Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Sanghamitra Roychowdhury

Romance

4.0  

Sanghamitra Roychowdhury

Romance

অল্প স্বল্প প্রেমের গল্প

অল্প স্বল্প প্রেমের গল্প

11 mins
3.9K


ঝিলম মাঝে মাঝেই ডুব দেয় বহুদূরে ফেলে আসা শৈশব-কৈশোরে। লিরিল সাবানের ঝিম ধরা লেবু লেবু গন্ধ, প্লাস্টিকের বিরাট বড় এক ফাটা বালতিতে ঝমঝমিয়ে জল পড়ার একটানা শব্দ, আলকাতরার টিন কাটা দরজার পেছনে ইঁট বার করা দেওয়ালে ঘেরা এক চিলতে কলঘরে স্নান করতে করতে মায়ের খালি গলায় আপন মনে গেয়ে যাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত কখনো গুনগুনিয়ে, কখনো বা গলা ছেড়ে। নিত্য নতুন। কখনো পুরোনো না হওয়া নতুন নতুন গান, সুরেলা, কী সুনিবিড় মায়াময়, মন নিঙড়ানো রবীন্দ্রসঙ্গীত। ছেলেবেলা বলতে.... এইই আছে অমলিন ঝিলমের স্মৃতিতে। ঝিলমের কানে, মনে প্রেমের রবীন্দ্রসঙ্গীতের আনাগোনা মায়ের গলা বেয়ে।


ঝিলমের বাবা মায়ের নিজেদের পছন্দের অসবর্ণ বিবাহ। কয়েক বছর কষ্টেসৃষ্টে ঝিলমের মাকে নিয়ে বাবা নিজের পৈতৃক বাড়িতে থাকার আপ্রাণ অসামঞ্জস্য চেষ্টার পর কতকটা বাধ্য হয়েই এজমালি বাড়ি ছেড়ে এসে শহরের উপকণ্ঠে এককাঠা কয়েক ছটাক জমিতে দু'কামরার এই একতলা বাড়িটা করেছে। ঝিলমের বাবা মা দুজনের অক্লান্ত ঐকান্তিক চেষ্টায় ঝিলমদের এই ছোট্ট ছায়াশীতল ভালোবাসার "শান্তি নিকেতন"। মা যে বড্ড রবিকবির ভক্ত। ঝিলম কোথাও কোথাও অন্য কারোর গলায় কখনো সখনো রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনেছে, তবে তা তেমন করে ঝিলম অনুভব করে নি, মানে অনুভব করতে পারে নি, পায় নি ভালো করে তার সুমিষ্ট রসাস্বাদনের স্বাদ, যেমন পায় ও নিজের মায়ের আত্মমগ্ন হয়ে গাওয়া খালি গলার খোলা গানে। ঝিলম ওর ছোট্ট মনের দিকচক্রবালে হারিয়ে যায় মায়ের গলায় সেই গানে, যখন সন্ধ্যার আঁধার ঘনানো শেষবেলায় মা স্কুল থেকে ফেরে, তারপর শ্রান্ত ক্লান্ত অবসন্ন মা কলঘরে স্নান করে ধুয়ে ফেলতে যায় সারা দিনের ক্লান্তি শ্রান্তি অবসাদ, তখন গেয়ে যাওয়া শুচিস্নিগ্ধ রেশ টানা মায়ের ঐ খালি গলার খোলা তরতাজা গানে ঝিলমের অস্তিত্ব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।




ঝিলমের মায়ের কথায়, "রবিঠাকুরের গান তো শুধু লয় তাল তানের ব্যাকরণে বাঁধা নয়, ও গান মনের, ও গান প্রাণের, ও গান আপনার মনের আপন টানের, ভালোবাসায় মরমী সর্বহারার দানের।" মা যখন কলঘরে তার প্রাণ ঢেলে মনের গান গাইতে থাকে, কখনো গুনগুনিয়ে, কখনো উদাত্ত, তখন রিমঝিম রিমঝিম ঝরতে থাকা জলের আওয়াজ যেন প্রকান্ড সুরবাহার জলতরঙ্গের বন্দিশ হয়ে মায়ের গানের কথাগুলোকে সুরের সঙ্গতে একাকার করে দিয়ে ঝিলমের শরীর ভেদ করে সমস্ত অন্তঃকরণে ঢুকে যায়। ঝিলম বাইরে থেকে কান পাতে, মন পাতে, প্রাণও পাতে। হৃদয় পেতে শোনে। মায়ের গানে অবগাহন করে, "আমি কান পেতে রই.....।"




