STORYMIRROR

Sanghamitra Roychowdhury

Romance Inspirational

2.5  

Sanghamitra Roychowdhury

Romance Inspirational

সুখ দুঃখ

সুখ দুঃখ

3 mins
559



রাতের রাজধানী শহর। চারিদিকে নিয়ন আলোর ঝলকানি। প্রতিদিনই রাজধানী শহর রাজকন্যার বিবাহ উৎসবের আলোক সজ্জায় সেজে ওঠে সন্ধ্যা হলেই। রোজই মনে হয় যেন আরো নতুন কিছু যোগ হয়েছে নতুন নতুন রূপে। পদ্মা রাস্তা দিয়ে চুপিসারে হাঁটতে থাকে একলা। ফুটপাথে যেমন তেমন করে একটা ছেঁড়া কম্বল বা ময়লা চাদর গায়ে অগণিত মানুষ গভীর ঘুমে আছন্ন। কেউ একদম একা, আবার কারুর বুকের কাছে সন্তান। ঠিকানা আজ তাদের ফুটপাথ। কাল কোথায় থাকবে কেউ জানে না তা, তবে আবার অন্য কোনো এক নতুন ফুটপাথেই হবে তা নিশ্চয়ই। পদ্মা আরো এগিয়ে চলে, নিজের গন্তব্যের দিকে। কালো মসৃণ পিচঢালা রাস্তাটা দেখে পদ্মার মনে হয়, কোথাও যেন এর কোনো শেষ নেই। রাতে শান্ত আলোয় চোখ ধাঁধানো রাজধানী শহরের এ কী রূপ! দিনের কোলাহল আর লম্বা লম্বা বিশাল সব অট্টালিকার বাবুদের দেখা নেই রাতের এই শহরে। শহুরে সমাজও তো বিভাজিত দিনে আর রাতে। পদ্মার এ এক গভীর বাস্তব উপলদ্ধি।




পদ্মা নিজের আস্তানায় ফেরে প্রায় মাঝরাতে। বড়ো কাজের চাপ সারাদিন। কখনো কখনো তার আবার সারারাতও বিরাট কাজের চাপেই কেটে যায়। বিশ্রামের অবকাশ নেই। সরকারি হাসপাতালে আয়ার কাজ। সাধারণ মানুষের চোখে বড়ো নীচু কাজ। তবুও করতেই হবে কাজ, পেট বড়ো বালাই অভাবের সংসারে। তাই তার চারপাশের এই চলমান সমাজের সাথে তাকে ক্রমাগত মানিয়ে নিয়েই চলতে হয়। বড়ো হাসপাতালে হাজার হাজার মানুষের সমাগম, সবাই সবার নিজের জন্যই ব্যস্ত। রুগিদের দেখভাল করার পরে কতজনের সাথে টাকাপয়সা নিয়ে ঝামেলা হয়ে যায়। মনে ধিক্কার আসে। তবুও কাজটা ছাড়তে পারে না পদ্মা। কাজ না করলে খাবে কি?




ঘরে ফিরেই রোজ ছোট্ট আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে পদ্মা জিজ্ঞাসা করে নিজেকে, "কি পেলি আজ?" আয়নার ভেতর থেকে প্রতিবিম্বটা বলে,"অনেক অভিজ্ঞতা।" আবেগঘন মনে পদ্মা ভাবতে থাকে সারাদিনের কথা। হাসপাতালে রোজ জন্ম দেখে, মৃত্যু দেখে, রক্ত দেখে, আবার সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষের মুখে হাসি দেখে কখনো। কখনোবা প্রিয়জন হারানো মানুষের শোক দেখে, বুকচাপা হাহাকার দেখে। পদ্মার মনটা শক্ত হয়ে গেছে। সামান্য একজন আয়া বৈ তো নয়। বড়ো হীন মনে করে মানুষ ওদের। হেলাফেলার নজরে দেখে। ভাবে শুধু গোনাগুনতি কটা টাকার বিনিময়ে শ্রম কিনে নেওয়া যায়। কেউ বোধহয় বোঝে না, শুধু পয়সার জন্য একজন

রুগিকে সারাদিন এভাবে আগলে রেখে দেখভাল করা যায় না। অনেকটা ভালোবাসা লাগে মনে অসুস্থ মানুষের সেবার কাজে। তাও যখন সবাই, "ঐতো ঐ আয়াটা", বলে সম্বোধন করে, তখন পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই পদ্মার বুকে একটা মোচড় মারে।

আজ একদম অন্যরকম একটা দিন। পদ্মা কিছুতেই মেলাতে পারছে না দিনটা অন্যদিনের সাথে। এক বৃদ্ধা রুগির কমলালেবু নাকি কম পড়েছে। পদ্মাই দেখভাল করে যেহেতু, তাই তার বাড়ির লোকেরা তো এই মারে কি সেই মারে।




পদ্মা লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছিলো, "ছিঃ ছিঃ, এ কী কথা, সাতাশ বছর কাজ করছি এখানে। শেষে কিনা চুরির বদনাম!" ওয়ার্ডে হৈচৈ পড়ে গেছে। ডাক্তার বসুরায়ের রাউন্ডের সময়। অভিযোগ শুনলেন ডাক্তারবাবু, সঙ্গে জুনিয়র দিদিরাও ছিলো। মাথা নীচু করে দাঁড়ানো পদ্মার পাশে এসে গম্ভীর গলায় ডাক্তার বসুরায় রুগির বাড়ির লোকেদের উদ্দেশ্যে বললেন, "দেখুন কাউকে সম্মান না করতে পারেন করবেন না, কিন্তু এভাবে অপমান করবেন না। পদ্মাদিরা আছে বলেই আপনারা রাতে বাড়িতে ফিরতে পারছেন। সারাদিন নিশ্চিন্তে থাকতে পারছেন। ওরা যেভাবে দেখাশুনা করে তা ঐ সামান্য পয়সায় মাপা যায় না। পদ্মাদিরা আছে বলেই আমরা আর সিস্টাররা কিছুটা ভরসা পাই। পদ্মাদি আপনি কিছু মনে করবেন না।" ডাক্তারবাবু নিজের কথা বলে এগিয়ে গেলেন নিজের কাজে। আর পদ্মার চোখ দুটো সেই তখন থেকে জল ঝরিয়েই চলেছে। থামার নাম নেই মোটে।





রাজধানী শহরের লম্বা লম্বা আলোর পোস্টগুলো থেকে নেমে আসা আলোর বৃত্তটাকে আজ পদ্মার মনে হয় এখানেই স্বর্গ। সব বিতৃষ্ণা, সব তিক্ততা আজ উধাও। পদ্মা আজ ঈশ্বরের দেখা পেয়েছে। আগে এর ওর মুখে শুনেছে পদ্মা ডাক্তার বসুরায়ের কথা। আজ কার্যক্ষেত্রে নিজের জীবনে প্রমাণ পেয়ে গেলো।




পরেরদিন হাসপাতালে এসে পদ্মা আবার পরম যত্নে সেই অসুস্থ বৃদ্ধার বেডপ্যান দিয়ে, গা স্পঞ্জ করিয়ে, চামচে করে খাওয়াতে খাওয়াতে বৃদ্ধার তোবড়ানো গালে আঙুল ছুঁইয়ে বলে, "মাসীমা খেয়ে নাও গো তাড়াতাড়ি। নইলে তোমার মেয়ে এসে আবার আমাকে বকবে যে গো।" বৃদ্ধার মুখে তখন আলো, পেটভরার পরিতৃপ্তি। দেখে ওনাকে শুইয়ে দিয়ে পদ্মা এগোলো করিডোরের দিকে। ওরা সবাই ওখানে বসেই বাড়ী থেকে আনা জলখাবার খায় আর সুখদুঃখের পাঁচালি শোনায় একে অপরকে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance