শেষ গন্তব্য
শেষ গন্তব্য
সেদিন ছিলো কোজাগরী পূর্ণিমা। ফাল্গুনীর সাথে প্রথম দেখা হলো রাজেশের, ফেসবুকে আলাপের ঠিক ছ'মাস পরে। প্রথম আলাপের জড়তা কাটতে কয়েকটা দিন গেলো। এরপর কত আলাপ আর কত প্রলাপ তার আর হিসেব রইলো না। ততদিনে ফেসবুক ও মেসেঞ্জার ছাড়িয়ে ব্যক্তিগত ফোন নাম্বার আদান প্রদান, আর হোয়াটসঅ্যাপে রাতদিন টুকটুক করে মেসেজ চালাচালি। ছেলেমানুষীর হাজার কথার ফুলঝুরি, ভালোবাসাবাসি আর প্রতিশ্রুতির ফোয়ারা। ফাল্গুনীর বুকের রক্তে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ঢেউ ওঠে। বয়সের তোয়াক্কা নেই মোটে। তবে মাঝে মাঝেই ফাল্গুনী যত বলে রাজেশকে, "আরে আমি যে বয়সে অনেকটাই বড় রে তোর থেকে!" রাজেশ কী আর তা শোনে? এই কথার পরে বেড়ে যায় তার সারাদিনের বকবকানি আরো। কত খেয়াল তার। আর ফাল্গুনীও এই ঢলে যাওয়া শেষ প্রহরের অবশিষ্ট আলোর মতো যৌবনের স্তিমিত ছটা নিয়ে কেমন যেন হিপনোটাইজড্ হয়ে যেতেই থাকলো। সম্পূর্ণ সম্মোহিত। রাজেশের আবদারে তাই দেখা করার সম্মতি দিয়েই দিলো ফাল্গুনী।
উপহার নিয়ে প্রথম দেখা। রাজেশ এনেছে একগোছা রক্তগোলাপ। টকটকে উজ্জ্বল লাল রং, মিঠে মোহময় সুগন্ধ। এসপ্ল্যানেড মেট্রো স্টেশনের সামনে সাক্ষাৎ হয়েছিলো। কয়েকঘন্টা ওরা এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালো। তারপর দু'জনে একসাথে লাঞ্চ করলো প্রথমবার, সম্পন্ন এক নামী রেস্তোরাঁয়। সেই কোজাগরী পূর্ণিমাতেই। এরপর ওরা দু'জনেই কেমন একটা দেখা করার নেশায় মেতে উঠলো। চল্লিশোর্দ্ধ ফাল্গুনী সত্যিই বয়স ভুলেছিলো, ভুলেছিলো নিজের সামাজিক অবস্থান। রাজেশের ভালোবাসার আশ্বাসে ভুলেই গেলো ফাল্গুনী নিজেকে। ফাল্গুনী ভুলে গেলো হয়তো ঐ বয়সে ওকে মোটেই মানায় না প্রেমের এই উচ্ছ্বাস। আসলে জীবনে তো সুখ নামক অনুভূতির নরম তুলতুলে পায়রাটা ফাল্গুনীর অধরাই ছিলো। অনেককাল আগেই খুইয়ে বসেছিলো ও যথাসর্বস্ব। কিন্তু রাজেশ এলো আবার ফাল্গুনীর জীবনে। সেই হারিয়ে যাওয়া সুখের চাবিকাঠিটা নিয়ে, যেন এক দেবদূতের মতো! ফাল্গুনীর তাই মনে হতো। এক
অসম্ভব তীব্র টান অনুভব করতো রাজেশের প্রতি। রাজেশ ডাকলে ফাল্গুনী না গিয়ে কিছুতেই থাকতে পারতো না।
ফাল্গুনী শুরু করলো আবার নতুন সাজে নিজেকে সুন্দর করে সাজাতে। মাসকয়েক এভাবেই চললো। এখানে ওখানে যাওয়া, ঘোরা বেড়ানো, সিনেমা থিয়েটার, রেস্তোরাঁয় খাওয়া, শপিং করা... বেশ চলছিলো। কিন্তু তারপর আচমকাই বৃষ্টি একদিন। রাজেশ বাইরে বাইরে বৃষ্টিতে ঘুরে বেড়াতে চাইলো না কিছুতেই। অগত্যা সেদিন রাজেশ এলো ফাল্গুনীর ফ্ল্যাটে। ফাঁকা ঘরে সেদিন রাজেশ শুনলো না ফাল্গুনীর কথা, মানলো না কোনো বাধা। রাজেশ সবলে টেনে নিলো ফাল্গুনীকে। বলতে লাগলো, "তুমি সবসময় কেন এমন এতো দূরে দূরে থাকতে চাও? আমার অনেক কাছাকাছি আসো না কেন? আমাকে একটু আদর করো না কেন? কি হলো, তুমি চুপ করে আছো কেন? এসো আমায় আদর করো, খুব আদর করো।" ফাল্গুনীর সব প্রতিরোধ ভেঙে পড়লো, এলোমেলো হয়ে গেলো ফাল্গুনীর মন। পারলো না আর কিছুতেই নিজেকে ধরে রাখতে। ভেসে গেলো। ফাল্গুনীকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিলো রাজেশ।
তারপর একসময় বৃষ্টি থামতে রাজেশ ফিরে গেলো। আর ফাল্গুনী একলা ঘরে বসে ভাবতে লাগলো, "এ কী হলো?" কান্নায় ভেঙে পড়লো ফাল্গুনী। তৃষ্ণার্ত - ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো রক্তের স্বাদ পেয়েছিলো ফাল্গুনী। শরীরী ভালোবাসার স্বাদ পেয়েছিলো অনেককাল পরে। তাই বারবার রাজেশের গভীর চুম্বনে আর উদ্দাম আদরে নিজেকে সমর্পণ না করে পারে নি ফাল্গুনী। এরপর থেকে ওরা আর বাইরে ঘোরাঘুরি করতো না। রাজেশ আসতো ফাল্গুনীর ফ্ল্যাটেই। যখন রাজেশ চলে যেতো অসহায়ের মতো ফাল্গুনী কাঁদতো। তারপর প্রতীক্ষা করতো আবার একটা দিনের জন্য, রাজেশের আসার, ওর উপস্থিতি আর স্পর্শের। এভাবেই কেটে গেলো আরো ছ'টা মাস। ফাল্গুনী তখন ভালোবাসায় পাগল এক সদ্য তরুণী যেন! আর রাজেশ যেন তখন ফাল্গুনীর এক অভিভাবক পুরুষ হয়ে উঠলো। কাটলো আরো ছ'টা মাস। রাজেশের আসা যাওয়া কমতে শুরু করেছে। ফাল্গুনী বোঝে তার প্রতি টান কমেছে রাজেশের। তার কথাবার্তায় ফাল্গুনীর মনে হলো ঐ ঘোরাফেরা, ঐ চুম্বন, ঐ ভালোবাসাবাসি আদরে তার আর ঠিক মন ভরছে না। কিন্তু ফাল্গুনী তো এর থেকে বেশী আর কিছু দিতে পারবে না রাজেশকে। তবে রাজেশ অবশ্য বোঝে না তা।
নর-নারীর এক ছাদের তলায় রাত কাটানোর নাম যদি সংসার বা সহবাস হয়, তবে সে সংসারের সুখ ফাল্গুনীর জন্য নয়। তা ফাল্গুনী বুঝিয়ে দিয়েছিলো রাজেশকে। তাই হয়তো কমতে থাকলো তার ফোন, তার হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ, তার দেখা করা, তার ভালোবাসা... সবকিছু। শুধু বাড়াবাড়ি রকমে বাড়তে থাকলো রাজেশের হাজার একটা অজুহাত, না আসার, না দেখা করার। আবার শুরু হলো ফাল্গুনীর কষ্ট। দুঃখে কষ্টে কষ্টে এতোকাল কাটিয়ে দেওয়া ফাল্গুনী এই সামান্য সম্পর্কের সুতোটায় হ্যাঁচকা টান পড়তেই ভেঙে পড়লো, দ্বিতীয়বার। সব সম্পর্ক শেষ করতে চাইলো রাজেশ। যেমন করেই হোক রাজেশ মরিয়া হয়ে উঠেছিলো এই সম্পর্কে ইতি টানতে। শেষ পর্যন্ত টানলোও। রাজেশ আর কোথাও নেই, ফাল্গুনীর জীবনে। হারিয়ে গেলো আবার ফাল্গুনীর ভালোবাসা। এই সংসারে বলতে পারবে কেউ, কেন এমন হয় বারবার ফাল্গুনীর সাথেই? কেন এমন হয় বারবার? কেন ভালোবাসার ছলনায় ফাল্গুনীর মতো ভালোবাসার কাঙালীদের ঠকিয়ে চলেছে রাজেশরা?
ফাল্গুনীর জীবনের এই চরম বাস্তব গল্পের চেয়ে কম নয়। ফাল্গুনীর বিয়ে হয়েছিলো এক বসন্ত পঞ্চমীতে, মাত্র সতেরো বছর বয়সে। নিজের দ্বিগুণ বয়সের এক পুরুষের সাথে। উনিশ বছর না পুরতেই ফাল্গুনী মা হয়েছিলো, পুত্রসন্তানের মা। তারপর ফাল্গুনীর মনে স্বামীর ভালোবাসার প্রতি রং ধরতে যখন সবে শুরু করেছিলো, ঠিক তখনই ফাল্গুনীর স্বামী হারিয়ে গেলো চিরতরে, মৃত্যুর জমাট অন্ধকারে। সেও ভাগ্যের এক চরম পরিহাস। যে স্বামীকে সে ভালোবেসে আঁকড়ে ধরতে চাইছিলো... সেই স্বামীই কিনা নিজের বিয়ের আগেকার প্রেমিকাকে নিয়ে বাড়িতে লুকিয়ে মন্দারমণি ঘুরতে গিয়েছিলো, আর ফেরার পথে গাড়ির অ্যাক্সিডেন্টে সপ্রেমিকা প্রাণ হারালো। এক নিষ্ঠুর নিয়তির খেলা!
তারপর ছেলেকে বুকে আঁকড়ে চলেছিলো বেশ। যখন ফাল্গুনীর তেতাল্লিশ, ফাল্গুনীর চব্বিশ বছরের ছেলে তখন নতুন চাকরি আর নতুন বৌ নিয়ে দেশান্তরী হয়েছে। একলা পড়েছিলো ফাল্গুনী, রুক্ষ শুষ্ক নিষ্পত্র গাছের মতো। সেইসময় রাজেশ এসে ফাল্গুনীর জীবনে ঝড় তুলে দিয়েছিলো। সেই ঝড়ের দাপটে প্রথমে উত্তাল, আর তারপর ফাল্গুনী ভেঙে চুরে একসা। মুখ থুবড়ে পড়েছে। বেঁচে থাকার আশাটুকু পর্যন্ত জলাঞ্জলি দিয়েছে গভীর অবসাদ আর গ্লানিতে। ফাল্গুনী বড়ো কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। রাজেশের চলে যাওয়া কী ফাল্গুনীকে সত্যি সত্যিই নিঃশেষিত করে দিয়ে গেলো? ফাল্গুনী আর পরের সকালটা দেখতে চাইলো না... তবে এই কলকাতা শহরের সকাল। ফাল্গুনী একটা ছোট ব্যাগে নিজের প্রয়োজনীয় সামান্য কিছু জিনিসপত্র নিয়ে চেপে বসলো হরিদ্বারগামী ট্রেনে।
হেরে যাওয়া মানা, এই কথাটা ফাল্গুনী একমাত্র ছেলের ফোন পাওয়ার পরেই ঠিক করেছিলো। নিজেকে বিলিয়ে দিতে চলেছে ফাল্গুনী আবার, তবে এবার এক আশ্রমের কাজ নিয়ে, নতুনভাবে বাঁচার মন্ত্র দীক্ষা নিয়ে। ট্রেন চলতে শুরু করার পরে ফাল্গুনীর মনটা ভারী হালকা লাগছে। ভাবলো, "আরো অনেক আগেই যাওয়া উচিৎ ছিলো, তা না ফালতু বেকার সময় নষ্ট করে ফেললাম।" সারাটা পথ কতকিছু ভাবতে ভাবতেই গন্তব্যে পৌঁছে গেলো ফাল্গুনী। দূরে রেখায়িত হরিদ্বার শহর, ফাল্গুনীর শেষ গন্তব্য, ভালোবাসার কাজের ঠিকানায়।