ভোম্বল ও রবীন্দ্রনাথ
ভোম্বল ও রবীন্দ্রনাথ


"ভোম্বল.. !! এদিকে আয়! “ মুখ ভার করে ক্রিকেট ব্যাট হাতে এগিয়ে এলো ভোম্বল।"তুই আজও খেলতে যাচ্ছিস হতভাগা! মনে নেই আজ রবিবার, গানের স্কুল এ যেতে হবে তো ! “ "আজ ছেড়ে দাও মা , আজ দয়া করে ছেড়ে দাও। বিল্টুদের পাড়ার সাথে আজ ক্রিকেট ম্যাচ আছে। জিততেই হবে! আগেরবার হেরে ছিলাম। " কেঁদে ফেললো ভোম্বল।কিন্তু বরফ তাতে গলল না। বাড়িতেই ছোটোখাটো একটা বক্সিং ম্যাচ হয়ে গেল বলা চলে। হার বেচারা ভোম্বলরেই হলো।সেটাই হয়ে আসছে প্রতি সপ্তাহে। যাই হোক , অবশেষ একটা চকলেটের প্যাকেট হাতে পেয়ে খানিকটা আনন্দ আর খানকিটা বিরক্তি নিয়ে বৈশাখ মাসের এক বিকেলে মায়ের সাথে গানের স্কুলে পৌঁছলো ক্লাস সেভেন এর ভোম্বল।
এই যন্ত্রণা অনেকটা সয়ে এসেছে ভোম্বলের। প্রথমে প্রচন্ড বিরক্তি লাগতো। এখন সেসব লাগে না। প্রতি সপ্তাহের ওই দুটি ঘন্টা কোনোরকমে কাটিয়ে দেয় সে। টাকমাথা গানের শিক্ষক সেই কবে থেকে একই গান গেয়ে যাচ্ছে। "এসো হে বৈশাখ " প্রচন্ড বিরক্তিকর! বৈশাখেরও বোধ হয় বিরক্ত লাগে এই গান শুনে! ভোম্বল মাঝে মাঝে ভাবে ,এইসময় হয়তো তার বন্ধুরা কি সুন্দর ক্রিকেট খেলছে , আজ জিতলো না হারলো কে জানে! ওই পাড়ার রণজয় দারুন বোলিং করে।
আগেরবার পুরো টীম কে ৫০ রানের আগেই অল আউট করে দিয়েছিলো। যতদিন যাচ্ছে, এই রবীন্দ্রানাথ ঠাকুরের ওপর রাগ বাড়ছে ভোম্বলের। কতগুলো বিকেল যে এই লোকটার জন্য নষ্ট হলো তার। "ভোম্বল ঠিক করে গাও , মুছে যাক গ্লানি টা ঠিক হচ্ছে না তোমার " ধমক দিলেন গানের শিক্ষক। ভোম্বল এর গ্লানি যে এই গানের স্কুল থেকে না বেরোনো পর্যন্ত মুছবে না সেটা বলাই বাহুল্য। বাড়িতেও কি কম অত্যাচার! প্রতিদিন সন্ধ্যে বেলায় হারমোনিয়াম নিয়ে বসতে হয় ,তারপর মা সব ভুলভাল গান বাজান। গান যে ভালো লাগেনা ভোম্বলের সেরকম কিন্তু না। যতসব হিন্দি সিনেমার গান ঠোটস্ত তার। ওই বুড়ো গানের শিক্ষক এই ধরণের গান কেন যে শেখাতে পারে না , সেটা বুঝতে পারে না ভোম্বল। কিছু করার নেই এইভাবেই দিন কাটতে লাগলো।
ভোম্বল এখন ক্লাস ১১ এ উঠেছে। পড়ার চাপ প্রচন্ড, খেলাধুলা বন্ধ হলেও গানের ক্লাস এখনো চলছে। না , গানের প্রতি ভালোলাগা এখনো তৈরী হয়নি তার। আজকে তাকে একটি নূতন গান শেখানো হচ্ছে। গানটি হলো - " ও দেখা দিয়ে যে চলে গেল / ও চুপিচুপি কি বলে গেল ". ভোম্বল গতানুগতিক ভাবে গেয়ে চলেছে গানটি , যথারীতি বিরক্তির সাথে। সাথে তবলা বাজাচ্ছে স্কুল এর সিনিয়র সমুদা ,যাকে কাল বিকেলে টিউশন যাওয়ার সময় পাড়ার গলিতে লুকিয়ে সিগেরেট খেতে দেখেছে সে ! তবলার সাথে সাথে সমান ভাবে তাল দিয়ে চলেছে গানের শিক্ষক আর মা এর বকুনি। বারবার একই ভুল করছে ভোম্বল। তবলা থামাতে হচ্ছে বলে মাঝে মাঝে বিরক্তিসূচক শব্দ করছে সমু দা। যাইহোক , কিছুক্ষন পর সেদিনের মতো নিস্তার পেলো ভোম্বল, একটু পরেই আবার ফিজিক্স এর টিউশন আছে।
সেদিন সকাল থেকে ফোটা ফোটা বৃষ্টি হচ্ছে। স্কুল এর লাস্ট বেঞ্চে বসে আছে ভোম্বল। তার প্রিয়বন্ধু বিভাস আজ স্কুলে আসেনি। খানিকটা একা একাই লাগছে তার। দুপুরের দিকে মেঘের ফাঁক দিয়ে একটু রোদও উঠেছে।হঠাৎ ক্লাস এর দেওয়ালের দিকে চোখ পড়তে সে লক্ষ্য করলো একটা আলো ঝলমল করছে। সে বুঝতে পারলো, কোনো কিছুর ওপর রোদ এসে পড়ায় তার প্রতিফলন সে দেওয়ালে দেখতে পাচ্ছে। যথারীতি এই আলোর উৎস সন্ধান করতে শুরু করতে চোখ গিয়ে আটকালো একটা মেয়ের গলায়। বুঝতে কো
নো অসুবিধে হলোনা যে তার গলার হারই হল এই সরল অথচ উজ্জ্বল আলোর উৎপত্তিস্থল। গলা থেকে চোখ ওপরের দিকে উঠতেই সে কেতকীর মুখখানা দেখতে পেলো। বুকের ভেতরে একটা কম্পন অনুভব করলো ভোম্বল। কেতকীকে তো প্রতিদিনই দেখছে সে, কই! আগেতো এরকম কিছু মনে হয়নি ! নিজের অজান্তেই সে মনে মনে গেয়ে উঠলো “ও পায়ে পায়ে যে বাজায় চলে , বীনার ধ্বনি তৃণের দলে " ভোম্বল এর জীবনে প্রবেশ করলো প্রেম , সাথে রবীন্দ্রনাথ।
না , সাহস খুব একটা ছিলনা ভোম্বলের তাই কেতাকির সাথে কোনদিন কথা বলে উঠতে পারেনি সে । স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে হারমোনিয়াম নিয়ে গান গাইতে বসল সে । আজ প্রথমবার মায়ের বকুনি ছাড়া নিজে থেকেই গান গাইছে সে । খানিকটা অবাকই হলেন মা । সেদিন গানের স্কুলএ নির্ভুল ভাবে গানটা গাইল ভোম্বল। মা আর গানের শিক্ষক ভোম্বলের এই পরিবর্তনএ আবাক হলেন তবে কারণটা কি বুঝলেন ? নাকি বুঝেও কিছু বললেন না! যাইহোক, ভোম্বল এর গানের প্রতি ভালবাসা বাড়তে লাগল ।
না ,এই মধুর দিনগুলো আর বেশিদিন রইল না । স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ভরতি হল সঘন বন্দ্যোপাধ্যায় তথা ভোম্বল । কিছুদিন হল বাবাকে হারিয়েছে সে । জীবনটা যে সহজপাঠ নয় সেটা বুঝতে পারছে সে । অনেক কষ্টে বাড়ি বাড়ি ছেলে পড়িয়ে পড়াশোনার খরচ চালাতে হচ্ছে। এখন আর গান গায়না সে । মাঝে মাঝে মনে হয় যে গান , কবিতা , সাহিত্য, রবীন্দ্রনাথ সবই হয়ত বড়লোকদের। মনে অনেক প্রশ্ন আসে তার । কই , কোনদিন কোন বাস কন্ডাক্টর কে তো রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে শোনেনি সে , কোন চাষিকেও তো তাঁর কবিতা বলতে শোনেনি । তাহলে রবীন্দ্রনাথ কি তাথাকথিত উচ্চবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্তদেরই সম্পত্তি? কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো প্রতিটি শিশুরই হাত ধরেন সহজপাঠের মধ্য দিয়ে । সেই হাত কেন ছেড়ে দিতে হয় অনেককেই? আবার এটাও মনে হয় , যে দেশে মানুষ দুবেলা দুমুঠো খেতে পায়না “সখী ভাবনা কাহারে বলে ?“ এর উত্তর তাদের কাছে এককথায় অপ্রাসঙ্গিক। এইসব চিন্তাধারা থেকেই রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়ে ভোম্বল , দূরে সরতে থাকেন রবীন্দ্রনাথ । রাজনীতি করতে গিয়েও হতাশ হয় সে । সেখানেও যে শুধুই দুর্নীতি আর অসহায় মানুষ গুলোকে বোকা বানানো। মতের অমিল হওয়ায় রাজনীতি ছেড়ে দেয় সে । খানিকটা আঘাতই পায় সে । সব যন্ত্রণা ভুলে পড়াশোনা তে মননিবেশ করে ভোম্বল । ঘরে বাইরে এর নিখিলই আজ তার সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক চরিত্র বলে মনে হয় । সব পরিস্থিতিতেই তার সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা যেন অনেককিছু শিখিয়ে দেয় । সাময়িক উত্তেজনা তার ওপর কোন প্রভাব ফেলে না । প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ না , বাস্তববাদী রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করে ভোম্বল। কিছিদুন পর একটা ভাল কোম্পানি তে চাকরি পায় সে।
অনেককাল কেটে গেছে । অনেক ছাতিম গাছের তলায় আনেক ব্যর্থ প্রেমিক এর দীর্ঘশ্বাস পড়েছে । একটা প্রজন্ম আস্তে আস্তে সরে গেছে পৃথিবী থেকে । আবার এক বৈশাখের বিকেলে কোন এক বড় শহরের কোন এক ফ্লাটএর হল ঘরে বসে এক মনে পিয়ানো বাজাচ্ছে এক বহুজাতিক সংস্থার উচ্চপদস্থ আধিকারিক সঘন বন্দোপাধ্যায়। হঠাৎ খেয়াল হল একটা স্বর যেন বেশী বাজছে । কারণ খুঁজতে গিয়ে সে বুঝতে পারল সদ্য হাঁটতে শেখা মেয়ে শ্রমণা পাশে এসে একটা পিয়ানোর 'কী' ধরে দাঁড়িয়ে আছে । মেয়েকে কোলে তুলে নিলো ভোম্বল । দুজনে মিলে গাইতে লাগল -
"ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,
ব্যক্ত হোক তোমামাঝে অসীমের চিরবিস্ময় ।
উদয়দিগন্তে শঙ্খ বাজে, মোর চিত্তমাঝে
চিরনূতনেরে দিল ডাক
পঁচিশে বৈশাখ ।।"