ঝিলম কিন্তু মায়ের গানের সব শব্দের অর্থ বোঝে না, অনেক অচেনা শব্দ মনেও রাখতে পারে না, কিন্তু মায়ের ঐ আবেগী উজার করা সুর ওর তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে ছড়িয়ে যায়, মিশে যায় শোণিত স্রোতে, বাড়িয়ে দেয় হৃদস্পন্দনের ছন্দ। সেদিন ঝিলমের মা গাইছিলো, "আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়....।" কেঁপে উঠলো ঝিলম, এ আবার কেমনতরো কথা গানে? সর্বনাশ মানে তো খারাপ, নষ্ট! তবে খারাপের জন্য, নষ্টের জন্য কি কেউ বসে থাকে? চকিতে দ্বাদশী ঝিলম ভাবলো কথাটা ভুল শোনে নি তো? আবার কান পাতলো ঝিলম। সুরের প্লাবনে মায়ের গলা, "আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়.....!" খানিক বিমূঢ়, খানিক হতোদ্যম ঝিলম, ঠিক যেন বুঝতে পারলো না, যদিও কবেই বা আর সবটুকুনি বোঝে? তবু যে কী অমোঘ আকর্ষণ মায়ের খালি গলায় গাওয়া কত কঠিন কঠিন ওসব রবীন্দ্রসঙ্গীতে!



সদ্যকিশোরী ঝিলম তাদের একচিলতে বাড়ির পেছনের আধচিলতে ঘাসউঠোনে রথের মেলায় কেনা দু'টো বেলফুল আর একটা রক্তজবার চারা বসিয়েছিলো। ভরা বর্ষার জল পেয়ে সবুজ গাছগুলো ফনফনিয়ে বেড়েছে, ঠিক যেমন ঝিলম বেড়েছে ঋতুমতী হয়ে। এখন ঝিলমের আর কেন যেন বেশী হুড়োহুড়ি করে পাড়ায় বন্ধুদের সাথে খেলাধুলো মোটেই ভালো লাগে না।



আজকাল বিকেলটায় মা ফেরার আগে পর্যন্ত, স্কুল থেকে ফিরে খেয়েদেয়ে বসে বসে গল্পের বই পড়ে ঝিলম, যা পায় স্কুলের লাইব্রেরী থেকে। নিজে নিয়েই খেয়ে নেয় ঝিলম। ছোট্টবেলা থেকেই এই অভ্যেস। মা ঝিলমকে স্বনির্ভর হতে শিখিয়েছে ছোট থেকেই। আগে বিকেল হলেই খেলতে যাবার জন্য হাঁকুপাঁকু করতো ঝিলম। মা আসার আগে পর্যন্ত খেলাই খেলা চলতো। আর মা ফিরলেই মায়ের গলায় ঐ গানের টানে একছুটে বাড়ি। তবে এখন বিকেলটায় কখনো সখনো ঝিলম ওদের ঐ আধ চিলতে বাগানে পায়চারী করে আর গুনগুন করে। মায়ের গলার সব গানের সুরগুলো ওর মনে গেঁথে আর কথাগুলো মাথায় বিঁধে আছে যে, একেবারে ভেতর পর্যন্ত, শেষ প্রান্তে গভীরে গিয়ে। এখন ঝিলমের ষষ্ঠেন্দ্রিয়ও ঝিলমকে খুব সন্তর্পণে জানিয়েছে যে, ও বড় হচ্ছে!



''যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইবো কতো আর, আর পারিনে রাত জাগতে হে নাথ ভাবতে অনিবার..." গুনগুনিয়ে উঠলো ঝিলম। সবটা মনে নেই, ঐ কলি দুটোই গাইছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। ও ভাবলো তাইই তো, ঝিলমের শৈশবটা তো ঝপ করে কেমন হারিয়েই গেলো! কিন্তু বারবার হোঁচট খাচ্ছে "রাত জাগার" অংশটুকুতে এসে। ঠিক যেন পরিষ্কার হচ্ছে না, বুঝি বুঝি ভেবেও পুরোটা যেন বুঝছে না। আবার এসব কথার মানে মায়ের কাছে জানতে চাইতেও কোথা থেকে দুস্তর লজ্জা এসে ঠেসে ধরে। অর্থ না বোঝার বিষম কষ্ট পায় ঝিলম, ছটফট করে নিরানন্দে। তাই লজ্জার সাথে অনেক লড়াই ধস্তাধস্তি করে শেষ পর্যন্ত মাকে জিজ্ঞেস করেই ফেলে অনেক শব্দার্থ। মা হেঁয়ালি করে বলে, "ভাবলেই দেখবে, নিজেই বুঝে যাবে একদিন!" ঝিলম ভাবতেই থাকে, কোনো থৈ পায় না, কুলকিনারা পায় না, হদিশ পায় না, তল পায় না, সূত্র পায় না, নিশানা পায় না। তবুও নিজের মতো করে ভেবেই চলে। আর ঠোঁটের কোণে হেসে মা নিজের কাজের ব্যস্ততায় ডোবে।




আসলে ঝিলমের স্কুলে বাংলায় তেমন জোর চাপ নেই, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে দ্বিতীয় ভাষা বাংলা যেমন হয় আর কী! তাই কঠিন কথায় এসে বারবারই হোঁচট খেয়ে হতে হয় নাজেহাল। কিন্তু তবুও রবীন্দ্রনাথের গান ওর মায়ের গলায়, এক অবিচ্ছেদ্য টান তৈরী করে দিলো ঝিলমের ভেতরে মাতৃভাষা বাংলাটার ওপর। মায়ের গান আর রবীন্দ্রনাথ....এই দুইয়ে মিলে ঝিলম জানে এখন অনেক অনেক কঠিন কঠিন বাংলা শব্দ। আসলে বলতে গেলে ঝিলম কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ওপরে, রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপরে, রবীন্দ্র সাহিত্যের ওপরে ধীরে ধীরে আকৃষ্ট হচ্ছিলো সেই স্কুলবেলা থেকেই। বয়সের সাথে সাথে সে টান বেড়েছে বৈ কমে নি। তাই ঝিলম স্কুল শেষে বাংলায় অনার্স পড়ার ইচ্ছা ও সাহস প্রকাশ করায় সবাই অবাক হলেও ঝিলমের মা কিন্তু অবাক হয় নি একেবারেই, এমনকি অবাক হয় নি বাবাও।




যেদিন ঝিলম প্রথম কলেজে গেলো, বাড়ি ফিরে মায়ের গলায় সেদিন ঝিলম শুনেছিলো, "কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসারই ঘায়ে, নিবিড় বেদনাতে পুলক লাগে গায়ে, তোমার অভিসারে যাবো অগম পাড়ে....।" মাঝে মাঝেই মায়ের গলায় এই গানটা শুনতো। কখন যেন গানটা ঝিলমের একান্ত আপন হয়ে উঠেছিলো। তাই এর আলাদা কোন মানে খোঁজার তাগিদ কখনো ঝিলমের অবচেতন চেতনাতেও আসেই নি। সেদিন ঝিলমের কলেজ লাইব্রেরী থেকে বেরোতেই খানিক দেরী, আর বিকেল হতে না হতেই হঠাৎই অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। আর উথালপাথাল ঝোড়ো হাওয়ায় কলেজফেরত ঝিলম যখন একা দাঁড়িয়ে বাসস্ট্যান্ডে, দামাল সেই হাওয়ার সাথে সাথে রত্তি রত্তি ফোঁটায় বৃষ্টি ঝিলমের খোলাচুল আর নরম গোলাপী গালে আচমকায় আলতো চুমু খেলো, ঠিক তখনই হঠাৎ যেন দেখলো ঝিলম.... না না, ঝিলমের নজর পড়লো ঠিক তখনই উল্টো ফুটপাতে একজোড়া উদ্বিগ্ন অথচ উদাসী চোখ সমেত মালিকটির উপর।




ততক্ষণে বৃষ্টি চড়বড়িয়ে বড় বড় ফোঁটায়। চোখ জোড়ার মালিক তরুণটির এলোমেলো ঘাঁটা চুল যেন বৃষ্টি ভেজা কচি কচি ঘাস। ডগায় জলের মুক্তোবিন্দু নিয়ে ঘাসগুলো ঠান্ডা ভিজে বাতাসে উথালপাথাল মাথা দোলাতে থাকলো। আর ঝিলমের মন হঠাৎই গাইলো, "নিবিড় বেদনাতে পুলক লাগে গায়ে...." এক ছড়িয়ে পড়া আবেশে। তার মনে হোলো, আচ্ছা, প্রচন্ড ঝোড়ো বাতাসে যদি ক্যাম্পাসের গাছগুলো এখনি ভেঙে চুরে ছিঁড়ে খুঁড়ে যায়, অবিরাম দুলছে তারা, তবু যেন তারা মহা আনন্দে আছে, ভারী সুখে আছে, অসীম পুলকে আছে। সেই প্রথম, সেই প্রথম ঝিলম অনুভব করলো তার চোখ ঝাপসা ঝাপসা, লজ্জাও পেলো। বলা তো যায় না, চোখ দুটো যদি বেইমানি করে, ধরে যদি রাখতে না চায় আর নয়নবারিরাশি ভার! বুঝলো ঝিলম সেই প্রথম, প্রথম বুঝলো কান্নার সাথে ভালোবাসার একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। গভীর দুঃখের সাথে যেমন আনন্দের, অন্ধকারের সাথে যেমন আলোর, সাদার সাথে যেমন কালোর, জন্মের সাথে যেমন মৃত্যুর! সে সম্পর্ক যেন জন্ম জন্মান্তরের। ঝিলমের মন আবার গাইছে, "কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসারই ঘায়ে....।"





গাছেদের পুলকিত সুখে, চেনা বলয়ের প্রাকৃতিক উল্লাসে আর ঝিলমের নিজেকে নিজের আবিষ্কারের নেশায় যে ও ঠিক কতক্ষণ বুঁদ হয়ে বাসস্ট্যান্ডে শেডের পাশে দাঁড়িয়ে ভিজেছিলো তা জানে না ও। বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচতে কখন যে উল্টো ফুটপাতের চোখের মালিক রাস্তা পেরিয়ে এপারের শেডের নীচে আশ্রয় নিয়েছে তাও আর ঝিলমের গোচরেই আসে নি, ওতো বেমালুম টেরই পায় নি। টের পেতেই জানতে চাইলো ঝিলম, হ্যাঁ, সেই মুখচোরা ঝিলম, আজ প্রগলভা, "আপনি ফাইনাল ইয়ারে না? নবীন বরণে আপনিই তো গীতিনাট্যে ভাষ্যপাঠ ও গান দুয়েই ছিলেন, না?" ঝিলম অবাক, নিজের কাছে নিজেই অচেনা, এতো কথা ঝিলম বললো কী করে এমন অপরিচিত কারুর সাথে! উল্টোদিকের মানুষটি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে কিছু বলার আগেই জলকাদা ছিটিয়ে ঝিলমের রুটের বাস হাজির। ভেজা জিন্স-টিশার্টে কিংকর্তব্যবিমূঢ় চোখের মালিককে দিব্যি হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে কাঁধের ব্যাগ আর চুপচুপে ভেজা দোপাট্টা সামলে ঝিলম বাসে উঠে পড়লো। বরাত জোরে একটা সিটও পেলো ঝিলম, বাস ছুটছে জোরে, তার থেকেও জোরে ছুটছে ঝিলমের মন।





বাসে বসে ঝিলমের মন গাইলো, "আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরাণসখা বন্ধু হে আমার.....।" ঝিলম ভাবছে, "অভিসার" ঠিক কেমন হয়? এর আক্ষরিক মানে আর ব্যবহারিক মানে কী কখনো এক করে ঝিলম মেলাতে পারবে? চিন্তার জালটা ছিঁড়ে গেলো। বাস এসে দাঁড়িয়েছে ঝিলমের নামার বাসস্ট্যান্ডে এসে।




বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে ঝিলমের ছোটবেলার এক দিন মনে পড়লো, "আচ্ছা মা, অভিসার মানে কি গো?" অপলক কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে খুব ধীরে ধীরে মা বললো, "অভিসার মানে যাওয়া, নির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্যে যাওয়া, কিন্তু ততটা যাওয়া নয়, যতটা আন্তরিক যেতে চাওয়া লক্ষ্যস্থলের উদ্দেশ্যে।" ব্যাস্, এটুকু বলেই মা ঘরগেরস্থালির কাজ গোছাতে গোছাতে বেপাত্তা একদম! বোধগম্য হয় নি, তাও পরের প্রশ্নটা তার আর করার সুযোগও হয় নি। ঝিলম আজ নিজের মতো করে অন্তরাত্মার অভিধান থেকে আবিষ্কার করেছে "অভিসার" মানে।





ঝিলমের অস্তিত্ব গুনগুনালো, "........... তোমার অভিসারে যাবো অগম পাড়ে.............!" সুগম হোলো মসৃণ যাওয়ার, দুর্গম হোলো কঠিন যাওয়ার, তাহলে অগম তো একেবারেই না যাওয়ার! এই অগম শব্দটার মানে বুঝতেই অভিসারে যেতে চাওয়ার আর যেতে পারার মানেটা ঝিলমের কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেলো। ঝিলমের অনুভব ঝিলমকে বোঝাচ্ছে আজ। কেনই বা পরাণে বাজে বাঁশি, আর কেনই বা নয়নে বহে ধারা, কি করেই বা দুঃখের মাধুরী ভালো লাগাতে পারে দুঃখকে, সর্বস্ব কেড়ে নিয়েও কেন কেউ কিছুতেই পিছু ছাড়ে না, আবার যার সব কেড়ে নেওয়া হয়েছে তার মনও পারে না কেনই বা কিছুতেই ছেড়ে যেতে, সরে যেতে বা দূরে যেতে।





বেল বাজিয়েছে ঝিলম, সন্ধ্যে পার অনেকক্ষণ, মা ফিরে এসেছে বাড়িতে, দরজার ছিটকিনি খুলে মা দাঁড়িয়ে, কাকভেজা আত্মমগ্ন ঝিলমের মাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢোকাতেই হয়তো মা কিছু বুঝলো, কিন্তু বললো না কিছু।




পরেরদিন অনার্সের দুটো ক্লাস অফ, আর বাড়ি থেকে বেরোতে ইচ্ছেও করে নি, একার সাথে একা হতে চেয়েছিলো ঝিলম সেদিন। সেদিন মাও রইলো বাড়িতে, তখনও মা শুয়েই ছিলো, দুপুর গড়াতে না গড়াতেই আগের দিনের মতোই আকাশ জোড়া মেঘ আর উদ্দাম ঝড়ের সাথে উদ্ধত বজ্র বিদ্যুৎ, তার সাথে উত্তাল উন্মাদ বৃষ্টি। আর সেদিনও ঝিলমের অবস্থা ঝোড়ো হাওয়ায় ভেঙে পড়তে চাওয়া গাছগুলোর মতোই। "সকলি নিবে কেড়ে দিবে না তবু ছেড়ে, মন সরে না যেতে ফেলিলে একী দায়ে...." আধ চিলতে বাগানে ভিজতে ভিজতে ঝিলমের অন্তঃস্থলে উন্মুক্ত হোলো এই কথাগুলির আসল মানে, বুঝলো একান্ত আপনার করে এই কথাটুকুকে। ঝরোঝরো মুখর অবিরাম বাদল ধারায় ভিজতে ভিজতে ঝিলম গাইতে লাগলো উদাত্ত খোলা গলায়, "কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসারই ঘায়ে, নিবিড় বেদনাতে পুলক লাগে গায়ে, তোমার অভিসারে যাবো অগম পাড়ে, চলিতে পথে পথে বাজুক ব্যথা পায়ে, কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসারই ঘায়ে।"




জানালায় চোখ পড়তেই ঝিলম অবাক, স্থাণু হয়ে মা তন্ময় দৃষ্টি মেলে ঝিলমের গান শুনছে। চোখাচোখি হতেই বললো, "বাহ্, বেশ হয়েছে! উঠে এসো এবার।চুপচুপে ভিজেছো দুদিন, জ্বর বাধাবে তো!" পরদিন থেকে ঝিলমের সত্যিই খুব জ্বর, একদিন, দুদিন, তিনদিন কলেজে যেতে পারলো না ঝিলম। মাও আছে তাই ছুটি নিয়ে, বাড়িতে ঝিলমের জন্য, অনেক দিন পর। শনিবার দেওয়াল ঘড়ির কাঁটাটা বিকেল চারটের ঘরটা ছুঁইছুঁই যখন, ঠিক তখনই ঘটলো ঘটনাটা, না, বরং বলা ভালো অঘটনটা।





ঝিলমের এখনো নিজের আলাদা মোবাইল ফোন জোটে নি, এমনকি ঝিলম মোবাইল ফোনের কোনো প্রয়োজনীয়তাও এতদিন তেমন ভাবে অনুভবই করে নি। বাড়ির ল্যান্ড ফোনটাতেই ওর দিব্য পাবলিক রিলেশন বজায় থেকে যায়, দু-চারজন বন্ধু বান্ধবের কাছে তাই ল্যান্ড ফোনের নাম্বারটাই দেওয়া আছে, যদি তাদের কখনো কিছু দরকার পড়ে যোগাযোগ করার জন্য।




সেদিন একটু ভালো আছে ঝিলম, বিছানায় পিঠে বালিশ দিয়ে বসে গল্পের বইয়ে ডুব দিয়েছে।

"রাজর্ষি".... রবীন্দ্রনাথের, বহুবার পড়া, তাও ভালো লাগে সমান, সেই প্রথম দিনের মতোই। মা রান্নাঘরে বোধহয়। ধাতব ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং শব্দে ফোনটা বেজে উঠলো। ঝিলম দেখলো আঁচলে হাত মুছে মা ফোনটা ধরে অবাক বিস্ময়ে শুধু হুঁ হাঁ করে ইশারায় ঝিলমকে ডেকে বললো, "তোমার কলেজের বন্ধু, বীতশোক", রিসিভারটা ঝিলমের হাতে চালান করে ব্যস্ততা দেখিয়ে মা গৃহকর্মে নিরুদ্দেশী হোলো।





বীতশোক.... কলেজের ফাইনাল ইয়ারের বীতশোক, কলেজে নবীনবরণের অনুষ্ঠানের মধ্যমণি বীতশোক, সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল নক্ষত্র ছাত্র বীতশোক, প্রফেসরদের প্রিয়পাত্র বীতশোক, দরদী ছাত্রনেতা বীতশোক, কলেজের সব বন্ধুদের মুশকিল আসান বীতশোক। প্রায় সব বিভাগের বহু সংখ্যক মেয়ের "হার্টথ্রব" হয়েও সেই নির্লিপ্ত উদাসীন বীতশোক। সেদিনের হঠাৎ বৃষ্টিতে ভেজা বীতশোক, সে কিনা ঝিলমের খোঁজে একেবারে বাড়িতে ফোন করেছে? হতভম্ব ঝিলম ফোন ধরলো, ওর সর্বাঙ্গের রক্ত যেন এসে মুখে জমা হয়েছে, রক্তস্রোতে উদ্বেল ধমণীরা! বীতশোক যা বলেছে তার বেশীর ভাগটাই ঝিলমের কানে ঢুকেছে কিন্তু মাথা পর্যন্ত পৌঁছায় নি, হৃদয়ঙ্গম যেটুকু করেছে ঝিলম..... সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফেরার পর থেকে পুরো সপ্তাহটাই ঝিলম কলেজে আসে নি, তাই শরীর খারাপ কিনা জানার জন্যই বীতশোক ঝিলমের ক্লাসের বন্ধুদের কাছ থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে ফোন করেছে। ঝিলম কেমন আছে শুধু সেই খবর-টুকু জানবার জন্যই। ঝিলমের মন যে ঝিলমের সব অনুভূতিতে সহনশীলতার প্রতিমূর্তি। সেদিন ঝিলমের মন গেয়েছিলো, "বঁধূ কোন আলো লাগলো চোখে....!"





বীতশোকের জলদগম্ভীর ভরাট স্বরের কথা শেষ। কিন্তু রেশটুকু এখনো ঝিলমের কানে। ঝিলম শুধু বলতে পেরেছে সোমবার থেকে যাবে কলেজে। ছেড়ে দিয়েছে বীতশোক ফোন। ঝিলমের ইচ্ছে হোলো একবার ছুট্টে গিয়ে দেখে, ওদের আধ চিলতে বাগান টুকরোয় ঝিলমের অস্তিত্বের ভাগীদার সেই যৌবনবতী বেলফুলের গাছগুলোয় কোনো নতুন কুঁড়ি ধরেছে কিনা। ঝিলমের মন গাইছে, "আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়....।" মা কিচ্ছুটি জিজ্ঞেস করে নি ঝিলমকে। তবে বুঝেছে হয়তো নিজের মতো করে কিছু। ঝিলম যেন আশ্রয় নিলো ভালোলাগা আর উত্তেজনার পরতে পরতে মোড়া কোকুনের ভেতরে। ধীরস্থির শান্ত স্নিগ্ধ শুচিস্মিত অপেক্ষায়, কোকুনের আবরণ কেটে রঙীন দুটি পাখনা মেলার আয়োজনে। কী এক পরম প্রাপ্তি সুখে নিমজ্জিত ঝিলমের মনটা ডুব সাঁতারে খুঁজছে আঁতিপাতি করে হৃদসাগরের অতলে থাকা সেই গানঝাঁপিটার আগাপাশতলা। ঝিলমের অন্তরাত্মা গাইছে, "আমি তোমার প্রেমে হবো সবার কলঙ্ক ভাগী....!"




ঝিলম চুপচাপ শুয়েছিলো জানালা দিয়ে ধূসর কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে। থালার মতো গোল চাঁদটা কী সেদিন খুব বেশী উজ্জ্বল? খুব বেশী বড়? খুব বেশী কাছে? রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে মায়ের খালি খোলা গলায় অমৃত লোকের সে অনাদি অনন্ত সুরমূর্ছনা আর ঝিলম ডুবে যাচ্ছে অন্তহীন সেই গানে, "জাগরণে যায় বিভাবরী, আঁখি হতে ঘুম নিলো হরি, কে নিলো হরি.......।"




মায়ের গানে গানেই যে ঝিলমের মনে প্রেমের বীজ বপন তা ওর মনও মানে, আর সে গানে গানেই যে প্রেমের উদ্ভাস তাও ওর মনই জানে।




******




এরপর বেশ কয়েক বছর পার। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রীট ক্যাম্পাসের বাংলা বিভাগের একদম বয়সে নবীন বিভাগীয় প্রধান এবং

ঐ বিভাগেরই অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর দু'জনের যৌথ প্রকাশনায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক নবতম সংযোজন.... "প্রেমের কবিরা তাঁদের কবিতায় কী ভাবে!" বিদ্যাপতি-চন্ডীদাস থেকে রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ-নীললোহিত সুনীল ছুঁয়ে অনবদ্য এক অন্য ধারার অন্য মাত্রিকের অনন্য আঙ্গিকের অমূল্য স্বাদের উপস্থাপনা, "অল্প স্বল্প প্রেমের গল্প"। ছাত্র ছাত্রী মহলে বিপুল জনপ্রিয় দুই প্রফেসরকে ঘিরে আকূল উন্মাদনায় একঝাঁক তরুণ তরুণী। আর প্রিয় ছাত্র ছাত্রীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত দুই প্রফেসর গাড়িতে উঠে ছাত্র ছাত্রীদের থেকে বিদায় নিলো হাত নেড়ে। নিজেদের ফেলে আসা ছাত্র জীবনের সেই সোনাঝরা সুখস্মৃতিতে যেন নবপল্লবিত, প্রেমাঙ্কুরোদ্গমের আহ্লাদিত সৌরভে দুজনের মনেই আবার গানঝাঁপি উপুড়, "তোমায় নতুন করে পাবো বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণে.....।" মৃদু হাসিতে দু'জনে দু'জনের দিকে অপলক চেয়ে তারুণ্যে ভরপুর প্রফেসর দম্পতি.....

ডঃ বীতশোক দাশগুপ্ত ও ডঃ ঝিলম বসু দাশগুপ্ত।।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance