Sheli Bhattacherjee

Drama

3  

Sheli Bhattacherjee

Drama

উপসর্গ

উপসর্গ

3 mins
1.9K


"তোমার এই সমাজ সেবার কাজ তো আমার জীবনটা একেবারে বিষময় করে তুলল।" গ্রামের রাঙামাটির পথ ধরে ভ্যানে করে যাওয়ার সময় কানে ফোন ধরেছিল সুমি। বরের ফোন। সেখানেই অসীমের উঁচু স্বরের গলা থেকে ঝড়ে পড়ছে সব বিরক্তির প্রকাশ। সুমি পাল্টা উত্তর না দিয়ে নীরবে শুনে যাচ্ছে। ভ্যানে ওর সাথে আরও তিনজন স্বাস্থ্যকর্মী আছেন। ওর স্বামী বলেই যাচ্ছে "সংসারটাকে যদি দেখেশুনে নাই রাখতে পারো তো বিয়েটা দিল কেন তোমার বাবা?"


এবার ফোনটা কেটে সুইচ অফ করে দিল সুমি। অসীমের এই কথায় কথায় 'বাবা' তোলাটাকে ও সহ্য করতে পারে না। গরীব ঘরের মেয়ে হয়ে মাথা গুঁজে শ্বশুরঘরে এতোদিন হাঁড়ি ঠেলছিল। তারপর শুরু হয়েছিল পণের জন্য চাপাচাপি। এমনটা হওয়ার কোনো কারণও ছিল না। দিব্যি ভালো অবস্থা অসীমদের। আসলে প্রকৃত অভাবের অভাবেও কখনো কখনো মানুষের স্বভাব বিগরায়। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। অসীমের চাহিদা পূরণ না হওয়ায় পরিস্থিতি ক্রমশ সুমির গায়ে হাত ওঠা পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর একদিন, সুমি সেসব কথা পাড়ার পঞ্চায়েত অফিসে কাজ করে এক বয়স্কা দিদিকে গিয়ে জানায়। সেই দিদিই ওকে সেদিন বলেছিল 'মানুষ যখন মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পশু হতে থাকে। তখন তার গোড়ার উপসর্গ দেখেই তাকে শুধরাতে হয়। নইলে সে অসুখ বেড়ে যায়। তোরা সব সয়ে সয়ে তাদের সে অসুখ বাড়িয়ে তুলিস৷ বোকার মতো বিশ্বাস করিস যে, জীবনটা একদিন শুধরে যাবে। ওরে শরীরের অসুখ শুধরালেও, মনের রিপুজাত অসুখ মারাত্মক হয়।' 


সুমি চুপ করে দিদির সব কথা শুনেছিল। সেদিন ও সেই দিদির কথায় বুঝেছিল, ওর একটা কাজ পাওয়াটা খুব দরকার। তবেই ঘরের এই অসুস্থ হাওয়া থেকে বেরিয়ে স্বস্তি পাবে ও। তাছাড়া কিছু টাকাপয়সাও আসবে হাতে। দুবেলা অন্নের জন্য এতো ঘৃণ্য পরিস্থিতির সম্মুখীন আর হতে হবে না। লোকমুখে শুনেছিল, এই দিদি নাকি ঘরের বৌদের জন্য বিভিন্ন কাজের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। অত:পর ওই দিদির হাতে পায়ে পড়ে এই কাজটা পেয়েছে সুমি। এ কাজে, রোজ দিনের টাকা দিনের শেষেই পেয়ে যায়।

 

সুমির এই কাজটার কথা শোনামাত্র প্রথমে খুশি হয়েছিল অসীম। ভেবেছিল বৌয়ের টাকায় বসে আয়েস করবে। কিন্তু সুমি হাবেভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিল, সেগুড়ে বালি। আর তাতেই ক্ষেপে গিয়েছিল অসীমের মাও। ছেলেকে বলত, 'আমায় এই বয়সে সব কাজ করন লাগে। আর মহারানী যায় দ্যাশ উদ্ধারে! তুই কেমন মরদ? বৌরে আগলে রাইখতে পারস না?'

