শ্বাসকষ্ট যখন জীবনের রাশ ধরে টানে
শ্বাসকষ্ট যখন জীবনের রাশ ধরে টানে
ধুক পুক।
ধুক পুক।
ধুক পুক।
ধুক পুক।
ধুক পুক।
কি হলো —
অনুভব করতে পারছেন ?
— আপনার হৃদস্পন্দন
আপনি যে বেঁচে আছেন তার নিরবধি ঘন্টাধ্বনি।
— ঠিক যেমন ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে চলছে বিরামহীন গতিতে তেমনি আমাদের প্রাণের স্পন্দন ; সময়ের অমূল্যতা বুঝিয়ে দিচ্ছে পলে পলে। অবিরাম এই নাড়ীর গতি — বিশালাকার এই রক্ত মাংসের শরীরের মধ্যে প্রাণের সজীবতার নির্দেশক।
যদি কোন এক মুহুর্তে স্তব্ধ হয়ে যায় এই বুকের ধুকপুকুনিটুকু। যদি আর অনুভব না করা যায় নাড়ীর রাব্ ডাব্ স্পন্দনটুকু। তবে কী ? — কি আবার! তখনই জীবনের ইতি! মৃত্যু পরলোকের নিমন্ত্রণ নিয়ে হাজির জীবনের দোরগোড়ায়।
— একি আপনি ঠিক আছেন তো ?
আপনি কি ঘামছেন ?
আপনার বুকের ভিতর নিয়মিত স্পন্দনের কোন ছন্দপতন হয়নি তো ?
আপনার কি কথা বলতে গিয়ে দম বন্ধ হবার উপক্রম হচ্ছে নাকি ?
আপনি মুখ দিয়ে শ্বাস নিচ্ছেন ?
হাঁসফাঁস করছেন ?
বুক আঁটোসাঁটো হয়ে আছে — যেন খুব শক্ত আর ব্যাথাও ?
বুকে চিনচিনে যন্ত্রণাও করছে নাকি আবার ?
কি বলছেন থুতুতে রক্তের ছিটে ?
— হায় রে বিপদ!
আচ্ছা আপনার কি দীর্ঘমেয়াদি ঠান্ডা লেগে আছে ? শ্বাসকষ্টে ভোগেন ? --- আমি ঠিক বুঝেছি আপনার ফুসফুসের সমস্যা।
বর্তমানে আমাদের ব্যবহারিক জীবনে ফুসফুসের নানা সমস্যা খুব গুরুতর উঠেছে। পরিবেশে আমাদের প্রাণবায়ু ক্রমশ দূষিত হচ্ছে ফলে নানারকম ক্ষতিকর ভাইরাস,ব্যাকটেরিয়া ও আরো নানাবিধ অদৃশ্য জীবাণু আমাদের শরীরের ভিতর ঢুকছে। নানারকম অ্যালার্জী সৃষ্টিকারী বস্তু ঘুরে বেড়ায় এই মুক্ত বাতাসে,যা শরীরের ভিতর প্রবেশ করে ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় এবং আমাদের জীবন দূর্বিসহ করে তোলে।
দীর্ঘদিনের ঠান্ডা লেগে থাকা, চিকিৎসায় গাফিলতি, ধূমপান, অতিরিক্ত ঘরবন্দী হয়ে থাকা, চর্বিজাতীয় খাবার বেশি পরিমাণে খাওয়া, পরিবেশ দূষণ, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, মদ্যপান, বোহেমিয়ান চালচলন ও অ্যালার্জী প্রভৃতি কারণে ফুসফুসের রোগ গুলো দেখা দেয়।
ফুসফুসের রোগ বলতে সাধারণত আমরা বুঝি "সি. ও. পি. ডি." — ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ অর্থাৎ দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের ব্যাঘাতজনিত রোগ, অ্যাজমা বা হাঁপানি ও "টি. বি." অর্থাৎ টিউবারকিউলোসিস বা যক্ষা যাকে একসময় ক্ষয় রোগও বলা হতো।
