স্নেহের দান
স্নেহের দান


"মা তুমি আমাকে ছেড়ে একা থাকতে পারবে তো? আর নিজের ওষুধপত্র গুলো ঠিক সময়ে খাবে কিন্তু। সুগার আর প্রেশারের ওষুধ খেতে ভুলবে না যেন।" বিদিশা তার শাশুড়ি মাকে বললো। আর বিদিশার শাশুড়ি চন্দনা দেবী তাঁর কন্যাসমা এই পুত্রবধূটির দিকে স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,"না রে তোর কোনো চিন্তা নেই। কল্পনা আছে তো আমার দেখাশোনা করবার জন্য। ও সব করে দেবে। তুই নিশ্চিন্তে গিয়ে সংসার কর তো।" বিদিশা শাশুড়িকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলে। বিদিশার বিয়ে হয়েছিল আজ থেকে দু বছর আগে চন্দনা দেবীর ছেলে অভ্রদীপের সঙ্গে। কিন্তু ভাগ্যের এমনই নিষ্ঠুর পরিহাস যে ,অভ্রদীপ বিয়ের এক বছরের মধ্যেই অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। ডিউটি আওয়ার এ অভ্রদীপের মৃত্যু হয়েছিল যেহেতু, তাই বিদিশা তার স্ত্রী হিসাবে চাকরিটা খুব তাড়াতাড়িই পেয়ে গিয়েছিল। বাড়িতে অভ্রদীপের মা ছাড়া আর কেউই ছিল না। বিদিশা সেই থেকে চাকরি করবার সাথে সাথে, শাশুড়ির প্রতি সবরকম দায়িত্ব ,কর্তব্য পালন করেছে। শাশুড়িকে নিয়ম করে ডাক্তার দেখানো, তাঁর যত্নআত্তির জন্য সবসময়ের একটা কাজের মেয়ে রাখা , সবই বিদিশা ঠিক করে দিয়েছে। রোজ চাকরিতে বেরোবার আগে শাশুড়ির ওষুধপত্র সে নিজের হাতে বের করে রেখে যায়। অভ্রদীপের মৃত্যুর পর বিদিশাকে ওর মা, বাবা অনেকবার বাপের বাড়ি ফিরে যেতে বলেছিল। আসল মানুষটাই যখন রইলো না ,কি লাভ এখানে পড়ে থেকে। কিন্তু বিদিশা কিছুতেই একজন অসহায়, পুত্রশোকে কাতর মা'কে একা ফেলে রেখে যেতে পারেনি। বিয়ে হয়ে আসা ইস্তক এই মানুষটা তো কম স্নেহ দেয়নি তাকে। কখনও কোনো খারাপ কথা শোনায়নি। আর তাই এই অসহায় মানুষটার এইরকম খারাপ সময়ে তাকে একাকী ছেড়ে যেতে বিদিশার বিবেকে লেগেছে। এতটা স্বার্থপর সে কিছুতেই হতে পারবে না।
চন্দনা দেবীর এই কন্যাসমা পুত্রবধূর কাল বিয়ে। আর তাই বিদিশা তার শাশুড়ি মা'কে ভালোভাবে থাকতে বলছে। এই বিয়ে অবশ্য সে চন্দনা দেবীর ইচ্ছাতেই করছে। আসলে চন্দনা দেবী চাননি বিদিশা তার এতবড় জীবনটা এভাবে নষ্ট করুক। যে মেয়ে তাঁর দেখাশোনার জন্য নিজের বাবা মায়ের সঙ্গে বাপের বাড়ি ফিরে যেতে চায়নি, সেই মেয়ে তো তাঁর দায়িত্ব। তার ভালোমন্দের দায়িত্বও তো তাঁরই। তাই তো যেদিন বিদিশা রাত্রিবেলা অভ্রদীপের ফটোর সঙ্গে নিজের মনের কথা ভাগ করে নিচ্ছিল, আর কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো যে , জীবনে, কর্মক্ষেত্রে, সব জায়গায় একটা অল্প বয়সের স্বামীহারা মেয়েকে কতটা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তাকে একলা ভেবে কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষ কিভাবে তাকে ব্যবহার করতে চাইছে। সেদিন চন্দনা দেবী ওর ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় সব শুনেছিলেন। আর ঠিক সেই মূহুর্তেই চন্দনা দেবী মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলেন যে ,এ ব্যাপারে তিনি বিদিশার মা, বাবার সঙ্গে কথা বলবেন যখন বিদিশা ঘরে থাকবে না তখনই। আর তিনি সেটাই করেছিলেন পরদিন। বিদিশার মা, বাবাকে ঘরে ডেকে এ ব্যাপারে তাঁর মতামত জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন তিনি বিদিশার আবার বিয়ে দিতে চান। মেয়েটার এতবড় একটা জীবন তিনি এভাবে নষ্ট হতে দিতে পারেন না। সন্ধ্যে বেলা বিদিশা ফিরলে ওর বাবা, মা এবং চন্দনা দেবী তিনজনে তাঁদের বিদিশার ব্যাপারে নেওয়া সিদ্ধান্ত ওকে জানায়। বিদিশার হাজার বারণ সত্ত্বেও চন্দনা দেবী নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। শেষপর্যন্ত বিদিশা তার এই মায়ের জেদের কাছে হার স্বীকার করে, মত দেয় বিয়ের।
আর তারপরই বিদিশার জন্য তাঁরা উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান করতে শুরু করেন। শেষপর্যন্ত চন্দনা দেবীর এক বান্ধবীর সহযোগিতায় উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। বিদিশা কিন্তু কোনোরকম আড়ম্বরপূর্ণ বিয়ে করতে রাজি হয়নি। শুধুমাত্র রেজিস্ট্রি বিয়ে হবে, এই শর্তেই সে রাজী হয়েছিল। চন্দনা দেবী তাঁর এই পুত্রবধূটিকে নিজের মনের মতো করে সাজিয়েছিলেন বিয়ের দিন। সমস্ত অনুষ্ঠান শেষে বিদিশা তার শাশুড়ি মায়ের পা ছুঁয়ে সবার আগে আশীর্বাদ নিতে গেছে। চন্দনা দেবী নিজের এই মেয়েকে এই বলে তার নতুন শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়েছে যে, সে যেন তার এই মাকে কখনও না ভুলে যায়। বিদিশা কাঁদতে কাঁদতে তখন তার এই মাকে বলেছিল, "তোমাকে কি করে ভুলবো মা। তোমার স্নেহের দান রূপে তুমি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছো ,তাকে কখনও অস্বীকার করতে পারব না আমি। কটা শাশুড়ি তার পুত্রবধূর জীবন এভাবে নতুন করে সাজিয়ে দেবার সাহস করতে পারে মা। তুমি সেটা করে দেখিয়েছো।আর তুমি বলছো আমি তোমাকে ভুলে যাবো? আমার নতুন জীবনদাত্রীকে ভুলে যাবো?
আজ থেকে আমি তোমার মেয়ে মা, তোমার যাবতীয় দায়িত্ব আমার, ঠিক যেমন তোমার ছেলের দায়িত্ব ছিলে তুমি।আজ থেকে তুমি আমারও দায়িত্ব।" চন্দনা দেবী তাঁর মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। ঠিক যেমনভাবে একটা মা তার মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় কাঁদে।