Homo Sapiens

Tragedy Others

4.0  

Homo Sapiens

Tragedy Others

শেষ বেলার শিউলি ( শরৎকাল )

শেষ বেলার শিউলি ( শরৎকাল )

8 mins
242



"স্খলিত শিথিল কামনার ভার বহিয়া বহিয়া ফিরি কত আর—

নিজ হাতে তুমি গেঁথে নিয়াে হার, ফেলো না আমারে ছড়ায়ে। "


গুনগুন করতে করতে আরো একমুঠো শিউলি তুলে নিয়ে মালায় গেঁথে নিল নম্রতা।ধপধপে সাদা পাপড়ি ফুলগুলোর,কমলা বৃন্ত।ঠিক যেন সাদা রাজহংসীর পাখা আর ঠোঁট।নূপুরের কথা মনে পড়ে যায় ফুলগুলো দেখলেই।প্যাঁক প্যাঁক করে যখন রাজকীয় কায়দায় পুকুরে যেত,ঠিক যেন কোনো রাজকন্যা।নিজের সন্তান নেই,অথচ একটা হাঁসকে নিয়ে সোহাগ,আকাশের সহ্য হোত না।নূপুরের খোঁজ পাওয়া গেল না একদিন।পাগলের মত খুঁজেছিল নম্রতা।তার দুদিন পর বাগানে আকাশদের ফিস্টের জায়গা পরিষ্কার করতে গিয়ে কয়েকটা সাদা পালক পেয়েছিল ও,একদম শিউলির পাপড়ির মত সাদা।


" গিরি, এবার আমার উমা এলে আর উমা পাঠাব না বলে বলুক লোকে মন্দ কারোর কথা শুনব না।"


শেফালী হারমোনিয়াম নিয়ে গলা খুলে গাইছে।বেশ মিষ্টি গলা নিমাই কাকার মেয়েটার।পাশেই কুমোর বাড়ি,দুর্গাপুজোর মূর্তি গড়া অনেকটাই শেষ প্রায়।নিমাই পালই প্রতিবছর মূর্তি গড়েন পাড়ার পুজোর।একটু আধটু রং,চক্ষুদান আর চালচিত্রের কিছু কাজ বাকি।নম্রতা কান পাতল শেফালির গানে, পিলু বাহারী রাগিণী।চোখটা হালকা ভিজে এলো নম্রতার,ওর মনে হলো গানটায় একটা মনখারাপি লেগে।আসলে দুর্গাপুজো এলেই ওর মনটা হুহু করে খুব।তিনবছর আগে উমা এসেছিল ওর কাছে।আনন্দের খবরটা জানতে পারেনি কেউ,শুধু জেনেছিল নম্রতা,আকাশ,আকাশের মা আর ক্লিনিকের সেই ডক্টর। ষষ্ঠীর দিন ওর চিন্ময়ী উমাকে বোধনের আগেই বিসর্জন দিয়েছিল ওরা।

অষ্টমীর দিন মৃন্ময়ী উমার কাছে অঞ্জলী দিয়ে প্রার্থনা করেছিল,প্রতিবারের মতই

" ধনং দেহি পুত্রান্ দেহি সর্ব কামাংশ্চ দেহি মে-"

এবারেও করতে হবে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে মালা গাঁথা ছেড়ে উঠানে বেরিয়ে এলো নম্রতা।মাথার উপর শরৎসুন্দরীর নরম আসমানী নীল আঁচল,মেঘের জরি বসানো।নদীর পাড় কাশে কাশে সাদা।একটুকরো খুশির মত ঝলমলে রোদ। সবাই ভাবছে, উমা আসছে।


ভালো লাগলো না,আবার বাড়ির মধ্যে চলে এলো নম্রতা।ঘরে প্রবেশ করতে গিয়ে থমকে গেল,আকাশ কখন এলো!এলাকায় বেশ প্রতিপত্তি আছে আকাশের,দলের কাজে অর্ধেক সময় বাড়ির বাইরে থাকে।আবার কখন আসে ঠিক থাকে না।ফোনে কথা বলছে এখন।নম্রতাকে দেখতে পেয়ে ফোনটা নামিয়ে ' রাখছি ' বলে কেটে দিল।নম্রতার হাত ধরে সামনে টেনে এনে গলায় মুখ ডোবালো।অসহ্য লাগে নম্রতার,কিন্তু কিছু বলতে পারে না।একবার ফোনের স্ক্রিনটায় চোখ পড়ে ওর,রাজ।কে জানে কে,আকাশ তো কারোর নামই বলেনি কোনোদিন।


রাত্রেও খাবার পরিবেশনের সময় ফোন এলো আকাশের।অসময়ে ফোন করার জন্য আকাশ তর্জন গর্জন করল খানিক,তারপর কেটে দিল ফোন।তার মাঝেই নম্রতা আরেকবার আড়চোখে দেখেই ফেললো,সেই রাজ।


সকালে ঘুম ভাঙলো কান্নার শব্দে।ঘুমভাঙা চোখে বেরিয়ে নম্রতা বুঝলো নিমাই কাকা আর আশা কাকিমার গলা।অবাক হয়ে গেলো ওদিকে,পাশাপাশি অনেকেই জমেছে তখন।আলোচনাও চলছে অনেক।সেসব আমল না দিয়ে নম্রতা এগিয়ে গিয়ে আশা কাকিমার কাছে গিয়ে বসে কাঁধে হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো," কি হয়েছে কাকীমা?"

কাকিমা দ্বিগুণ কেঁদে উঠলেন," কি বলব গো মা,আমার মেয়েটা...”

-" শেফালী?কি হয়েছে শেফালীর?কোথায় ও?"

-" সে কি আর আছে গো,কে আমার মেয়েটাকে নিয়ে গেছে ভুলিয়ে, ও যে সরল বড্ড,কিছু বোঝে না এখনও।এখন কোথায় খুঁজব ওকে..."

-" কারোর সাথে গেছে নিশ্চিত কি করে হলে?"

নিমাই পাল কপাল চাপড়ে বললেন," এই যে চিঠি লিখে গেছে পোড়ারমুখী,বলে গেছে খুঁজো না আমায়,আমি কি করব বলো তো মা!"

-" আচ্ছা চিঠিটা একবার দেখতে পারি?"

-" হ্যাঁ এই যে নাও।"


চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে পড়তে এক জায়গায় এসে ভ্রূ কুঁচকে উঠলো নম্রতার।সে চিঠিটা ফেরত দিয়ে সাধারণ ভাবে কিছুক্ষণ সান্ত্বনা দিয়ে চলে এলো।

আকাশ কাল থেকে বাড়িতেই আছে,নম্রতা ফিরতেই জিজ্ঞাসা করল," কোথায় গিয়েছিলে?"

নম্রতা উদাসীন ভাবে বললো," নিমাই কাকাদের বাড়ি।"

-" ওহ আচ্ছা,ওই শেফালী।প্রেমের ব্যাপারস্যাপার,ওসব নিয়ে মাথা ঘামিও না।"

-" হুমম সেটাই।"


রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর আকাশ পাশের ঘরে শুতে চলে গেল।শাশুড়ির মৃত্যুর পর থেকে ওই ঘরটা ফাঁকা থাকে,আকাশ মাঝে মাঝেই ওই ঘরে শোয়,তাই প্রশ্ন করে না নম্রতা।অবশ্য আকাশের কোনো বিষয়েই প্রশ্ন করা নিষেধ ওর।

সাড়ে বারোটা নাগাদ নড়াচড়ার আভাস পেল নম্রতা।খুব সন্তর্পণে উঁকি দিয়ে দেখল আকাশ বেরিয়ে যাচ্ছে পিছনের দরজা দিয়ে।নম্রতা তৈরিই ছিল,আকাশ বেরিয়ে যাবার পরেই সেও বেরিয়ে পড়লো।আকাশ ওর ব্ল্যাক অল্টোতে স্টার্ট দিয়ে মসৃণ পিচ ধরে ছুটলো।জানতেও পারলো না পিঙ্ক স্কুটিটা সাবধানে পিছু নিয়েছে ওর।


একটা পুরনো কারখানার সামনে গাড়ি থামালো আকাশ।নম্রতা একটু দূরে থামলো।স্কুটিটাকে একটা গাছের আড়ালে রেখে নজর করতে লাগলো সব।পাশেই আরেকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে।আকাশ কারখানার ভিতরে গেল,কিছুক্ষণ পরেই দুজন লোক একটা বস্তায় করে কিছু এনে গাড়ির ডিকিতে ভরে দিল। তারপর ওরা আবার কারখানার ভিতরে গেল,হয়তো কিছু আনতে।নম্রতা দেখলো কাজটা রিস্কি,কিন্তু এটাই সুযোগ।ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে ডিকির ডালা তুলে দ্রুত হাতে বস্তার বাঁধন খুলে ফেললো ও।যা আন্দাজ করেছে ঠিক তাই, হাত পা মুখ বাঁধা অবস্থায় শেফালী!


ভোর ভোর উঠে চা বানাচ্ছিল নম্রতা, বেড টি ছাড়া ঘুম ভাঙ্গে না আকাশের।চা কাপে ঢেলে একটা ছোট্ট কাচের শিশি বার করলো সে।আজকের সকালটা অন্যরকম,কালকের মত কান্নাভরা নয়।সেই কান্না শুনেই তো নিমাই কাকার বাড়িতে গিয়েছিল নম্রতা,তারপর চিঠিতে রাজের নাম,আর তারপর রাত্রে সবটা নিজের চোখে...

এক ফোঁটা এক ফোঁটা করে শিশির তরলটা চায়ে মেশাচ্ছে নম্রতা,শেফালিকে কাল বাড়ির দরজায় নামিয়ে দেবার সময় কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল," ভুল চিনেছিলাম রাজকে,খুব বড় ভুল করেছিলাম।তুমি মা দুর্গার মত এসে বাঁচালে।না জানি আরো কত মেয়েকে ওরা...ওদের কি কোনোদিনও শাস্তি হবে না?"

কঠিন কণ্ঠে বলেছিল নম্রতা," নিশ্চয়ই হবে!"

-"কি করে হবে বৌদি?পুলিশ প্রশাসন সব ওদের হাতের মুঠোয়,কি করে শাস্তি হবে?আর দাদা ওদের প্রধান!"

-" হবে।তুই এত ভাবিস না,তাড়াতাড়ি ঘরে যা।"


হবে,শাস্তি হবে,শেফালী,নুপুর,তার অনাগত উমা,আরো কত মেয়ে,সবাই শাস্তি দেবে,নম্রতা দেবে ওদের হয়ে....


আকাশের সামনে চায়ের প্লেট দেবার সময় আকাশকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল খুব। রাস্তায় সন্দেহ হতে নেমে দেখেছে মেয়েটা নেই ডিকিতে,কি করে পালালো কে জানে!মুখ খোলার আগেই লোপাট করতে হবে!আনমনে চায়ে চুমুক দিল আকাশ।


পুলিশ এসে দেখলো মেঝেতে নিষ্প্রাণ পড়ে আকাশ,মুখের একপাশ দিয়ে সাদা গ্যাঁজলা বেরিয়ে এসেছে।ঘরে টি টেবিলে চায়ের কাপ রাখা।নম্রতাকে খুঁজতে খুঁজতে বাগানে এসে দেখা গেল শিউলি গাছের নিচে শিশিরভেজা সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে সে,ঠিক যেন ঘুমোচ্ছে,শিউলিফুলের চাদর শরীরে। ঠোঁটের পাশে একটুখানি সাদা ফেনা,ঠিক শিউলির পাপড়ির মত সাদা।আকাশ তখন নীলে নীল।


শেফালী গাইছিল,

"চিরপিপাসিত বাসনা বেদনা বাঁচাও তাহারে মারিয়া।

শেষ জয়ে যেন হয় সে বিজয়ী তোমারি কাছেতে হারিয়া।"


নিমাই পাল দেবীর চোখে শেষ তুলির টানটা দিয়ে দিলেন।শেষ বেলার শিউলি

*******************

"স্খলিত শিথিল কামনার ভার বহিয়া বহিয়া ফিরি কত আর—

নিজ হাতে তুমি গেঁথে নিয়াে হার, ফেলো না আমারে ছড়ায়ে। "


গুনগুন করতে করতে আরো একমুঠো শিউলি তুলে নিয়ে মালায় গেঁথে নিল নম্রতা।ধপধপে সাদা পাপড়ি ফুলগুলোর,কমলা বৃন্ত।ঠিক যেন সাদা রাজহংসীর পাখা আর ঠোঁট।নূপুরের কথা মনে পড়ে যায় ফুলগুলো দেখলেই।প্যাঁক প্যাঁক করে যখন রাজকীয় কায়দায় পুকুরে যেত,ঠিক যেন কোনো রাজকন্যা।নিজের সন্তান নেই,অথচ একটা হাঁসকে নিয়ে সোহাগ,আকাশের সহ্য হোত না।নূপুরের খোঁজ পাওয়া গেল না একদিন।পাগলের মত খুঁজেছিল নম্রতা।তার দুদিন পর বাগানে আকাশদের ফিস্টের জায়গা পরিষ্কার করতে গিয়ে কয়েকটা সাদা পালক পেয়েছিল ও,একদম শিউলির পাপড়ির মত সাদা।


" গিরি, এবার আমার উমা এলে আর উমা পাঠাব না

 বলে বলুক লোকে মন্দ কারোর কথা শুনব না।"


শেফালী হারমোনিয়াম নিয়ে গলা খুলে গাইছে।বেশ মিষ্টি গলা নিমাই কাকার মেয়েটার।পাশেই কুমোর বাড়ি,দুর্গাপুজোর মূর্তি গড়া অনেকটাই শেষ প্রায়।নিমাই পালই প্রতিবছর মূর্তি গড়েন পাড়ার পুজোর।একটু আধটু রং,চক্ষুদান আর চালচিত্রের কিছু কাজ বাকি।নম্রতা কান পাতল শেফালির গানে, পিলু বাহারী রাগিণী।চোখটা হালকা ভিজে এলো নম্রতার,ওর মনে হলো গানটায় একটা মনখারাপি লেগে।আসলে দুর্গাপুজো এলেই ওর মনটা হুহু করে খুব।তিনবছর আগে উমা এসেছিল ওর কাছে।আনন্দের খবরটা জানতে পারেনি কেউ,শুধু জেনেছিল নম্রতা,আকাশ,আকাশের মা আর ক্লিনিকের সেই ডক্টর। ষষ্ঠীর দিন ওর চিন্ময়ী উমাকে বোধনের আগেই বিসর্জন দিয়েছিল ওরা।

অষ্টমীর দিন মৃন্ময়ী উমার কাছে অঞ্জলী দিয়ে প্রার্থনা করেছিল,প্রতিবারের মতই

" ধনং দেহি পুত্রান্ দেহি সর্ব কামাংশ্চ দেহি মে-"

এবারেও করতে হবে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে মালা গাঁথা ছেড়ে উঠানে বেরিয়ে এলো নম্রতা।মাথার উপর শরৎসুন্দরীর নরম আসমানী নীল আঁচল,মেঘের জরি বসানো।নদীর পাড় কাশে কাশে সাদা।একটুকরো খুশির মত ঝলমলে রোদ। সবাই ভাবছে, উমা আসছে।


ভালো লাগলো না,আবার বাড়ির মধ্যে চলে এলো নম্রতা।ঘরে প্রবেশ করতে গিয়ে থমকে গেল,আকাশ কখন এলো!এলাকায় বেশ প্রতিপত্তি আছে আকাশের,দলের কাজে অর্ধেক সময় বাড়ির বাইরে থাকে।আবার কখন আসে ঠিক থাকে না।ফোনে কথা বলছে এখন।নম্রতাকে দেখতে পেয়ে ফোনটা নামিয়ে ' রাখছি ' বলে কেটে দিল।নম্রতার হাত ধরে সামনে টেনে এনে গলায় মুখ ডোবালো।অসহ্য লাগে নম্রতার,কিন্তু কিছু বলতে পারে না।একবার ফোনের স্ক্রিনটায় চোখ পড়ে ওর,রাজ।কে জানে কে,আকাশ তো কারোর নামই বলেনি কোনোদিন।


রাত্রেও খাবার পরিবেশনের সময় ফোন এলো আকাশের।অসময়ে ফোন করার জন্য আকাশ তর্জন গর্জন করল খানিক,তারপর কেটে দিল ফোন।তার মাঝেই নম্রতা আরেকবার আড়চোখে দেখেই ফেললো,সেই রাজ।


সকালে ঘুম ভাঙলো কান্নার শব্দে।ঘুমভাঙা চোখে বেরিয়ে নম্রতা বুঝলো নিমাই কাকা আর আশা কাকিমার গলা।অবাক হয়ে গেলো ওদিকে,পাশাপাশি অনেকেই জমেছে তখন।আলোচনাও চলছে অনেক।সেসব আমল না দিয়ে নম্রতা এগিয়ে গিয়ে আশা কাকিমার কাছে গিয়ে বসে কাঁধে হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো," কি হয়েছে কাকীমা?"

কাকিমা দ্বিগুণ কেঁদে উঠলেন," কি বলব গো মা,আমার মেয়েটা...”

-" শেফালী?কি হয়েছে শেফালীর?কোথায় ও?"

-" সে কি আর আছে গো,কে আমার মেয়েটাকে নিয়ে গেছে ভুলিয়ে, ও যে সরল বড্ড,কিছু বোঝে না এখনও।এখন কোথায় খুঁজব ওকে..."

-" কারোর সাথে গেছে নিশ্চিত কি করে হলে?"

নিমাই পাল কপাল চাপড়ে বললেন," এই যে চিঠি লিখে গেছে পোড়ারমুখী,বলে গেছে খুঁজো না আমায়,আমি কি করব বলো তো মা!"

-" আচ্ছা চিঠিটা একবার দেখতে পারি?"

-" হ্যাঁ এই যে নাও।"


চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে পড়তে এক জায়গায় এসে ভ্রূ কুঁচকে উঠলো নম্রতার।সে চিঠিটা ফেরত দিয়ে সাধারণ ভাবে কিছুক্ষণ সান্ত্বনা দিয়ে চলে এলো।

আকাশ কাল থেকে বাড়িতেই আছে,নম্রতা ফিরতেই জিজ্ঞাসা করল," কোথায় গিয়েছিলে?"

নম্রতা উদাসীন ভাবে বললো," নিমাই কাকাদের বাড়ি।"

-" ওহ আচ্ছা,ওই শেফালী।প্রেমের ব্যাপারস্যাপার,ওসব নিয়ে মাথা ঘামিও না।"

-" হুমম সেটাই।"


রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর আকাশ পাশের ঘরে শুতে চলে গেল।শাশুড়ির মৃত্যুর পর থেকে ওই ঘরটা ফাঁকা থাকে,আকাশ মাঝে মাঝেই ওই ঘরে শোয়,তাই প্রশ্ন করে না নম্রতা।অবশ্য আকাশের কোনো বিষয়েই প্রশ্ন করা নিষেধ ওর।

সাড়ে বারোটা নাগাদ নড়াচড়ার আভাস পেল নম্রতা।খুব সন্তর্পণে উঁকি দিয়ে দেখল আকাশ বেরিয়ে যাচ্ছে পিছনের দরজা দিয়ে।নম্রতা তৈরিই ছিল,আকাশ বেরিয়ে যাবার পরেই সেও বেরিয়ে পড়লো।আকাশ ওর ব্ল্যাক অল্টোতে স্টার্ট দিয়ে মসৃণ পিচ ধরে ছুটলো।জানতেও পারলো না পিঙ্ক স্কুটিটা সাবধানে পিছু নিয়েছে ওর।


একটা পুরনো কারখানার সামনে গাড়ি থামালো আকাশ।নম্রতা একটু দূরে থামলো।স্কুটিটাকে একটা গাছের আড়ালে রেখে নজর করতে লাগলো সব।পাশেই আরেকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে।আকাশ কারখানার ভিতরে গেল,কিছুক্ষণ পরেই দুজন লোক একটা বস্তায় করে কিছু এনে গাড়ির ডিকিতে ভরে দিল। তারপর ওরা আবার কারখানার ভিতরে গেল,হয়তো কিছু আনতে।নম্রতা দেখলো কাজটা রিস্কি,কিন্তু এটাই সুযোগ।ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে ডিকির ডালা তুলে দ্রুত হাতে বস্তার বাঁধন খুলে ফেললো ও।যা আন্দাজ করেছে ঠিক তাই, হাত পা মুখ বাঁধা অবস্থায় শেফালী!


ভোর ভোর উঠে চা বানাচ্ছিল নম্রতা, বেড টি ছাড়া ঘুম ভাঙ্গে না আকাশের।চা কাপে ঢেলে একটা ছোট্ট কাচের শিশি বার করলো সে।আজকের সকালটা অন্যরকম,কালকের মত কান্নাভরা নয়।সেই কান্না শুনেই তো নিমাই কাকার বাড়িতে গিয়েছিল নম্রতা,তারপর চিঠিতে রাজের নাম,আর তারপর রাত্রে সবটা নিজের চোখে...

এক ফোঁটা এক ফোঁটা করে শিশির তরলটা চায়ে মেশাচ্ছে নম্রতা,শেফালিকে কাল বাড়ির দরজায় নামিয়ে দেবার সময় কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল," ভুল চিনেছিলাম রাজকে,খুব বড় ভুল করেছিলাম।তুমি মা দুর্গার মত এসে বাঁচালে।না জানি আরো কত মেয়েকে ওরা...ওদের কি কোনোদিনও শাস্তি হবে না?"

কঠিন কণ্ঠে বলেছিল নম্রতা," নিশ্চয়ই হবে!"

-"কি করে হবে বৌদি?পুলিশ প্রশাসন সব ওদের হাতের মুঠোয়,কি করে শাস্তি হবে?আর দাদা ওদের প্রধান!"

-" হবে।তুই এত ভাবিস না,তাড়াতাড়ি ঘরে যা।"


হবে,শাস্তি হবে,শেফালী,নুপুর,তার অনাগত উমা,আরো কত মেয়ে,সবাই শাস্তি দেবে,নম্রতা দেবে ওদের হয়ে....


আকাশের সামনে চায়ের প্লেট দেবার সময় আকাশকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল খুব। রাস্তায় সন্দেহ হতে নেমে দেখেছে মেয়েটা নেই ডিকিতে,কি করে পালালো কে জানে!মুখ খোলার আগেই লোপাট করতে হবে!আনমনে চায়ে চুমুক দিল আকাশ।


পুলিশ এসে দেখলো মেঝেতে নিষ্প্রাণ পড়ে আকাশ,মুখের একপাশ দিয়ে সাদা গ্যাঁজলা বেরিয়ে এসেছে।ঘরে টি টেবিলে চায়ের কাপ রাখা।নম্রতাকে খুঁজতে খুঁজতে বাগানে এসে দেখা গেল শিউলি গাছের নিচে শিশিরভেজা সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে সে,ঠিক যেন ঘুমোচ্ছে,শিউলিফুলের চাদর শরীরে। ঠোঁটের পাশে একটুখানি সাদা ফেনা,ঠিক শিউলির পাপড়ির মত সাদা।আকাশ তখন নীলে নীল।


শেফালী তখন গাইছিল,

"চিরপিপাসিত বাসনা বেদনা বাঁচাও তাহারে মারিয়া।

শেষ জয়ে যেন হয় সে বিজয়ী তোমারি কাছেতে হারিয়া।"


নিমাই পাল দেবীর চোখে শেষ তুলির টানটা দিয়ে দিলেন।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy