Anindita Kashyap

Romance Crime

3.5  

Anindita Kashyap

Romance Crime

শুভবিজয়া

শুভবিজয়া

7 mins
388


শরতের ভোরে শিউলীর গন্ধে মাতানো চারিদিক। রাস্তার দুই ধারে খোলা মাঠে কাশবনের নাচ দেখে দেখে শুভর গাড়ি গ্রামের কাচা পথ হয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলেছে। 

জমিদার বাড়ির বড় রূপালী গ্যাট খুলে শুভর গাড়ি ঢুকে পরল।  মা শুভর পথ চেয়ে বাড়ির বারান্দায় বরণডালা নিয়ে তৈরী। মার উৎকণ্ঠার কারন অনেক বছর পর বাড়ি ফিরছে শুভ। মাঝে মধ্যে বাড়ি এসেছিল যদিও এবার অনেক দিন পর এল। স্নাতকোত্তর শেষ বর্ষে এবার সে। রাজপুত্রের মত গঠন, মিষ্টি চেহারায় মিষ্টি হাসিটা তার অপুর্ব। জমিদার বাড়ির ছেলেবলে কথা। শুভ বাড়ির একমাত্র ছেলে। বাবা-মা, কাকা- কাকিমা সকলকে শুভ পা ছুয়ে প্রণাম জানায়। আরোও দুজন ছিল যাদের প্রণাম জানাতে গিয়ে শুভকে তারা বুকে টেনে নেয়। একজন তো শুভর আয়া যিনি ছোটোবেলায় শুভর দেখাশোনা করতেন, এখন তিনি রান্নাঘর সামলান। আরেক জন সেই আয়ার স্বামী যে বাগান বাড়ি দেখাশোনা করেন, ছোটোবেলায় উনি শুভকে স্কুলে আনা নেওয়া করতেন। শুভর প্রি-স্কুলিং গ্রামেই হয়েছে। তারপর সে বাইরে বড় স্কুলে যায়। এই মেলাপের মধ্যে আরেকজন ভদ্রলোক খুড়োতে খুড়োতে এগিয়ে এলেন, ইনি হচ্ছেন কাকিমার ভাই। শুভ উনাকেও প্রণাম জানালো। কিন্তু সেই ভদ্রলোকের উপস্থিতি কেমন যেন নাকারাত্মক ভাব দিল। 

পরিবারের সাথে দেখা সাক্ষাৎ শেষ হতেই হতেই গাড়ির আরেকটি ডানা খুলে বেরিয়ে এল এক অপরূপ সুন্দরী মেয়ে। হালকা গোলাপী রঙের সালোয়ার সুটটা তার গায়ের রঙে যেন মিশে গেছে। সাদা ওরনা আর কমর অবধি চুল তার চলার তালে দুলছে। সামনে চোখের ওপর দুগাছা চুল। ছোট্ট মুখখানিতে একটি মিষ্টি হাসি নিয়ে সবাইকে করজোড়ে প্রণাম জানালো। আমি বিজয়া, শুভর বান্ধবী। সবাই একটু অবাক হয়ে শুভর দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে প্রশ্ন জানালো। 

শুভ বলল, মা তোমরা কিছু ভুল বুঝনা, ও আমার শুধু ভালো বন্ধু এর চেয়ে বেশী কিছু নয়। ও গার্লস হোস্টেলে থাকে। আমাদের ডিপার্টমেন্ট একই। ওর কেউ নেই, অনাথ আশ্রমে বড় হওয়া, স্কলারশিপ পেয়ে আমাদের কলেজে এসেছে। পূজোর ছুটিতে সবাই বাড়ি যায় কিন্তু ও কখনো যায় না। একা একা পুজোর সময় থাকবে বলে সাথে নিয়ে এলাম। কাল রাতে কথা ঠিক হলো তাই আর জানালাম না। 

শুভর কথা শেষ হতেই বিজয়া বলল, কাকাবাবু আমি আসায় আপনাদের কোনো অশুবিধে হবেনা তো, না জিঞ্জাস করে এসে পরলাম। আমার গ্রাম দেখার খুব ইচ্ছা ছিল, অনেক ছোট বেলায় নিজের গ্রাম ছেড়েছি। শুভর সাথে পরিচয়ের পর সুযোগ টা নিলাম। 

না না কি আবার অসুবিধা, এস এস ভেতরে এস, শুভর মা বলল। সবাই আনন্দের সাথে ঘরে প্রবেশ করল।

আজ বেলষষ্ঠী দুপুরের খাবারের পর্ব শেষ করে পূজোর আয়োজনে ব্যস্ত শুভর মা কাকিমা। বিশাল বাড়িতে বিজয়া ঘুরাঘুরি করছে একা একা। শুভ এসে বলল, চল পুরো বাড়িটা দেখিয়ে দেই তোমায়। বিজয়া রাজি হয়ে গেল। পুরো বাড়িটা ঘুরার পর একটি তালাবন্ধ দরজায় এসে দুজনে দাড়ালো। বিজয়া বলে উঠল বেসমেন্টের দরজাটা কেন তালা? শুভ বলল জানিনা অনেক বছর পরে আসলাম বাড়িতে, যাওয়ার আগে তো খোলাই ছিল। মা কাকিমার বয়স হয়েছে তো তাই হয়তো সামাল দিতে কষ্ট। 

ওইতো মামা, মামা দরজা টা কেন বন্ধ? মামা খুড়োতে খুড়োতে এগিয়ে এসে উল্টো প্রশ্ন বিজয়া কে করল, তুমি কিভাবে জানো এই দরজার পেছনে বেসমেন্ট আছে। বিজয়া একটু আশ্চর্য হয়ে উত্তর দিল, না মানে সিনেমাতে দেখায় তো বড় বড় বাড়িতে তালাবন্ধ দরজার পেছনে বেসমেন্ট থাকে তাই। শুভ জানো আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমি আগেও এই বাড়িতে এসেছি। শুভ জোরে হেসে উঠল, তুমি দেখছি ভুতুরে সিনেমার প্লট বানাচ্ছ। বিজয়া ও হেসে কথাটা হালকা করে দিল। মামা কিন্তু হাসেনি।

সপ্তমি পুজো, অঞ্জলি দেওয়ার হুরহুরি। শুভর মা বিজয়াকে নিজের ঘরে ডেকে একটি লাল পারের শাড়ি দিলেন, সাথে সব আসবাব পত্র দিয়ে তৈরী হতে বললেন। অঞ্জলির সময় হয়ে গেছে শুভ সবাইকে বলল, তোমরা বের হয়ে গাড়িতে বস আমি বিজয়া কে নিয়ে আসছি। বিজয়া এদিকে শাড়ির পেচে পেচিয়ে একাকার। শুভ নক না করেই ঢুকে পরল। উফ... স'রি, তুমি তৈরী হওনি এখনো, সবাই ওএট করছে গাড়িতে, শুভ মুখ ফিরিয়ে দারিয়ে বলল। 

বিজয়া বলল, এই যে শাড়ী কোনোদিন পরিনি, ভেবেছিলাম শাড়ি পরাটা খুব সহজ, কিন্তু দেখছি একেবারে সহজও নয়। এখন কি করি আমি বলত। শুভ বলল, আমি পরিয়ে দিই। আর তো উপায় নেই। বিজয়া বলল, ওদিকে মুখ ফিরিয়ে কিভাবে শাড়ি পরাবে। এদিকে তাকাও আর যা করার জল্দি কর। বাকি সব হয়ে গেছে শাড়ি পরে নিলেই যেতে পারব। 

শুভ দুষ্টুমির শুরে, তাই যা করার জল্দি করব। ঘুরে দেখতে গিয়ে শাড়িতে পেচিয়ে শুভ বিছানায়, শাড়ির টানে বিজয়াও তার উপর। শাড়ি ছাড়া দুহাতে নিজের লজ্জা আবরণ করে শুভর বুকে বিজয়া। বিজয়ার কোমল শরীর শুভর দুই বিশাল বাহুতে আকড়ে রয়েছে। দুধে আলতায় শরীরটা লাল কাপড়ে যেন থাকতে পারছেনা, বিজয়াকে এমন রূপে শুভ কখনো দেখেনি, তাই হয়তো বিজয়াকে এভাবেই বুকে নিয়ে থাকার ইচ্ছা। হঠাৎ মা র আওয়াজ পাওয়া গেল, কোথায় ওরা? আপনি যান গাড়িতে বসুন গিয়ে। আপনার চলতে এমনিতে অসুবিধে। আসতে আসতে এগিয়ে যান।

মার গলা পেয়ে দুজনেই তাড়াহুড়ো করে দাড়িয়ে পরল। মা এসে বলল, ও তুমি শাড়ি পরতে জাননা বুঝি, তো আগে বলনি কেন। আর তুই দাঁড়িয়ে কি দেখছিস যা আমি ওকে তৈরী করে নিয়ে আসছি, যা...