আর ফলস্বরূপ অসীমের এই কথাগুলো। 


সুমির এখন এসব গা সওয়া হয়ে গেছে। ও ঠিক করেই নিয়েছে, আর কমাস পর নিজেই এদের থেকে আলাদা হয়ে যাবে। এই গ্রামের কাজে প্রথম দিকে আসার সময় সুমি এক দাদার কাছে শুনেছিল, এখানকার অগভীর নলকূপের জলে বিষ আছে। কি এক আর্সেনিক না কি মিশে আছে জলের মধ্যে। সেই জল পান করলে বা তা দিয়ে রান্না করলেই সে বিষ ছড়িয়ে পড়ছে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার দেহে। তাই ওদের সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্প করে সুমিরা বোঝাচ্ছে, লাল রঙ করা মুখের নলকূপের জলে আর্সেনিক আছে। তা ফুটিয়ে পান করা যাবে না। তাতে আর্সেনিক যুক্ত জলের মধ্যে বিষের ঘনত্ব আরও বেড়ে যাবে। বরং পুকুর বা বিলের জল বা বৃষ্টির সঞ্চিত জলকে ২০ মিনিট ধরে ফুটিয়ে ঠান্ডা করে রেখে, তারপর ছেঁকে পান করতে হবে। এসবের সাথে গ্রামে গ্রামে সুমিরা বিলি করছিল ফিটকিরি। গ্রামের বিভিন্ন বয়সী আক্রান্তরা তাদের কালো ছোপ ছোপ খসখসে চামড়ার হাতগুলো অসহায়ভাবে পেতে দাঁড়াত সুমিদের সামনে। নিজেদের জীবনকে সুস্থ সুন্দর করার তাগিদে কুড়িয়ে নিত সেই ফিটকিরির প্যাকেটগুলোকে। সুমির ভাবতে অবাক লাগে, জল .. যার অপর নাম জীবন। সেই কিনা কতজনের জীবন কেড়ে নেওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। 


তবে সুমি উপলব্ধি করেছে, এখানে এসে যে এই রোগের ভয়ে যখন এক পরিবারের একাধিক মানুষ আক্রান্ত আর বাকিরাও ভীত, সন্ত্রস্ত, তখন তাদের মধ্যে কি এক অদ্ভুত একতা সম্পর্কের গভীরে লেপ্টে রয়েছে। অসুস্থরা কোনোভাবে সুস্থদের গায়ে এই মারণ ব্যাধির আঁচ পড়তে দিতে চাইছে না। সুমি জেনেছে, এই মারণরোগের উপসর্গ নাকি শুরুতেই নির্মূল করা প্রয়োজন। নইলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই, কোনো কথা না ভেবে নিজেকে একাজে ডুবিয়ে দেয় সুমি। অনেকে আবার এসব রোগীদের দেখে ঘেন্না পায়। কিন্তু সুমির সে বোধ হয় না।


বরং এ কাজে ডুবে থেকে সুমি শান্তি পায়। ওর মন বলে, অসীমের মনে ঠিক সময়ে রিপুর বিষক্রিয়ার উপসর্গ ও দূর কর‍তে পারেনি ঠিকই, কিন্তু এসব অসহায় মানুষগুলোর শরীরে প্রবেশ করা বিষের উপসর্গগুলোকে ও গুরুত্ব দিয়ে দূর করবেই। আরও সেবায় নিমজ্জিত করবে নিজেকে। আর যাইহোক, এদের রোগগ্রস্ত যন্ত্রণাকর হাতগুলো অন্তত অসীমের সুস্থ শরীরের লালসালিপ্ত হাতের মতো কদর্য নয়। 


(সমাপ্ত)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama