পূর্ণ বিরাম
পূর্ণ বিরাম
তোমার বুকের কাছে, হাত দুটি দিয়ে আকড়ে রেখেছ আমায়। তবু যেন তোমার আওয়াজ অস্পষ্ট। খুবই ভারি গলায় ধীরগতিতে আমার নাম নিয়ে যাচ্ছ বারে বারে। খুব ভালো লাগছে জানতো, মনে পরে? সেইদিন অজান্তেই তোমার বুকে আমার মাথা গুজে দিয়েছিলাম।
দাদার বিয়ে, আমি একটি মাত্র বোন। বাবার প্রাণের টুকরো, মার তো আদরের বটেই। তুমি পাশের বাড়িতে থেকেও বন্ধুর বিয়েতে বিয়ের দিন উপস্থিত হলে। অন্য বন্ধুদের তো প্রায় আসা যাওয়া চলছে। বরযাত্রী যাওয়ার নিমন্ত্রণ পেয়ে দেখা করতে এসেছিলেতো। কেউ কিছু মনে করেনি তোমার না আসা নিয়ে, সবাই জানে তুমি যে শহরের বাইরেই বেশি দিন কাটাও। তোমার মা- বাবা প্রায় এসেছেন বাড়িতে। কাকাবাবু-কাকিমা প্রতিবেশী হিসেবে খুবই ভালো।
পিশিমা স্নানের আগে চুলে মেহেন্দী লাগাতে বলেছিল। বিয়ের দিন তাড়াহুড়োতে নিমপাতার ফেসপেক পিশিমার মাথায় লাগিয়ে দিলাম। পরে বুঝতে পেরে ঝাটা নিয়ে আমাকে তারা করে, আমি দাদাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বাচার চেষ্টা। পিশিমার ঝাটার থেকে তো বেচে গেলাম কিন্তু সবার হাসাহাসির শব্দ আর দাদার একটিও শব্দ নাপেয়ে মুখ তুলে দেখলাম।পালিয়ে নিজের ঘরে। উফ! লজ্জায় গাল লাল, কান গরম হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সুরক্ষিত অনুভব হয়েছিল তোমার বুকে মাথারেখে, পরে বুঝতে পেরেছিলাম।
দাদার বিয়েতে খুব আনন্দ হয়েছিল। তারমধ্যেই তোমার সাথে সুন্দর সম্পর্কে কখন লিপ্ত হয়েগেলাম নিজেই বুঝলাম না।
বিয়ের পর ঘর ফাঁকা। দাদা-বৌদি অষ্টমঙ্গলায় গিয়েছিল। পিশির মেয়ে গেল ওদের সাথে, আমি যাইনি, মা-বাবার অশুবিধা হয়ে যেত। বাবার শরীর বিশেষ ভালো ছিলনা তাইজন্যইতো দাদাকে একটু জল্দি বিয়ে করতে হ'ল। বিয়েটা সে নিজের পছন্দেই করেছে, ওর পছন্দের জবাব নেই।
সকালে বিছানা তুলছিলাম। "কাল চলে যাচ্ছি আন্টি" কথাটা শুনে কি যেন গভীর চিন্তায় হারিয়ে গেলাম। কানের পাশে হালকা বাতাসের সাথে তোমার প্রশ্ন, " কিছু বলবেনা? আমার প্রস্তাবের উত্তর কি?" চমকে একটু দুরে সরে গিয়ে ওড়না টা গায়ে তুলে নিয়েছিলাম। আমার চারিপাশের বাতাস যেন উত্তপ্ত হয়ে উঠছিলো, খুব গরম অনুভব করছিলাম। মা হাতে জলখাবার নিয়ে আসল। বাড়িতে অন্য কেউ নেই তাই আমার ঘরে তোমাকে দেখে কিছু বলল না সেদিন, কিন্তু মার চোখে ফাকি দেওয়া যায় না।
দাদা বাইরে চাকরি করত। আমি আছি তাই বৌদিকে বাবা মা, দাদার সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছে। মনে আছে কত চিঠিতে তোমায় লিখেছি জল্দি এসে কথা পাকা করে যাও। তুমি চিঠিতে উত্তর কোনোদিন দাওনি, ফোনে কথা বলতে। সেটার
কারণও জানি বাংলা কোনো ভাবে পড়তে পারলেও লেখতে পারতেনা। দাদা অনেকবার বিয়ের আলাপ এনেছিল, বাবা রাজি হননি। ছোটোবেলার থেকে দেখছি আমার না বলা কথা বুঝতে পারার ক্ষমতা ছিল বাবার। কিন্তু আমার সেই ইচ্ছা পূরণ করার আগেই বাবা চলে গেল, আমার দিকে শেষ দৃষ্টি তে চিন্তা কৌতূহল সবটাই ছিল। সারাটি জীবন সব দিয়ে আদরের মেয়েটিকে একটি জায়গায় আটকিয়ে যাওয়ার অক্ষমতা বাবার চোখে ছিল সেদিন। বাবার মৃত্যুর খবরে এক দিনের জন্য এসে ছিলে, মাসখানেক পেরিয়ে গেল তোমার কোনো খবর নেই। দুশ্চিন্তা মনে ঘর করছিল।বছর খানেক কেটে গেল, কাকাবাবু কাকিমাকে ও দেখছিলামনা, শুনেছিলাম তোমার কাছেই আছেন।
ফোনটা বাজলেই ছুটে ধরি কিজানি তোমার ফোন আসে। সত্যি তুমি ফোন করেছিলে। কাল আসছি বাইরে একটু দেখা করবে। খুসিতে আত্মহারা। মাকে বলিনি যদিও মা বুঝতে পেরেছিল।
আজকে দেখা করতে আসার আগে তোমার পছন্দের রং নিয়ে সমস্যা হয়েছিল। তোমার পছন্দের রঙ্গের কাপড় সবটি আছে, কি পরি? খুব কষ্টে সাদা লালে চুরিদার বেছে নিয়েছিলাম। বিয়ের পিড়িতে বসতেও এতো চিন্তা করবনা হয়তো এখন যতটা উৎসাহী।
যেরকম রেস্টুরেন্টে পায়রাজুটিরা গিয়ে বসে, তেমনি এক কোলাহল শূন্য জায়গায় গিয়ে বসলাম। তোমাকে নজরগোটা দিতে হবে, কালো নজর থেকে বাচার জন্য মনে ভাবনা হয়েছিল। তুমি বললে "কেমন আছ?" আমিতো এতোটাই খুসি অভিযোগ ও তুললাম না যে এতদিন কোথায় ছিলে। ভালো ই আছি। চোখের জলের বাঁধ ভাঙলই। তোমাকে কাছে পেয়ে বাবাকে খুব মনে পরছিল। শেষ সময়ে বাবার যে চিন্তা চোখে ভাসছিল, সেই চিন্তা আজ মিটে যাবে।
"আমাকে ভুল বুঝনা, পরিস্থিতির চাপে আমাকে বিয়ে করতে হলো, তুমিও বিয়ে করে এগিয়ে যাও।" বললে তুমি । ভেতর টা চুড়মাড় হয়ে যায় আমার। কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না। চুপচাপ উঠে আসলাম। বাবার কথা মনে পরে বুকটাতে ব্যাথা হচ্ছে, উনি থাকলে আজকে কতটা না কষ্ট পেতেন।
গাড়িটা হঠাৎ ধাক্কা দিল এত জোরে কিছু বুঝে উঠার আগেই গড়িয়ে পরলাম রাস্তায়। তুমি বোধহয় ছুটে এসে আমাকে বুকের পাশে তুলে নিলে। আমায় ডাকছ তুমি, উত্তর দিতে সক্ষম নই আমি।
পুরোনো স্মৃতি সবটাই চোখের সামনে এসেগেল। এটা কি চারিদিক সাদা ধুয়া হয়ে আসছে, এত আলো চোখ খোলাই যাচ্ছেনা।
" মা, অনেক কষ্ট হচ্ছে না তোর। বুকে ব্যাথা হচ্ছে, তাইনা। আমার সোনা মা, আর কষ্ট হবেনা চল আমার সাথে চল।"
বাবা তুমি ! এখনো তুমি আমার মনের ব্যাথা বুঝতে পার।...........