শেষ দেখা
শেষ দেখা
'বিপ-বিপ-বিপ' হাসপাতালে আই.সি.ইউ. রুমের ঐই শব্দটি সারা রাত জাগিয়ে রাখল আমাকে। কালরাতে মৃত্যুর মুখ থেকে ঘুরে আসলাম, ডাক্তার বললেন। হঠাৎ এমন পরিস্থিতি কিছু বুঝতে পারলাম না। যাক, ভগবানের ইচ্ছে না হ'লে মোক্ষ পাওয়া যায় না। রুমটি বেশ ঝকঝকে। চারটি মাত্র বেড আছে। পাশের বেডের মানুষ টা এই যায়, সেই যায় অবস্থা খুব সুচনিয়, কষ্ট পাচ্ছে মনে হচ্ছে। তার সোজাসুজি বেডটার মানুষ টাকে রক্ত দেওয়া হচ্ছে। আমার সোজাসুজি বেডটাতে ভদ্রলোকের শরীরে কোনো হৈ চৈ নেই কেমন যেন লাশটার মতো পরে রয়েছে। হাসপাতালে ঢুকলে জীবনের কি দাম আর জীবনের যে কোনো দাম নেই তা সহজেই বোঝা যায়। নার্স বললেন আমার স্বামী বাড়ি গেছেন ফ্রেশ হতে, সারা রাত ঠাই বসা ছিলেন।
কেন জানিনা মনটা একটু অস্থির। কাল যদি কিছু হয়ে যেত, কিছু কি আটকে থাকত আমার জন্য। ভেবে দেখলাম কর্তব্য মোটামুটি সবটাই শেষ, শুধু যেন__
শুধু যেন কি? নিজেকে প্রশ্ন। প্রশ্নের উত্তর তো পাওয়া যাচ্ছেনা কিন্তু পুরনো স্মৃতির জোয়ার উঠছে মনের ভেতর। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিন গুলোর স্মৃতি। সেই তিনটি বছর এখনো চির সবুজ হয়ে রয়েছে। এখনো একটি মিষ্টি হাঁসির ছোঁয়া দেখা যায় চেহারায়, সেই দিনগুলোর পাতা উলটালে। প্রথম দিন কলেজের, ঠিক আজকের মতই অস্থিরতা। পরিচয় দেওয়ার পালা। প্রথম দিনই পরিচয় তার সাথে, যার সাথে শুধু একবার দেখা করার ইচ্ছে এখনো মনের কোণে রয়েছে। তার পরিচয় যদি দিতে চাই তবে বলতে হবে সেই ভারি গলার স্বরে আমি প্রথম দিনই মুগ্ধ। প্রথম বছরেই অনেকের সাথেই বন্ধুত্ব গড়ে উঠল কিন্তু তার সাথে নয়। একটু বদরাগি, কলেজের দাদা পর্যায় রাখা যায় তাকে। জুনিয়ররা তো কথা বলতেই ভয় করত। তারমধ্যেও সে আমার ভালোলাগার পাত্র হয়ে উঠল। তার কারণ তার মনেযে আমিও ঘর বেধেছিলাম। সরাসরি কোনো দিন সেটা বলা হয়নি যদিও চোখাচোখি হলে সেই না বলা কথা চোখের ভাষায় প্রকাশ পেতো। দুটি বছর আনন্দ ফুর্তিতেই কাটলো। শুধু শেষ বছর টা রয়েছে। কলেজ শেষ হওয়ার কথায় মনটা শূন্য হয়ে যায়। বছর শেষ হয়ে পরীক্ষার ফলাফলও এসে পরল। পাশ করার খুসি ও ছিল, কলেজ ছাড়ার দুঃখও। কিন্তু না বলা কথা বলা হলো না আর।
আজকের মতো তখনও যদি সোসিএল মেডিয়া থাকত আমার বিয়েতে সব বন্ধুদের নিমন্ত্রণ জানাতে পারতাম। বিয়ের দিন সকালে একটি ফোন, "ভালো থেকো"। লেণ্ড লাইন যদিও, কে জিঞ্জাস করলাম না। স্বরেই বুঝত
