ব্যথা
ব্যথা
"শা..... মেরে মুখ ভেঙ্গে দেবো যদি ফের মুখে মুখে তক্ক করেছিস তো", একটা লাথি এসে পড়ে মামণির ঘাড়ে ।বাড়া ভাতের থালার উপর মুখ গুঁজে পরে ও । হাত থেকে ছিটকে যায় হাতাটা বারান্দার নিচের উঠোনে। নেপাল তবু বলতে থাকে,
"শা.. ছোটলোকের মেয়ে আমারই খাবে, আমারই পড়বে আর আমাকেই চোখ রাঙাবে! বেশ করেছি মদ খেয়েছি তোর বাপের পয়সায় খেয়েছি? একশো বার খাব, হাজারবার খাব। কোন বাপের ব্যাটা আছে আমাকে ঠেকায়? "
সজল সাইকেল নিয়ে বাড়ীতে ঢুকল। গলির মোড় থেকেই গুণধর বাপের চিৎকার শুনে বুঝেছে আবার গলা পর্যন্ত গিলে হম্বিতম্বি জুড়েছে । সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে এক গল্প !প্রতি রাতে এক ঘটনা! বাবা নেপাল মন্ডল মা মামনি মন্ডল এর উপর চড়াও হবে! মামনি কিছু বললেও মার, না বললেও মার। যেন কোন অদৃশ্য প্রতিপক্ষকে জব্দ করে নেপাল বউ পিটিয়ে!
সারাদিন ভ্যান টানা, কত লোকের ঝাঁঝি, ছোট বড় কথা শুনতে হয়। দু পাত্তর না খেয়ে গায়ের ব্যথা মরে না, আর বউ না পিটালে মনের। ওই শা.. ইতো আছে যে নেপাল কে মান্যি করে, ভয় পায় ,নেপালের হম্বিতম্বি সহ্য করে । শা..অন্যদের কাছে তো নেপাল মন্ডল, "জো হুজুর"। আগে ছেলেটা কেও দিতো, তবে এখন ভয় করে। গোঁফের রেখা বেশ ঘন, হাতের গুলিও খালি গায়ে থাকলে চোখে পড়ে। তাই ওকে পিটিয়ে হাতের সুখ করতে ইচ্ছে হলেও ফালতু রিস্ক নেয় না ।
কিন্তু মামনি, এই গত কুড়ি বছরে নেপালের মনের ব্যথা মারার ওষুধ তো ওই। প্রথমে মাল খেয়ে চেঁচাও, চোখ মুছবে, তারপর যেদিন ইচ্ছে হবে কিল, চড়, লাথি !একটুবেশি তেতে গেলে দাও চুলের মুঠি ধরে টান।
"আহ্! কি আরাম! শা... রাতে যত না সুখ দেয়, এই মারের সময় আরো বেশি তৃপ্তি দেয়! এই হল গে বউ! আমার মেয়েছেলে আমার উপর কথা বলবে? ওটি হচ্ছে না! " মনে মনে বেশ আত্মশ্লাঘা বোধ করে নেপাল।
কিন্তু অন্য দিনের মতো আজ সজল চুপ করে ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল না। সোজা নেপালের সামনে গিয়ে দাঁড়াল বুক চিতিয়ে । তখন নেপাল ডান পাটা সবে তুলেছে আর একখানা লাথি কষাবে মা...টার কোমরে। পা টা নিশপিশ করছে ।
সজল এসে হঠাৎ দেয় এক ধাক্কা । সামলাতে না পেরে টালমাটাল নেপালের মাথা ঠুকে যায় রান্নাঘরের দেওয়ালে। "কি! এত বড় সাহস! শুয়োরের বাচ্চা, বাপের গায়ে হাত তুলিস! এত বড় বুকের পাটা!" দৌড়ে গিয়ে ঘরের কোণ থেকে হুড়কোটা নিয়ে ছুটে আসে নেপালে।
সজল মাকে তুলে বসাতে যায় । আচমকা খিলের বারিটা এসে পড়ে সজলের কোমর বরাবর । হঠাৎ আঘাতে সজল, "বাবা গো", বলে কঁকিয়ে ওঠে। যন্ত্রণায় ওর মুখটা নীল হয়ে যায়।
ছেলের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া মুখখানা দেখে মামনি আর ঠিক থাকতে পারে না । হাতের কাছেই ছিল সবজি কাটার বটিটা । উনুনের পাড়েই দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখা থাকে ওটা। সঙ্গে সঙ্গে মামনি হাতে তুলে বসিয়ে দেয় খিল ধরা হাতটার ওপর । ফিনকি দিয়ে রক্ত ছিটকে এসে পড়ে মামণির চোখেমুখে । সজল যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে মায়ের মুখের দিকে তাকায়। হয়তো ওর কোমরটা ভেঙে গেছে, যন্ত্রণা হচ্ছে খুব, কিন্তু মায়ের মূর্তি দেখে স্তম্ভিত!
এই কি ওর মা? যে রোজ মার খেয়েও চুপ করে থেকেছে! গালে কপালে কালশিটে নিয়ে চুপচাপ ঘরের কাজ করে গেছে, কোনদিন মুখ থেকে একটা শব্দ বেরোয়নি।
যখনই সজল মাকে বলেছে ,"কেন তুমি রোজ রোজ পড়ে পড়ে মার খাও? কিছু বলতে পারো না? " মুখ নিচু করে আঁচলের খুঁটে চোখ মুছে মা বলেছে,
"কোথায় যাব বাবা? তুই বড় হ, আমার সব কষ্ট ঘুচে যাবে ",আজ তার সেই মায়ের কি রূপ দেখছে? ও কি ঠিক দেখছে?"
নেপাল হাতটা চেপে ধরে, গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। দাওয়ার দড়ি থেকে গামছাটা টেনে হাতে বাঁধতে বাঁধতে বেরিয়ে যায়। যেতে যেতে চেঁচাতে থাকে,
"দাঁড়া, আসছি! তোদের মা ব্যাটার তেজ ঘুচাচ্ছি !"কিন্তু গলার জোর আর আগের মতো নয়। মামনি বুঝতে পারে,ভয় পেয়েছে জানোয়ারটা ।
ও ধীরে ধীরে সজলকে ধরে তুলে কোমরে জল দিতে থাকে, যদি ব্যথাটা একটু মরে।