়েটা কোনও প্রবলেমে আছে। অথচ সোজাসুজি প্রশ্ন করাও যায় না। 

" পুনম তুমি রোজ আচার আনো, আমাকে একবার রেসিপিটা বলবে। ঝাল আচার আমার বেশ ভালো লাগে"। 

এমন হঠাৎ প্রশ্নে মেয়েটা একটু মনে হয় অবাক হল। তবুও ওর ঠোঁটের কোণায় একটা হালকা ম্লান হাসির রেখা ফুটে উঠল। 

"এই আচারটা আসলে বাজার থেকে কেনা। আমার শ্বশুরবাড়ি তো বাঙালি। ওরা এই আচার তো খায়না। আমি আবার আচার ছাড়া রুটি পরোটা খেতে পারি না। মা ভালো আচার বানায় আর দাদীও। কত রকম টীট, সাংরি, লসুয়া, কেরী, আরো কত কি। নানীর বাড়ি গেলে নানীও পাঠাত। তবে আমি ঠিক পারি না"। 

বাপের বাড়ির কথা বলতে বলতে পুনমের চোখে একটা উজ্জ্বল আলো খেলে গেল। 

" মায়ের কাছ থেকে জেনে নিলেই তো পারো"। 

একটু চুপ করে থাকে পুনম

" আসলে আমার প্রেম করে বিয়ে, একে বাঙালি তার উপর ছোট জাত। তাই বাপের বাড়ি থেকে মেনে নেয়নি"। 

শ্রীতমা কথাটা শুনে কি বলবে বুঝতে পারে না। 

পুনমের গলাটা কেমন ধরে আসে

"বাড়ির সাথে সম্পর্ক নেই। তিন বছর হয়ে গেল। "


"তোমার শ্বশুর শাশুড়ি মেনে নিয়েছে তোমাকে? "


"শ্বশুর মশাই ভালো, কিন্তু শাশুড়ির আমাকে ঠিক পছন্দ নয়, একে তো ব্যাগ ভর্তি টাকা গয়না আনি নি। তার উপর ওনার কত আচার-বিচার, সকড়ি, আঁশ, পূজোআচ্চা। পান থেকে চুন খসলেই খোঁটা।"


হঠাৎ পুনম সব মনের কথা বলতে থাকে। অনেকদিন থেকে জমে থাকা মনের দুঃখের কথাগুলো একটা ছোট্ট টোকায় বের হয়ে আসতে থাকে। 

"ওনার মন রাখার জন্য ওনার সব কথা শুনে চলি। ওনার কথামত সব উপোস করি, ব্রত করি। মাছ রান্নাও শিখেছি। কিন্তু মন পাই না ওনার।" 

"কাঁদছিলে কেন? "

পুনম যেন কিছুটা বিব্রত। 

"দাদীর শরীর খুব খারাপ হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছিল। স্ট্রোক হয়েছে। এক দিকটা প্যারালিসিস হয়ে গেছে। ভালো করে কথা বলতে পারছে না। সেজদি পরশু ফোন করেছিল। আজ বলছিল আসতে। বলছিল দাদী নাকি আমার কথা বলছে। তিন বছর পর এই প্রথম মা আমাদেরকে ডেকেছে বাড়িতে, দাদী শেষ শয্যায় তাই। ডাক্তার বলেছে আশা খুব কম। এদিকে শ্বশুর বাড়ির কেউ চায় না আমি ওখানে যাই। এমনকি আমার স্বামী পরিমলও। কালকে বলেছিলাম, একপ্রকার অশান্তি হয়ে গেছে।

 ওর কথায় যারা এতদিন খোঁজ করেনি তাদের সাথে যোগাযোগ করার কি দরকার। আমি বোঝাতে পারি না। দাদী যে আমায় ছোট থেকে মানুষ করেছে"।

 

পুনমের পিঠে হাত রাখে শ্রীতমা। স্বান্ত্বনা দেবার ভাষা নেই, হঠাৎ মনটা কেমন আদ্র হয়ে ওঠে। ওর কাছ থেকে ফোন নিয়ে পুনমের স্বামী পরিমলকে ফোন করে শ্রীতমা। 

"জানি এটা আপনাদের পারিবারিক ব্যাপার তবুও একজন অসুস্থ অশীতিপর বৃদ্ধার শেষ ইচ্ছেটুকু পূর্ন করতে আপনার উচিত কাল পুনমের সাথে ওর বাড়িতে যাওয়া। একটু ভেবে দেখবেন। তবে কাল বন্ধু হিসাবে আমি যাচ্ছি ওর সাথে"। 

পরিমল পরদিন এসেছিল পুনমের সাথে। তবে শ্রীতমাকেও ছাড়েনি পুনম। বলেছিল

" তোমার জন্য ও রাজি হয়েছে। একবারটি চল দিদি আমাদের বাড়িতে"। 

ওদের লিলুয়ার বাড়িতে যখন পৌঁছল বাড়ির সামনে বেশ ভীড়। পুনম কে দেখে ওর দিদি এসে জড়িয়ে ধরে বলল, " দের কর দিয়া ছুটকি দাদী তো হামে ছোড় কর চলি গয়ী"। 

নিথর শরীরটা সাদা কাপড়ে ঢাকা। পুনমের মা বাবা পরিমলকে আপ্যায়ন করে বসাল। সময়ের সাথে ওনাদের মনও নরম হয়েছে। শ্রীতমা বুঝল সম্পর্কের মাঝে জমে থাকা বরফের পাথরটা গলতে শুরু করেছে। শুধু একজন ভালোবাসার মানুষ চলে গেছে চিরতরে। 

একসময় দাদী কে ফুল মালা দিয়ে সাজিয়ে শববাহী সকট চলে যায় শেষ যাত্রায়। সকলের চোখ আদ্র। পুনমের কান্না বাঁধ মানে না। কাল এলে দাদীর সাথে দেখা হয়ে যেত। বারান্দায় এসে দাঁড়ায় পুনম। বিকেলের পড়ন্ত রোদে সারি সারি কাঁচের বয়ামে শুকোচ্ছে দাদীর হাতে তৈরী সাংরী, লসুয়া, নিম্বু আর কেয়ারীর আচার। 

মা এসে দাঁড়িয়েছে পুনমের পেছনে। শববাহী সকটের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওর পিঠে হাত রাখেন, " তেরী দাদী তেরেকো বহুত ইয়াদ করতী থী। পুনমকো আচার খানা বহুত পসন্দ হে। উসকে দিয়ে ইয়ে আচার তুম রাখ দেনা। ওহ জব আয়েগী উসকো দেনা। বোলনা, ইয়ে আচার নহী তেরী দাদী কা প্যার হে"। 

শ্রীতমা শুনতে পায় কথাগুলো। ওর মনে হয় আচার আসলে সময়ের পাকে টক, মিষ্টি,ঝাল আর নুনে জারিত প্রিয়জনের ভালোবাসা। 


কলমে-নন্দিনী


Rate this content
Log in

More bengali story from Nandini Pal

Similar bengali story from Abstract