পূজো মণ্ডপে শুভর চোখ যেন শুধু বিজয়ার উপর। মা সেটা ঠিক লক্ষ করেছেন। রাতে খাওয়ার টেবিলে মা বিজয়া কে প্রশ্ন করল, তোমার মা এই গ্রামের বলেছিলে, না। কি নাম উনার? উত্তর দিল বিজয়া, পার্বতি। নাম টা শুনেই খুড়োমামার কাশি শুরু হয়ে গেল। সবাই মামাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠল। পরিচয়ের পর্ব ওখানেই স্থগিত। 

মহাঅষ্টমীর সকাল, কি সুন্দর পরিবেশ। ঢাক, শংখ বাজছে। জোকার পরছে। ঘি চন্দনের গন্ধে চারিদিক মই মই। শুভকে ডেকে মা জিঞ্জাস করল মেয়েটিকে পছন্দ তোর। আমার ভারি মিষ্টি লেগেছে। বাবার অনুমতির আগে তোর মনের কথাও তো জানতে হবে। 

শুভ বলল, মা সত্যি বলছি তেমন কিছুই নেই আমাদের মধ্যে। আমি জানি আমি ওকে অনেক ভালোবাসি কিন্তু তোমাদের অনুমতি ছাড়া আমি কোনো কাজ করবনা। অনাথ মেয়েটিকে আপন করে নিতে তোমাদের বাঁধতেও পারে, বুঝি। কিন্তু ওকে দেখার পর হয়তো তোমরা না করবেনা এটাও আশা ছিল। তাই একবার চেষ্টা করে দেখলাম। বিজয়া এই বিষয়ে কিছু জানেনা মা। ও আমাকে পছন্দ করে কিনা সেটাও জানিনা।

শুভর দুই গালে হাত রেখে মা বলল তোকে যে পাবে সে পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী। কপালে মা র মিষ্টি চুমু।

মা ছেলের কথার মধ্যে হঠাৎ ধম্ ধম্ করে এসে বিজয়া বলল আজ আমি রান্না করব। মা কি বানাবো? ওঃ স'রি ভুলে মা বলে ফেললাম।

মা বললেন, মা ডাক টা তোমার মুখে ভারি মিষ্টি শুনিয়েছে। আজকে নিমন্ত্রণ সবার, দিনে রাতে। ঘরে রান্না করতে হবেনা। যাও গিয়ে তৈরী হয়ে নাও। যেই কাপড় পরলে সুবিধে হয় সেটাই পর।

রাতে বাড়ি  ফিরে সবাই নিজের নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পরল।

নবমীর সকাল, ঢাকের আওয়াজ।পূজো শুরু হয়ে গেছে। বিজয়ার শরীর ভালো নয়। জ্বরের কোপে আবোলতাবোল বকছে। শুভ পাশে ঠাই বসা।একটু হোষ আসায় বিজয়া শুভ কে বলল, জানো ছোটোবেলায় রোজ খুব খারাপ স্বপ্ন একটা দেখতাম। অনেকদিন দেখেছি তারপর আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেছিল। এখানে আসার পর আবার সেই স্বপ্ন আমি দেখছি। আমি বলেছিলাম না এই ঘর আমি আগে দেখেছি মনে হয়। 

কে ওখানে? শুভ কেউ দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। কেউ নেই বাবা। আচ্ছা দেখছি, মামা তুমি। এখানে দাঁড়িয়ে কেন ভেতরে এস। 

মামা বললেন, সব ঠিক আছেতো। এইটুকু বলে খুড়োতে খুড়োতে চলে গেলেন। 

 আজ কেউ বেরিয়ে যায়নি। বিজয়া কে নিয়ে ব্যস্ত সবাই। দুই তিন দিনেই সকলের আদরের পাত্র হয়ে গেল বিজয়া।  রাতের দিকে বিজয়া একটু আরাম পেয়েছে। সারাদিন এভাবেই পার হয়ে গেল।

আজ অসুর বধ, মহাদশমী। মা কাকিমা দুজনেই বাটা ছোয়ানো আর সিঁদুর খেলার জন্য কাকার সাথে মণ্ডপে গেছেন। বাবা বিশেষ কাজে গ্রামের বাইরে গেছেন। বিজয়া বিছানায় আরাম করছে। বিজয়াকে ঘুমানো দেখে শুভ একটু বেড়িয়ে বাচ্চাদের খেলা উপভোগ করছিল। হঠাৎ একটা আওয়াজ পেয়ে বিজয়া জেগে গেল। বিছানার থেকে নেমে সে এগিয়ে গিয়ে দেখলো বেসমেন্টের দরজা খোলা। বিজয়া শুভর নাম নিতে নিতে চাপা চাপা পায়ে একটু নিচে নামল। শুভর কোনো আওয়াজ না পেয়ে বেরিয়ে যেতে গিয়ে হঠাৎ দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। মৃদু মৃদু আলোতে দেখা যাচ্ছে না কে দরজাটা বন্ধ করল। খুড়োতে দেখে বিজয়া কাপা কাপা সুরে বলল, মামা তুমি?

হ্যাঁ আমি, তুই বদলা নিতে এসেছিস। তুই সেই পার্বতির মেয়ে।প্রথমদিন তোর চেহারা দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। দরজা বন্ধের কথাটা আরেক ইঙ্গিত। তোর মুখে তোর মার নাম শুনে, আমি বুঝে গেছি তুই সেই ছোট্ট মেয়েটি। এই বেসমেন্টে তোর মাকে সর্বনাশ করে কিভাবে মেরেছিলাম, তার একমাত্র সাক্ষী তুই। সেদিন তুই আমার হাত থেকে পালিয়ে ছিলি, তোকে ধরতে গিয়ে আমার পায়ের এই অবস্থা। আজকে তোকে আমি ছাড়বনা। তোর জন্য আমি মৃত্যু দ্বন্দ্ব নিতে রাজিনা। তুই আমার অনেক ক্ষতি করতে পারিস। এতবছর কেস চলার পর আমি বড় হয়েছি। এবার তুই বদলা নিবি।

বিজয়া কাঁপা কাঁপা গলায়। মামা আমার কিছু মনে নেই। আমি কোনো বদলা নিতে আসিনি। বিজয়া কথা বলে বলে আশেপাশে কিছু খুজতে লাগল, একটা রড তার হাতে এসে পরল। কিছু চিন্তা না করে সে সয়তানটার মাথায় জোরে আঘাত করল। এমন সময় দরজা পিটানোর আওয়াজ। সয়তান টা মাথায় হাত দিয়ে বসে পরল। এই সুযোগে বিজয়া দরজা খুলে দিল। বিজয়া শুভকে দেখে জড়িয়ে ধরে হাও হাও করে কাদতে শুরু করল। শুভর মা কাকিমা কাকা  সকলে বেসমেন্টে উপস্থিত। বিজয়া সব কথা খুলে বলল, সবাই বুঝতে পারল। শুভ মামা কে দেখলো না সে আর নেই। শুভ ঝট করে রড টা নিজে নিয়ে নিল। শুভর কাকিমা শুভকে বললেন এই পরিস্থিতির একমাত্র দায়ী আমি। সব জেনেও সত্যি বলিনি। ভাইয়ের মায়া আমাকে আটকিয়েছিল। বিজয়া তোমার মা তো নেই, তুমিই আমাকে ক্ষমা করে দিও। আজ দশমীর দিনে  আরেক সয়তানের  নাশ হল। ভগবানের আদালতে বিচার হবেই। ভগবানের মার সব থেকে বড় মার। যেখানে পাপ করেছিল সেখানেই পাপের শাস্তি পেল। আমিও শাস্তির ভাগিদার, বলে শুভর হাত থেকে রড টা ছিনিয়ে নিল এবং বলল, শুভ এই সয়তানের জন্য তোমার বলিদান আমি দিতে পারবনা বাবা। সুখে থাক, শুভবিজয়া।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance