গর্ভধারিণী
গর্ভধারিণী
ঠাকুরঘরটা আজকাল গায়ত্রীর অবসেশনের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে... অনুপম বেশ বিরক্ত এই নিয়ে। বাড়ির বড়বৌ... কত দায়িত্ব কর্তব্য সংসারে। তা না সেসব রইলো পড়ে গায়ত্রী সকাল বিকাল ঘন্টা দুয়েক বরাদ্দ করে ফেলেছে ঠাকুরঘরের জন্য। অনুপম সকালের জলখাবারের জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে আছে ছাদের সিঁড়ির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে। নাম কা ওয়াস্তে খবরের কাগজটা চোখের সামনে মেলে ধরা। কান খাড়া হয়ে আছে ঠাকুরঘর থেকে ভেসে আসা রামপ্রসাদী শ্যামাসঙ্গীতে। অনুপম মোহিত হয়ে গেলো... আহা! হৃদয় নিঙড়ে ঢেলে গাইছে গায়ত্রী...
"মন রে কৃষিকাজ জানো না...
এমন মানবজমিন রইলো পতিত,
আবাদ করলে ফলতো সোনা... মন রে কৃষিকাজ..."
অনুপমের চোখ বুজে আসে আবেগে। "পাপাজেউ, ও পাপাজেউ, তুমি বসে বসে ঘুমোচ্ছো? হে হে হে... জেম্মাকে বলে দিয়ে আসছি, দাঁড়াও... হে হে হে..." কলবল করে ওঠে বুবাই। অনুপম দু'হাত বাড়িয়ে বুবাইকে জাপটে ধরে, "ওরে দুষ্টু, খুব পাকা হয়েছো! খালি জেম্মার কাছে সবকিছু নিয়ে নালিশ... না?" বুবাই অনুপমের ভাইপো... ছোট ভাইয়ের ছেলে। সাত বছর বয়স... হাবেভাবে সতেরো... আর পাকামিতে পুরো সত্তর। সারাদিন বাড়ি মাথায় করে রাখে। আর গায়ত্রীর চোখের মণি একেবারে।
******
বুবাই এখন নয় বছরের। অনুপমের মায়ের মানে বুবাইয়ের ঠাম্মির খুব ইচ্ছে নয় বছরেই নাতির পৈতে দেন। সেই মতোই সব আয়োজন চলছে। এই বৈশাখেই বুবাইয়ের পৈতে। বাড়িতে জমজমাট ব্যবস্থা চলছে। অনুপমের নাওয়া খাওয়ার সময় নেই। বাকি তিন ভাই এখনো চাকরিতে। তাদের সময় কোথায়? বুবাইয়ের বাবা নিরুপম তো পৈতের দিন ধার্য হতেই খাবার টেবিলে সেদিনই সাফ জানিয়ে দিয়েছে, "বড়দা, তুমি থাকতে এসবের দায় দায়িত্ব নিয়ে আমি কিছু ভাবিই না। কী কী খরচপত্তর লাগবে তাই শুধু বলে দিও। আর বাদবাকি তুমি যেমন ভালো বোঝো তেমনই সব করবে।" মেজো ও সেজো ভাইও তাতেই মত দিয়েছে। ভাইয়েদের স্ত্রীরাও সহমত। বাড়িতে এই একটিই ছেলে... ছোট ভাই নিরুপমের ছেলে বুবাই। তাই বুবাইয়ের ঠাম্মির ইচ্ছে খুব ধূমধাম করে একমাত্র নাতিটির পৈতে হোক। অনুপম মায়ের সাথে পরামর্শ আলোচনা করেই সব আয়োজন সম্পন্ন করছে। গায়ত্রী যোগ্য সহধর্মিনী বটে... অনুপমের সব কাজে সমর্থন তার। কেবল ইদানিং যেন গায়ত্রীর এই ঠাকুর ঠাকুর বাতিকটা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এতো কাজ! আর গায়ত্রী লেট করে ফেললো বাড়ি থেকে বেরোতে। বুবাইকে নিয়েই বেরিয়েছে দু'জনে।
পাপাজেউ আর জেম্মা বুবাইকে নিয়ে খেলনার দোকান থেকে বেরিয়ে আইসক্রিমের দোকানে গিয়ে বুবাইয়ের প্রিয় আইসক্রিম খেলো। জেম্মা আবার টুকি, মিমি, বনি... তিনজনের জন্যও আইসক্রিম প্যাক করিয়ে নিলো। ওদের স্কুল থেকে ফেরার সময় হয়েছে এবং সঙ্গে অনেক জিনিসপত্র আর বুবাইয়ের কী পছন্দের একটা খেলনার বিরাট এক বাক্স। এতোকিছু নিয়ে ফেরা, কাজেই কোনোরকম কোনো ঝুঁকি না নিয়ে পাপাজেউ ট্যাক্সি ধরলো।
ট্যাক্সিতে বুবাই একেবারে গম্ভীর, হয়তো পৈতের দিন এগিয়ে আসছে বলে। জেম্মার সাথে কিন্তু বুবাই সারাদিনই কুটুরকুটুর করে অনেক কথা বলে। তবে বাড়ীর বাকী সকলের সাথে বুবাই আজকাল খুব কম গোনাগুন্তি কথাবার্তাই বলে... বড়ো হচ্ছে বলে হয়তো একটু চুপচাপই থাকে।
বুবাইয়ের আবার আজকাল বেশ স্বাধীনচেতা স্বভাব হয়েছে। বেশ স্পষ্ট করে স্পষ্ট কথা বলতে শিখেছে। তবে বুবাইয়ের যত আবদার পাপাজেউয়ের কাছেই। আর হবে নাইবা কেন? বুবাইয়ের বাবা নিরুপম নামী খবরের কাগজের এডিটর, কাজের কোনো বাঁধাধরা সময় নেই, সদাব্যস্ত। বুবাইয়ের মা চৈতালী আবার নৃত্যশিল্পী... রিহার্সাল শো স্টেজ ওয়ার্কশপের ভিড়ে স্বামী সন্তান সংসারের জন্য কিঞ্চিৎ সময় বার করতেও হিমসিম খায় বেচারা। সব ব্যাপারেই ওরা বুবাইয়ের পাপাজেউ আর জেম্মার উপরেই নির্ভর করে থাকে চোখ বুজে। অনুপম আর গায়ত্রীও মশগুল থাকে বুবাই, টুকি, মিমি, বনি... সবাইকে নিয়ে। তবে বুবাই ছোট বলে ওর আদরের ভাগটাও বেশ অনেকখানিই বেশি পাপাজেউ আর জেম্মার কাছে।
বুবাইয়ের বড়ো হয়ে ওঠাতে পাপাজেউ আর জেম্মাই তাই প্রধান দুই কারিগর। বুবাইয়ের স্কুল থেকে পার্ক,
ট্যুইশন থেকে ক্যারাটে ক্লাস বা ক্রিকেট কোচিং, খাওয়া থেকে ঘুমোনো সবেতেই পাপাজেউ আর জেম্মা। এমনকি কখনো বুবাই হয়তো গুরুতর অসুস্থ, এদিকে ওর বাবা নিরুপমের হয়তো এমন কোনো অ্যাসাইনমেন্ট এসে পড়লো যে ছুটি নেওয়া পুরো অসম্ভব... আবার ওদিকে বুবাইয়ের মা চৈতালীর হয়তো কলকাতার বাইরে শো রয়েছে, শো ক্যান্সেল তো সম্ভব নয়... এইরকম প্রতিটি সঙ্কটের মূহুর্তে পাপাজেউ আর জেম্মার ভরসার দু'জোড়া হাত সযত্নে বুবাইকে শুক্তির ভেতর মুক্তোর মতোই আগলে রেখেছে।
এই ক'দিন বুবাইয়ের পৈতে উপলক্ষ্যে মা বাবা ছুটি নিয়ে বাড়ীতেই আছে। বাড়ীভর্তি লোকজন আত্মীয় স্বজন। ঠাম্মি বুবাইয়ের মা চৈতালীকে পইপই করে সব নিয়মকানুন বোঝাচ্ছেন। কিন্তু কী আতান্তর! সেই আইবুড়োভাতের সময় বুবাই কিছুতেই জেম্মার হাতে ছাড়া খাবে না। পৈতের দিনে ভোররাতে দধিমঙ্গলের সময়েও প্রথম দলাটা বুবাই জেম্মার হাতে ছাড়া কিছুতেই খাবে না। স্নানের আগে গায়ে প্রথম হলুদ জেম্মা ছাড়া আর কেউ ছোঁয়াবে না। রীতিমতো জেদাজেদি করে বুবাই জেম্মার কাছেই সব করলো।
বুবাইয়ের বৃদ্ধি নান্দীমুখেও তার শুধু পাপাজেউকেই চাই। মাথা ন্যাড়া করার সময় চোখ বুজে পাপাজেউকে আঁকড়ে ধরে রইলো। তারপর ন্যাড়া মাথায় কান ফুঁটোতে গিয়ে ব্যাথায় কাতর বুবাই ঠোঁট গাল ফুলিয়ে পাপাজেউকে জড়িয়ে ধরে আবদার, "পাপাজেউ, তুমি এসব না করালে আমি কিন্তু এসব পৈতে-টেতে কিছু পরবোই না।" বুবাইয়ের বাবাও ছেলের মন রাখতে বুবাইকে বাধা দিতে পারেনি। দাদাকেই অনুরোধ করেছে বৃদ্ধি নান্দীমুখে বসতে।
বুবাইয়ের পৈতে সম্পন্ন হয়েছে নির্বিঘ্নে। এবারে ওর ব্রহ্মচারী আচারের নিয়ম-কানুন পালন চলছে। ভিক্ষাদান ও ভিক্ষাগ্রহণ পর্ব। হঠাৎ বুবাই খেয়াল করলো সবাই আছে সেখানে, শুধুমাত্র পাপাজেউ আর জেম্মা সেখানে নেই। দু'চোখে বাঁধভাঙা জলের ধারা নিয়ে মুণ্ডিত-মস্তক বুবাই গেরুয়া বসন পরা ব্রহ্মচারী বেশে গেরুয়া ঝোলা কাঁধে পাপাজেউ আর জেম্মাকে খুঁজছে সারা বাড়ীময়, "পাপাজেউ... জেম্মা... জেম্মা... পাপাজেউ!"
ঠাম্মি আর বাড়িভর্তি আত্মীয়-স্বজন সবাই হাঁ হাঁ করে উঠলো, কিন্তু বুবাই তাতে কোনো তোয়াক্কাই করলো না। ঠাম্মির হাজার নিষেধ, মায়ের গম্ভীর মুখ আর কোঁচকানো ভ্রূ, এমনকি বাবার চোয়াল শক্ত করা কঠিন মুখ উপেক্ষা করেই বুবাই গেরুয়া ভিক্ষাঝুলি দুহাতে ধরে নিয়ে জেম্মার সামনে গিয়ে ছাদের ঠাকুরঘরের দরজায় দাঁড়ালো। বুবাই ঠিক জানতো পাপাজেউ আর জেম্মা এখানে ঠাকুরঘরেই থাকবে। বুবাইয়ের চোখের কোল বেয়ে জল পড়ছে, "ভবতি ভিক্ষাং দেহি!" জেম্মা আর পাপাজেউয়ের চোখও ভাসছে জলে... দুজনে মিলে প্রথম ব্রহ্মচারী বুবাইয়ের ভিক্ষার ঝুলিতে উপুড় করে দিলো একপাত্র ফল, টাকা, সোনার আংটি আর নিঃসন্তান দম্পতির উজাড় করা সবখানি স্নেহ মায়া মমতা ভালোবাসা।
নিঃসন্তান পাপাজেউ আর জেম্মাই তো বুবাইয়ের যথার্থ বাবা মা... নন্দবাবা আর যশোদামা! নাইবা হলো জন্মদাতা আর গর্ভধারিণী। "গর্ভে কাউকে ধারণ না করলেই বুঝি কোনো শুভ কাজে সে অপাঙক্তেয় হয়?" বুবাইয়ের এই প্রশ্নের উত্তর ঠাম্মির কাছে ছিলো না। প্রশ্নের উত্তরটা সবাইকে খুঁজতে দিয়ে... নির্বাক নিজের বাবা মায়ের সামনে দিয়ে গিয়ে পাপাজেউর হাত ধরে বুবাই দণ্ডীঘরে ঢুকলো তিনদিনের জন্য।