প্রথমেই বলি "সি. ও. পি. ডি"-র কথা: এটি খুবই পরিচিত একটি সমস্যা। কি গ্রাম্য কি শহুরে: একটি বৃহৎ সংখ্যক মানুষ এই রোগে ভোগেন। মূলত এর কারণ সাধারণ ঠান্ডা, পরিবেশ দূষণ, বর্তমানের চূড়ান্ত জলবায়ু, ঘরের ভিতরের দূষিত বায়ু,অ্যালার্জী, ধূমপান ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন প্রভৃতি। বিড়ি, সিগারেট,সিগার,পাইপ, চুরুট, গাঁজা এবং আরও নানা ধরনের তামাকজাত দ্রব্য সেবন এই রোগের প্রধান কারণ।
এর ফলে রোগীর ঘনঘন শুকনো কাশি হতে পারে এবং কাশির সময় শ্লেষ্মা উঠতে পারে এবং রক্তও। তবে অত্যন্ত অস্বস্তিকরভাবে খুক খুক করে কাশি দীর্ঘ সময় ধরে হয়েই যায়। মাঝেমধ্যে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়,বুকভরে শ্বাস নিতে পারে না এই ধরনের রোগীরা। অধিকাংশ সময় মুখদিয়ে শ্বাস নিতে হয় এবং তখন শিস দেওয়ার মতো আওয়াজ বের হয় মুখ দিয়ে। ডাক্তারী পরিভাষায় যাকে বলে "ব্রেদলেসনেস" । এই ধরনের রোগীরা ঠিকঠাক শুতে পারে না; অধিকাংশ সময় 'ট্রাইপড পজিশনে ' অর্থাৎ সোজা হয়ে বসে কপালে হাতের ভর দিয়ে থাকতে আরাম বোধ করে। বুকে চাপা ব্যাথা থাকে, ওজন কমে যায় এবং অবসাদ গ্রস্ত হয়ে পড়ে দিনদিন।তীব্র ও অতি তীব্র পর্যায়ের রোগীদের ফুসফুসে সংক্রমণের কারণে ঘা হয়ে যায় এবং অনেক সময় মৃত্যুও হয়ে থাকে।
"সি. ও. পি. ডি" রোগীদের চারটে পর্যায়ে ভাগ করা হয়ে থাকে সাধারণত,যথা:- মৃদু, মাঝারি, তীব্র ও অতি তীব্র পর্যায়। এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার সাথে সাথে কিছু কিছু প্রতিরক্ষা মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত,যেমন - ঈষৎ উষ্ণ তরল ও খাবার খাওয়া এবং ফুলের রেণু, ধূলোবালি, ধূমপান ইত্যাদি অ্যালার্জী সৃষ্টিকারী বস্তু থেকে দূরে থাকা উচিত। সচেতন থাকতে হবে যেন ঠান্ডা না লাগে। এছাড়াও ঘন ঘন তরল খাবার গ্রহণ করা উচিত তবে সেটা কখনোই ঠান্ডা নয়। অতিরিক্ত ভোজন বর্জন করতে হবে। তৈল জাতীয় খাবার না খাওয়াই ভালো। নিয়মিত শারীরিক কসরত করা বাঞ্ছনীয়।
যে কারণে "সি. ও. পি. ডি." হয়, সেই একই কারণে মানুষের অ্যাজমা অর্থাৎ হাঁপানিও হয়। তবে তফাৎ হলো,অ্যাজমা হলে মূলত রোগীদের তীব্র শ্বাসকষ্ট হয়,বুক শক্ত হয়ে থাকে। ক্ষুদামান্দ্য দেখা দেয়,দিন দিন ওজন কমে যায়,দূর্বল হয়ে পড়ে ক্রমশ। রাতে ও প্রাতে কাশি উঠতে পারে, বুকে তীব্র যন্ত্রণাও হয় মাঝে মধ্যে। কোন কোন ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তির তীব্র ও অতি তীব্র পর্যায়ের "সি. ও. পি. ডি." থেকে ধীরে ধীরে হাঁপানি তে পরিণত হয়। এই দু'য়ের মধ্যে পার্থক্য হলো প্রথম ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট ক্রমশ বর্ধনশীল আর হাঁপানির সময় শ্বাসকষ্ট সর্বোচ্চ মাত্রায় হয়ে থাকে। হাঁপানির ক্ষেত্রে ফুসফুসের মধ্যে অবস্থিত ব্রঙ্কাই গুলো ফুলে যায় এবং একপ্রকার বন্ধই হয়ে পড়ে, কিন্তু "সি. ও. পি. ডি."- র ক্ষেত্রে ব্রঙ্কাই গুলো শ্লেষ্মা দিয়ে ভর্তি থাকে।
উভয়ের নিরাময়ের জন্য সবথেকে উচিত কাজ হলো নিজেকে ফুসফুসে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী বস্তু থেকে দূরে থাকা। ঘরের ভিতর ও বাহিরের বায়ুদূষণের হাত থেকে বাঁচতে আমাদের মাস্ক ব্যবহার করা উচিত।
আর একটি ফুসফুসের জটিল ও মারাত্মক অসুখ হলো টি. বি. অর্থাৎ টিউবারকিউলোসিস বা যক্ষা। বাতাসে ভাসমান "মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস" নামক ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে এই রোগ হয়। এই রোগের ফলে রোগীর শ্বাস নেওয়ার সময় বুকে যন্ত্রণা করে, কাশির সময় শ্লেষ্মার সাথে রক্ত ওঠে, মৃদু বা তীব্র জ্বর হয়, হঠাৎ করে অনেকটাই ওজন কমে যায়,ক্ষিদে হয় না, রাতে প্রচুর ঘাম হয়,গাঁটে গাঁটে ফুলে যায় ও খুব ব্যাথা হয়, শরীর খুব দূর্বল হয়ে যায়। তবে এই রোগ ছোঁয়াচে। আক্রান্ত মানুষের হাঁচি, কাশি, থুতু এবং ব্যবহৃত জিনিসপত্রের মাধ্যমে অন্য মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়।
তবে বর্তমানে এই করোনা অতিমারীর কবলে লক্ষ লক্ষ মানুষের ফুসফুসের সমস্যা দেখা দিয়েছে,যা অত্যন্ত দুশ্চিন্তাজনক। এখনও মারক করোনার ভয়ঙ্কর গ্রাস শেষ হয়নি।
ভারতবর্ষে ফুসফুস জনিত রোগের প্রকাশ ও প্রসার খুব বেশি। প্রতিবছর বিশ্বের প্রায় ৯.৬ মিলিয়ন রোগীর মধ্যে প্রায় ২.২ মিলিয়ন রোগী ভারতবর্ষের। তবে এই অতিমারীর জন্য গত দুবছরে সংখ্যাটা অনেক অনেক বেশী। শ্বাসকষ্টে কোটি কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে গোটা বিশ্বজুড়ে। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০৩৫ সালের মধ্যে লক্ষ্য মাত্রা রেখেছে যে টি. বি. রোগের কারণে ৯৫% মৃত্যুহার কমাতে হবে এবং ৯০% নতুন রোগীর সংখ্যা কমাতে হবে। ভারতবর্ষ এই বিষয়ে ডটস্ এর মাধ্যমে ২০২৫ সালের মধ্যে টি. বি. মুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্যে জোরকদমে এগিয়ে চলেছে। তৃণমূল স্তরের স্বাস্থ্য কর্মী "আশা" দিদিরা এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন।
কিছু তুচ্ছ কারণে এই সকল মারাত্মক রোগগুলো দেখা দেয় আমাদের শরীরে — যা আমাদের সাধারণ জীবনযাত্রা দূর্বিসহ করে তুলেছে। এমনকি মাঝে মাঝে আমাদের মৃত্যুও ডেকে আনছে। তাই নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন,প্রাত্যহিক যোগাভ্যাস, প্রাণায়ামের মতো জীবনমুখী অভ্যাস গুলো গড়ে তুলতে হবে,যা আমাদেরকে একটি সুন্দর ও সুস্থ জীবন উপহার দেবে।