STORYMIRROR

Sagnik Chakraborty

Tragedy Crime

4  

Sagnik Chakraborty

Tragedy Crime

শেষ যাত্রী

শেষ যাত্রী

5 mins
618

পুরুলিয়া গ্রামেরই এক বাসিন্দা দয়ানন্দ| দয়ানন্দ পড়াশুনায় ভালো হলেও তার পিতা-পিতামহের অকালপ্রয়ানের পর, সংসারের সকল চাপ তার উপর থাকার কারণে, টাকা উপার্জন করবার জন্য বেছে নিতে হয় তাকে ট্যাক্সি চালানোর পেশা| আজ সে এই পেশায় আছে, তা প্রায় কুড়ি-তিরিশ বছর| তার এই অভিজ্ঞতায় সে নানা রকম যাত্রীদের তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছেছে, তাদের সঙ্গে মিশেছে এবং নানা অভিজ্ঞতার শিকারও হয়েছে| তবে তার এই অভিজ্ঞতায় একবার তার সঙ্গে যা ঘটেছিল তা সে চাইলেও জীবনেও ভুলতে পারবে না|

রাত তখন বোধ হয় দুটো| দয়ানন্দ সবে তার শেষ যাত্রীকে নামিয়ে বাড়ির পথে রওনা হবে এমন সময় বেজে উঠলো তার ফোনটি| হ্যাঁ! আর একজন যাত্রী! সংসারের দারিদ্রের কারণে দয়ানন্দদের বাড়িতে হাঁড়ি চড়েনি দু দিন| রাতের যাত্রীদের সাধারণত একটু বেশি টাকাই দিতে হয় চালকদের, অফ-টাইমে কাজ করার জন্য| তাই একটু বেশি টাকা পাওয়ার লোভেই সে সেই যাত্রীর কথায় রাজি হল| তারপর ট্যাক্সি নিয়ে সে পৌঁছে গেল সেই শেষ যাত্রীর নিকটে| নিকটে যেতেই একটা লোক, কালো জ্যাকেট পরে, হাতে একটা দামি ঘড়ি পরে, কয়েকটা সুটকেস নিয়ে বসলো ট্যাক্সিতে| রাস্তা অন্ধকার থাকার কারণে তার মুখ ঠিক দেখা না গেলেও, দয়ানন্দ জিজ্ঞাসা করলো তাকে,"আচ্ছা দাদা! আপনি এতো রাতে সুটকেস নিয়ে কোথায় যাবেন?" লোকটি কোনো উত্তর না দিয়ে তার পকেট থেকে একটা কাগজের টুকরো হাতে ধরিয়ে দিলো তার| তাতে লেখা ছিল তার গন্তব্যস্থল| দয়ানন্দ চাবি ঘুরিয়ে তার গাড়ি ঘোরালো গন্তব্যস্থলের দিকে| গাড়ির চাকা গড়ানোর সাথে সাথেই ব্যক্তিটি তার পকেট থেকে একটা পেন্ বের করে কিসব লিখতে শুরু করে দিলো| রাস্তায় যেতে যেতে দয়ানন্দ তার জীবন , ইতিহাস, প্রভৃতি সম্বন্ধে বলতে থাকে| কিন্তু লোকটি কোনো কথাই বলে না| সে কেবল লিখতে থাকে| অবশেষে এসে পৌঁছলো তার গন্তব্যস্থল| লোকটি তার পকেট থেকে একটা কড়কড়ে ৫০০ টাকার নোট তাকে বের করে দিয়ে, দূরে হওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে গেলো| 

শেষ যাত্রীকে নামিয়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে হাত-পা ছাড়িয়ে, দয়ানন্দ আলিস্যি ভাংলো| আলিস্যি ভাঙার সময় তার হাতে লেদারের কিছু একটা ঠেকলো| জিনিসটা অনেকটা সুটকেসের মতো| সে সঙ্গে সঙ্গে সেই জিনিসটা , এক টানে, তার সিট পেরিয়ে, কোলের উপর এনে ফেললো| হ্যাঁ! এটা একটা সুটকেসই বটে, সেই শেষ যাত্রীর সম্ভবত| একটু কৌতূহলী হয়ে দয়ানন্দ সুটকেসটি খোলার চেষ্টা করতে লাগলো, তার ভেতরে হয়তো সেই শেষ যাত্রীর ঠিকানা থাকবে, এই আশা নিয়ে| সুটকেসটি খুলে সে দেখল তাতে রয়েছে বান্ডিল বান্ডিল নোট| সব ৫০০ টাকার| তার উপরেই সে দেখলো একটা কাগজের টুকরো| না ঠিক কাগজের টুকরো বলা ভুল হবে| একটা চিঠি| তাতে লেখা ছিল তার সব কথার উত্তর এবং আরো লেখা ছিল যে সেই সব টাকা সে তাকে তার সংসারের জন্য দিয়ে যেতে চায়| কিন্তু দয়ানন্দের সবসময় এই মনোভাব ছিল যে সে সবসময় নিজে খেটে, টাকা রোজগার করবে এবং তা সে করবে সততার সাথে| সে সেই সুটকেসের এদিকে-ওদিকে হাত গলালো, সেই শেষ যাত্রীর পরিচয়ের জন্য| সুটকেসের ভেতরে, মাথার দিকের একটি খোপ থেকে পাওয়া গেল একটি চেক বই| রাত ক্রমেই অনেক বেড়েছে| তাই সে স্থির করলো যে সে পরদিন সকালবেলায় চেক বইয়ে দেওয়া ঠিকানায় টাকাটি পৌঁছে দিয়ে আসবে| 

তারপর যেমনি কথা তেমনি কাজ| পরদিন সকালবেলায় উঠেই সে পৌঁছে গেলো সেই ঠিকানায়| গিয়ে দরজায় কড়া নাড়তেই দরজা খুললেন এক অল্প বয়সী সাদা কাপড় পরা এক বিধবা| তিনি দরজা খুলেই দয়ানন্দকে জিজ্ঞাসা করলেন, "কে আপনি? কি চান?" দয়ানন্দ বুঝিয়ে তাঁকে আগের রাতের ঘটনার কথা বললো| তার কথা শুনেই সেই মহিলাটি হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ক্রন্দন করতে শুরু করলেন| দয়ানন্দ তাঁকে তাঁর অশ্রু বরণের কারণ জিজ্ঞাসা করলো| মহিলাটি দরজা হাট করে খুলে দিয়ে একটি ছবির দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন,"আজ থেকে ৫ বছর আগে, ঠিক কালকের রাত্রি বেলায়, আমার স্বামী, নিজের যথাসর্বস্ব গরীব-দুঃখীদের দান করবেন বলে বেড়িয়েছিলেন| তার এই মহৎ কার্যের পূর্বে আমি, আমাদের নতুন ফোনে তাঁর ছবি তুলেছিলাম| এটাই হলো তাঁর সেই ছবি| তারপর তিনি আর কোনো দিন ফিরে আসেন নি| গোয়েন্দা, পুলিশ, কেউই তাঁর খোঁজ পাই নি| সকলে মনে করে তিনি মৃত| এই শুনে দয়ানন্দের শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে গেলো এক ঠান্ডা স্রোত| ভয় পেয়েছে সে খুবই| যাইহোক, সে নিজের অসম্পূর্ণ কার্য সমাপ্ত করলো, সুটকেসটি ফেরত দিয়ে| খুশি হয়ে, মহিলাটি, দয়ানন্দকে, যাওয়ার সময়ে সুটকেস থেকে এক বান্ডিল টাকা বের করে, তাকে, তা, তার সততার জন্য পুরস্কার হিসাবে দিলেন| তা নিয়ে দয়ানন্দ হাসি মুখে বিদায় জানিয়ে সস্থানে প্রস্থান করলো| কিন্তু মাঝে এই ঘটনা তাকে কেবলই ভাবাতে থাকে,"তাঁকে আগে যেন কোথায় দেখেছিলাম? তিনি কি মারা যান নি? তিনি বেঁচে আছেন?"

একদিন, বাড়িতে, আলমারির জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে, সে হঠাৎই পেল একটা ডায়রি| প্রথম পাতা খুলে দেখলো যে সেটা তার পিতার| আগ্রহী হয়ে, সে তাঁর ডায়রির পাতা নেড়ে চেড়ে, তাঁর দুঃখ-হাসিতে ভরা জীবনকথা পড়তে আরম্ভ করলো| তা পড়ে সে জানতে পারল যে তার পিতামহও ছিলেন একজন ট্যাক্সি চালক এবং তার পিতা ছিলেন একজন সিকিউরিটি গার্ড| তিনি ছিলেন সেই সময়কার দুর্নীতিবাজ এক নেতার সিকিউরিটি গার্ড| কোন কোন মামলাই না দায়ের করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে| গরু পাচার, শিশু পাচার, বেআইনি ড্রাগ ব্যবসা, চাকরি বিক্রি, ভোট কেনা, মানব হত্যা, ধর্ষণ, ঘুষ- কী কী না করেছে সে| হঠাৎই দয়ানন্দের মনে পড়লো যে একবার তার পিতা-পিতামহ বেড়িয়েছিলেন সেই নেতার পুত্রকে কোথাও একটা পৌঁছে দিয়ে আস্তে| কিন্তু তারপর তাঁরা আর কোনো দিনও ফিরে আসেননি| কয়েকদিন পর খবর আসে যে কেউ সেই নেতা-পুত্রকে মারবার জন্য গাড়িতে বোমা ফিট করেছিল| সেই বোমা ফেটে মারা গিয়েছিলেন তাঁরা| কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় সেই নেতা-পুত্র| তারপর থেকে সে আর তাদের ব্যাপারে কিছুই জানে না| তবে মাঝে একবার সে খবরের কাগজে সেই নেতা-পুত্রের ছবি দেখেছিল| সেই ছবিটা তার মাথায় ভেসে উঠতেই তার হৃত্স্পন্দন যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেলো| সেই নেতা-পুত্রটি ছিলো সেই লোকটি, তার শেষ যাত্রীটি, যার ছবি সে সেই চেক বইয়ে দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে দেখেছিলো|

দেখতে দেখতে কেটে গেছে ১ বছর| আবার সেই রাত| আবারও সেই শেষ যাত্রী| এবারও সে ভয় পেয়েছে ভীষণ| প্রথমে সে পুলিশের কাছে যাবে ভেবেও, ভয়ে যেতে পারলো না| কিছু বলতেও বা জিজ্ঞাসাও করতে পারলো না সেই যাত্রীকে| সে তার ইষ্টদেবতার নাম নিতে নিতে, পৌঁছে দিলো সেই যাত্রীকে, তার গন্তব্যস্থলে| এবার আর একটা নয়, সে রেখে গেছে দু-দুটো সুটকেস, তার উপরে আবারও একটা চিঠি-

 "প্রিয় দয়ানন্দ,

আশা করি এতো দিনে হয়তো তোমার সেই বিখ্যাত দুর্নীতিবাজ নেতার কথা মনে পড়েছে| থাক, নাম লিখে আর সময় নষ্ট করলাম না| তবে তার সেই সব দুর্নীতি ও তোমার পিতা-পিতামহের মৃত্যুর জন্য আমি তাঁর হয়ে, তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী| তবে আমি তোমার সততা আর সাহস দেখে অত্যন্ত খুশি হয়েছি| তাই আর ১টা নয়, রেখে গেলাম দু-দুটো সুটকেস শুধু মাত্র তোমার জন্য|

ইতি----

তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী"


Rate this content
Log in

More bengali story from Sagnik Chakraborty

Similar bengali story from Tragedy