উদ্বাস্তু মন
উদ্বাস্তু মন
আমি উদ্বাস্তু মন
ছুটে চলি অনর্গল
মানিনা কোনো বাধা-নিষেধ,
মানিনা করোও আদেশ, নির্দেশ;
ছুটে চলি দিগ্-দিগন্তব্যাপী
ঘুচিয়ে দিয়ে সকলের সকল গন্ডির বেড়াজাল।
অনন্তকাল ধরে আমি উদ্ভ্রান্ত মনটা ছুটে চলেছি
পেয়েও না পাওয়ার গ্লানি নিয়ে,
আমার ক্লান্তি নেই, নেই কোনও বিশ্রাম।
করোও অধীনে থাকিনা আমি,
বাগে আনতে পারেনা আমাকে কেউ।
আমি কিন্তু রাখতে পারি সকলকে আমার অধীনে,
জীবনযাত্রাপালায় আমি একাই নায়ক-নায়িকা।
চাই শুধু আমার প্রাণবন্ত একটি মানব-খাঁচা,
যাকে দিয়ে শুরু হবে আমার ভানুমতির খেলা;
কেমন করে নাচাতে হয় মনুষ্যকুলকে
তা আমি কিম্ভূতকিমাকার বিদেহী মন জানি ও বুঝি।
মানুষ তো ইন্দ্রিয়ের চাকার,
ইন্দ্রিয়গুলো হয় একটু ছটপটে;
একটুতেই লোভ-লালসার শিকার হয়ে
হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে কমজোর হয়ে পড়ে।
তখন মানুষগুলোর অবস্থা হয় পাংচার টায়ারের মতো।
কেউ মরে দর্পে উন্মত্ত হয়ে,
কেউ কামনার আগুনে জ্বলে-পুড়ে,
কেউ লালসার শিকার হয়ে,
কেউ বা ক্রোধের দুর্দন্ড প্রতাপে
জলাঞ্জলি দেয় নিজের সুন্দর জীবন
হিংসা-প্রতিহংসার মারামারি খুনোখুনি খেলায়।
আমি কিন্তু এসব দেখেও নির্বিকার থাকি,
হাততালি দিয়ে হাসি আর বলি,
এ সবই তো আমার কারনামা।
আমি যে কাম-ক্রোধ-লোভ-হিংসা-মায়া-মোহ ও
বিদ্বেষের জাল বিছিয়ে রেখেছি,
তাতে জড়িয়ে সবাই কিরখম ছটফট করে,
হাবুডুবু খায় আর বলে সংসারে কোথাও শান্তি নেই।
আমি হাহুতাশ দেখে আনন্দ পাই
মানুষের মাথাটা চিবিয়ে খুলিটা নিয়ে খেলতে ভালোবাসি।
মন যে কখনো তুষ্ট হয়না তা বেটারা বোঝেনা।
আগুনে ঘি দেওয়ার মতো কেবল আমার প্রতিটা ভাবনাকে
প্রতিহত না করে প্রগলভিতো করতে থাকে বারেবারে।
বেটারা পদে পদে হোঁচট খেয়েও শিক্ষা নেয়না;
আমার তাতে কি, তোরা মর কামনা-বাসনা-লালসা,
হিংসা-ক্রোধ ও বিতৃষনার আগুনে জ্বলে পুড়ে।
আমি তো যাযাবর হয়ে ঘুরে বেড়াই
আর মাথার ওপর চড়ে বসি।
এইভাবে যুগযুগ ধরে আমি রাজত্ব করে যাচ্ছি
মানুষদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে, আমার অধীনে রেখে।
আমার প্রভাবকে কোনো অস্ত্রই দমাতে পারেনা,
আমাকে যতই তুষ্ট করবে আমি ততই চাইবো।
একটার পর একটা চাওয়াই তো আমার স্বভাব,
আমার যে চাওয়ার শেষ নেই।
বোকা মানুষগুলো বোঝেনা;
তাই শেষ দিন পর্যন্ত আমার চাই, আরো চাই
করতে করতে পটল তোলে একদিন মূর্খের দল।
আমি আবার প্রাণহীন দেহে থাকতে পারিনা একটুও।
ফুড়ুৎ করে প্রানপাখিটার সাথে উড়ে যাই,
আবার নতুন আস্তানা জোগাড়ের ফন্দি এঁটে।
মানুষের মৃত্যু হলেও আমার মৃত্যু নাই,
কারণ আমি যে চিন্তা সমষ্টি;
সেই চিন্তা সমষ্টি আমি ভর করি প্রাণবায়ুর ওপর।
শরীর ত্যাগ করে প্রাণবায়ু বা প্রাণপাখি ভাবে
এবার আমি মুক্ত; অনন্ত গগনে ভাসমান নিত্য শুদ্ধ
পবিত্র বন্ধনহীন আত্মা হয়ে গেছি।
এক হতে চায় জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে,
সমস্ত পার্থিব বন্ধন কাটিয়ে;
যার কোনও চাওয়া-পাওয়া নেই,
নেই কোনও আকাঙ্খা।
আরে বাবা, তুমি মুক্ত হয়ে
আকাশে উড়তে চাইলেই হবে নাকি!
আমি যে পণ করেছি তোমার সঙ্গ কখনও ছাড়বনা।
আমি জানি মানুষ প্রবৃত্তিকে সাথে করেই বেঁচে থাকে।
যতক্ষণ না পর্যন্ত তুমি প্রবৃত্তি নিবৃত্তি দুজনের মধ্যে
প্রবৃত্তিকে ত্যাগ করে নিবৃত্তিকে গ্রহণ করছো
আমি কি তোমাকে ছেড়ে যাবো বাছাধন;
তাই সঙ্গে সঙ্গে আমি উত্তর দিই, আছে....আছে,
আমার অনেক কিছু চাওয়া-পাওয়ার আছে।
আমি তোমাকে এক্ষুনি পরিত্যাগ করবো না, আমি প্রারব্ধ।
তাই যুগে যুগে আমি তোমাকে নাকে দড়ি দিয়ে
ভোগের পিছনে দৌড়ানো করাবো।
তুমি যেই মুহূর্তে কোনও জঠরে আশ্রয় নেবে
অমনি আমার চিন্তারাশিগুলি নবজাতকের
মাথার ঘিলুতে মিশে যাবে আর কিলবিল করবে।
আমি সময়মতো বিকশিত হয়ে নুতন মানুষটির চোখটিকে
মায়ার পর্দা দিয়ে ঢেকে রেখে
ওর সাথে কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলা শুরু করবো।
তোমার মুক্তির রস আস্বাদন করবার স্বপ্নকে
আমি ভেঙে চুরমার করে দেবো।
কখনো আমি কামনা-বাসনার রূপ ধারণ করবো,
কখনো বিভীষিকা হয়ে, কখনো হিংসা-প্রতিহিংসারূপে,
কখনো বা মায়া-মোহে আচ্ছন্ন করে রাখবো;
আমার নাগপাশ থেকে কেউ সহজে মুক্তি পাবে না।
আমি হেরে যাই শুধু তারই কাছে
যে হয়নাকো অস্থির,
থাকে অচঞ্চল ও স্থির।
মনকে রাখে নিবিড়,
ইচ্ছার করে নাশবন্দি,
দূরে সরিয়ে আমিত্বের অহংকার বাদশাকে
কাছে পেতে চায় পরম প্রেমাস্পদকে।
যাঁকে পেলে হয় চাওয়া-পাওয়ার ইতি,
হয় দুঃখের সমাধি।
তাঁকে সমর্পন করতে হয় আমি মনকে।