ে পারলাম, বললাম "তুমি আসবেনা, তাইনা।" না চাওয়া হাসি দিয়ে বলল, "রাখি।"। সেদিন যেন স্বর আরো ভারি মনে হ'ল।
আমার স্বামী বড় মনের মানুষ। এমন একজন যার ভালোবাসা পাওয়া টা প্রাপ্য। আমিও ত্রুটি করিনি সংসারে। মন ঢেলে চুটিয়ে সংসার করেছি। কিন্তু সেই মনের কোণায় ছোট্ট জায়গাটি কারোর দ্বারা দখল করা সম্ভব হলো না। উফ! কি যে আজেবাজে কথা মনে আসছে আজকে। এই মানুষ টা এতো দেরি কেন করছে আসতে। একটু ঘুমিয়ে গেলে হয়তো ভালো লাগবে।
হাতের উপর হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম। চোখ খুলে একজন ভদ্রলোককে পাশে বসা পেলাম। "ভালো আছ ?" কোনোদিন না ভুলা আওয়াজ টা পেয়ে ছলছলিয়ে গেল চোখের কোণ। ভাবতেই পারছিলাম না সে যে সত্যি আমার পাশে বসে আছে। " বন্ধুদের খবর রাখতে হয় না বুঝি। ", অভিযোগের সুরে বললাম। " বন্ধু নয়" বলল সে। যদি বন্ধু নই তবে কে এই প্রশ্ন করতে পারবনা এখন আর। কিছু না বলে চোখে চোখেই অভিযোগ চলছে। কেন বলা হলো না মনের কথা। "একবার দেখা করবার প্রবণতা ছিল" বলে ফেললাম। "শেষ দেখা তো করতেই হবে, সেই জন্যই তো তুমি এখানে" সে বলল। কথাটা সবটুকু বুঝতে না পারলেও এইটুকু বুঝছি দেখা করার ইচ্ছে টা ওর ও অতটাই যতটা আমার। অস্থিরতা একটু বেড়ে যাওয়ায় হাত টা আরো শক্ত করে ধরে আমাকে আরাম করতে বলল। আমিও নিশ্চিন্ত হয়ে চোখ বন্ধ করে নিলাম। ঘুম ভাঙল, চোখ খুলে আমার স্বামী কে দেখলাম নানা ধরনের প্রশ্ন মনে উথাল পাথাল। সে বলল, "একটু ভালো লাগছে?"। মিথ্যা যদিও হেসে হ্যাঁ বললাম। শারীরিক আরাম পেলেও মন টা তো পায়নি। সে বলল, " একটা খারাপ খবর পেলাম জানতো। আমার এক ফেসবুকের বন্ধু একটু আগে শেষ নিশ্বাস নিল। তুমি চিনবে, তোমার ক্লাসমেট। "। আগ্রহ না নেওয়া কথায় কৌতূহলে জিঞ্জাস করলাম "কে?" ও বলল, "একদিন প্রফাইল ফটো দেখে বলে ছিলে যে তুমি ওকে চেন তোমার সাথেই ছিল কলেজে। "। সে কে বুঝতে পেয়ে শব্দহীন হয়ে রইলাম, চোখের জল আর থামাতে পারলাম না। ও আবার বলল, "সব থেকে খারাপ লাগছে এত কাছে থেকেও শেষ দেখা হলো না" আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম "মানে"। "এই তো সোজাসুজি বেড টাতেই ছিল, তুমি ঘুমিয়ে থাকার সময়, নিয়ে গেল বডি।"
নিস্তব্ধ হয়ে গেল সব, কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। ওর বলা কথাটাই কানের আশেপাশে চলছিল, "শেষ দেখা তো করতেই হবে। তাইতো তুমি এখানে"। শেষ দেখা মোক্ষের দোয়ার খুলে দিল।