তানপুরা
তানপুরা
অনেক দিনপর গ্রামের বাড়ি এল রমেশ | সেই শেষবার এসেছিলো কাকুর বিয়েতে , অনেক ছোট ছিল তখন , তাই কিছুই মনে নেই | এবারের আসাটা আনন্দের নয় | দাদুর শ্রাদ্ধানুষ্ঠানএ এসেছে সে | গ্রামের বাড়ির প্রায় কাউকেই চিনতে পারছে না সে , তাই খানিকটা নিঃসঙ্গতার মধ্যেই সময় কাটছে তার | রমেশের দাদু কমলেশ মুখার্জী ছিলেন ওই গ্রামেরই প্রাথমিক বিদ্যালয় এর শিক্ষক | এই রে গ্রামের নামটাই তো বলা হয়নি !! গ্রামের নাম বিক্রমপুর , যদিও কোনোকালে কারো কোনো বিক্রমের কোনো গল্পো শোনা যায়নি, কয়েকটা সাধারণ পরিবার নিয়ে গ্রাম | হঠাৎ রমেশের মনে হলো গ্রামটা একটু ঘুরে আসবে সে | কিছু তো করার নেই তার , ফোন টাও কদিন ধরে বড্ডো জ্বালাচ্ছে , শুধুই থেকে থেকে বন্ধ হয়ে যায় | আজ অনেক কিছু জীবনে প্রথমবার প্রতক্ষ করলো রমেশ | রমেশ এর আগে কোনোদিন শোনেনি ,গ্রামের বুড়িরা কিভাবে ছড়া কেটে কেটে কাঁদতে পারে , দেখলো শ্রাদ্ধানুষ্ঠান এর অদ্ভুতসব নিয়ম| আরেক টা জিনিস দেখলো , যেটা এর আগে কোনোদিন দেখেনি ..তার বাবার চোখের কোনায় জমা হয়েছে কয়েক ফোটা জল | এইসব ভাবতে ভাবতেই ঘুরতে বেরিয়ে পড়লো সে | অনেকটা হাঁটার পর দেখা হলো এক বৃদ্ধ এর সাথে | কতবছর যে বয়স দেখে বলা মুশকিল | রমেশ কে দেখেই জিজ্ঞেস করলো তুমি কি কমলেশ এর শ্রাদ্ধে এসেছো বাবা ? রমেশ জানিয়ে দিলো সে কমলেশ মুখার্জী এর নাতি | হেসে উঠলো বুড়ো , বললো কমলেশ আমার থেকে পাঁচ বছরের ছোট | বুড়ো বসেছিল গাছের তলায় একটা বেদি তে , রমেশ কে ডেকে পাশে বসালো |
রমেশের ইচ্ছে না থাকলেও না করতে পারলো না , বুড়ো কথা বলে চললো | ..বুঝলে বাবা তোমার দাদু ছিলেন আমার তাস খেলার সঙ্গী | রমেশ এর হঠাৎ মনে হলো দাদুর সাথে তার সখ্যতা কোনোদিন হয়ে ওঠেনি আসলে সুযোগ হয়ে ওঠেনি | ছোট বেলা থেকেই সে বাইরে থেকে পড়াশোনা করেছে|তার বাবা চাকরিসূত্রে কোলকাতা তেই বাড়ি করেছিলেন , তাই স্কুল এর ছুটি তে কলকাতায় আসতো রমেশ .গ্রামের বাড়ি আর আসা হয়ে উঠতো না | এখন সে আমেরিকা তে থাকে | একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি তে ইঞ্জিনিয়ার সে | তাই বুড়োর গল্প মন দিয়ে শুনে চললো সে | বুড়ো বলে চললো ..আমার এখনো মনে আছে কমলেশ অংকে একশো এর মধ্যে কুড়ি পেয়েছিলো বলে Marksheet টা লুকিয়ে রেখেছিলো ধান বস্তার ভেতরে | কত খেলে বেড়িয়েছি একসাথে .এই জায়গাটাতেই বসে কত বিকেল একটানা গল্প করে গেছি তোমার দাদুর সাথে | তোমাদের শহরে তো প্রযুক্তি অনেক এগিয়ে তবে আমিও এখানে বসে বসে দেখছি আসে পাশের বাড়ি গুলোতে বিদ্যুৎ এসেছে , ছাদএ গছিয়ে উঠেছে এন্টেনা , সেই এন্টেনা আবার কদিন পর ছাতার আকার ধারণ করেছে ..কমলেশ কিন্তু বাকি পাঁচ জনের থেকে আলাদা ছিল সবই করতো সিস্টেম এর বিরুদ্ধে .. কাউকে তোয়াক্কা করতো না | ব্রাম্হন হয়ে বিয়ে করলো পাশের গ্রামের হরিসাধন মিত্র এর মেয়ে প্রমীলাকে | তোমার ঠাকুমা কে তুমি দেখোনি , তোমার বাবা যে বছর মাধ্যমিক দেয় , সে বছরই মারা গেল প্রমীলা ..আমার মনে আছে ..যেদিন প্রথম প্রমীলাকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো কমলেশ ..সে কি অশান্তি !!
কিন্তু প্রমীলা ছিল খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে ..সাথে নিয়ে এসেছিলো একটা তানপুরা ..রবীন্দ্রনাথ এর গান গাইতো ..খুব সহজেই সবার মন জয় করে নিয়েছিল| কমলেশ তোমার বাবার ওপর কোনোদিনই কোনোকিছু জোর করে চাপিয়ে দেয়নি ..নিজে যেমন স্বাধীনচেতা ছিল , তোমার বাবাকেও অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছিলো ..আমি কোনোদিনই সেরকম কাজ কর্ম কিছু করিনি , এমনকি বিয়েও করিনি ..এই তাস খেলে , গল্প করে এতগুলো দিন কাটিয়ে দিলাম ..এখন জানতো খুব একা লাগে .. কেউ নেই আর আমার বয়সের প্রায় সবাই বিদায় নিয়েছে , কমলেশ টাও চলে গেল | ভাবতেও অবাক লাগে একদিন কত আনন্দে ছিলাম সবাই মিলে এইতো কদিন আগে ..কিন্তু হায় কিছুই রইলো না | বুড়োর চোখ ছলছল করে উঠলো ..উঠে পড়লো বুড়ো ..রমেশ ও ফেরার পথ ধরলো . পরের দিন বিকেলের ট্রেন এ কলকাতা ফিরবে সে আর তার দুদিন পর আবার পাড়ি দেবে নিউয়র্ক..রাতে ভালো ঘুম হলোনা রমেশ এর ..জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো সে ..ভাবতে থাকলো আজ থেকে হয়তো ৬৫ বছর আগে এরকমই এক বর্ষার রাত্রে কত ভালোবাসতে ভোরে ছিল এই ঘর ..ঘরের প্রতিটা কোন হয়তো সাক্ষী আছে কমলেশ আর প্রমিলা এর কত মিষ্টি গল্পের ..এই বাড়িতেই তো সংসার বেঁধেছিলো প্রমীলা আর কমলেশ ..এই উঠোনেই তো কতবার তুলসী তলায় প্রদীপ দিয়েছে প্রমীলা ..এই বারান্দাতেই হয়তো কত ছেলে মেয়ে কে পড়িয়েছে কমলেশ ..এসব কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো রমেশ ..সকালে উঠে দেওয়ালের তাকের দিকে চোখ পড়লো রমেশ এর , সেখানে রাখা আছে একটা তানপুরা ..হয়তো এরকমই এক সকালে ভৈরবী তে গলা সাধতো তার ঠাকুমা ..আর যে চেয়ার টাতে রমেশ বসে আছে হয়তো সেখানে বসেই মুগ্ধ হয়ে স্ত্রী এর গান শুনতো তার দাদু কমলেশ মুখার্জী .রাত্রি বেলায় কলকাতা ফিরলো রমেশ .. যার কাছে জীবন মানে ছিল ল্যাপটপ , সেল ফোন আর নিতান্ত রসহীন কিছু কাজ , তার চোখের সামনে একটা অতি সাধারণ সুন্দর জীবনের ছবি ফুটে উঠলো ..তার মনে হতে লাগলো গাছতলার সেই প্রাচীন ভদ্র লোকের কথা ..সেকি সত্যি কোনো লোক ছিল? নাকি সেকাল কথা বলে গেল একালের সাথে.গ্রাম্য সভ্যতা প্রতিযোগিতাতে হারিয়ে দিলো মেকি শহুরে সভ্যতাকে ..শুধুমাত্র গ্রাম্য বলে যে জীবনযাত্রাকে হেয় করে এসেছিলো রমেশ , সেই জীবনযাত্রাকেই এখন শ্রেষ্ঠ মনে হতে লাগলো তার | ল্যাপটপ খুলে বসলো রমেশ ..মেলবক্স ভরে উঠেছে |প্রচুর meeting request এসে জমা হয়েছে ..আর ক্রমশ বড়ো হতে চলেছে তার TO DO List..