Sanghamitra Roychowdhury

Drama Tragedy Inspirational

4  

Sanghamitra Roychowdhury

Drama Tragedy Inspirational

সেতারের তারে

সেতারের তারে

6 mins
411


সকালে ফেসবুক খুলতেই আভা মাসীমার ফেসবুক পোস্ট আমার টাইমলাইনে। মাসীমা ট্যাগ করেছেন। ধবধবে সাদা বিছানার উপরে শুইয়ে রাখা সেতারটি। একদম চকচক করছে... দেখলেই বোঝা যায় সদ্য পালিশ করা। যন্ত্রটি নতুন সংযোজন। আগে কখনো দেখিনি জিনিসটি। সুতরাং জিনিসটি কেনা হয়েছে আনকোরা একেবারে। দেখলাম পোস্টের তলায় এখনো পর্যন্ত কোনো লাইক কমেন্ট নেই। সদ্য পোস্ট হয়েছে। প্রথম কমেন্ট আমিই করলাম, "ওয়েলকাম টু মিউজিক ওয়ার্ল্ড মাসীমা।" পাশে দুটো ইমোজি দিলাম... একটা হাসিমুখ আর অন্যটা রিবন বাঁধা হার্ট সাইন। সঙ্গে সঙ্গে আভা মাসীমার রিপ্লাই, "কবে থেকে আসবি? শিখবো তো আবার!" আভা মাসীমার বয়স এখন পঁয়ষট্টি প্লাস। মেসোমশাই বাহাত্তর এবং প্রায় শয্যাশায়ী। এই অবস্থায় মাসীমা সেতার শিখতে চাইছেন? কী অদ্ভুত পজিটিভ মাইণ্ডেড ভদ্রমহিলা!

আমি উত্তর দিলাম, "তোমাকে ফোন করবো। দেখছি।" তৎক্ষণাৎ মাসীমা লিখলেন, "দেখছি নয়। আসছিস"... সঙ্গে একটা হাসির ইমোজি। আমিও লাইক করে ফেসবুক বন্ধ করলাম।


আভা মাসীমা... মায়ের মাসতুতো বোন। শৈশবেই বাবা-মা মারা যেতে মায়ের মা... মানে আমার দিদিমার কাছেই মানুষ। আমার দিদিমা গাইয়ে ছিলেন। বড়ো বড়ো ওস্তাদের কাছে তালিম নিয়ে গান শিখেছিলেন যত্ন করে। আর এই গান শিখতে গিয়েই নিজের সংসারটি খুইয়েছিলেন। তবে ভেঙে পড়েননি। থিয়েটারে, সিনেমার প্লেব্যাকের কোরাসে গান গেয়ে আর কিছু ছাত্র ছাত্রীকে গান শিখিয়ে নিজের আর পরিবারের পেট চালিয়েছেন। পরিবার বলতে হতদরিদ্র দুঃস্থ বাপের বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা এবং আইবুড়ো ভাইবোনেরা। আর নিজের পেটের একমাত্র মেয়ে... অর্থাৎ আমার মা। তারপর এসে হাজির হলেন আভা মাসীমা। দিদিমার বোনের মেয়ে, অর্থাৎ মায়ের মাসতুতো বোন আমার এই আভা মাসীমা। কালের নিয়মে সময় চললো হেলেদুলে কখনো, আবার কখনো রেসের ঘোড়ার মতো টগবগিয়ে... তবে চললো, থেমে গেলো না। আমার ঘরে গ্র্যাণ্ড পিয়ানোটার ওপরে রাখা একটা ছবি... ফ্যামিলি ফটোগ্রাফ। চেয়ারে বসা দিদিমার একপাশে দাঁড়িয়ে মা, আরেকপাশে দাঁড়ানো আভা মাসীমা, আর দিদিমার কোলে একপাশে আমি আর অন্যপাশে মাসীমার একমাত্র ছেলে টুবাই। আমার দিদিমার ঐ গানের জন্যই নিজের স্বামীর সংসার হারিয়েছিলেন আর পরবর্তীকালে তাঁর বাবা-মা গত হতে বাপের বাড়িতে ভাইয়েদের সংসারে আশ্রয়টুকুও। আজ সকালে ফেসবুকে হঠাৎ ভেসে এসে আভা মাসীমার সেতারের ছবিটা এক লহমায় অনেক কথা মনে পড়িয়ে দিলো। খানিক পরেই টিংটিং শব্দে মেসেজ এলো ফোনে... হোয়াটসঅ্যাপে। চট করে দেখে নিলাম, হ্যাঁ, আভা মাসীমাই পাঠিয়েছেন। সেতার একহাতে ধরে তোলা একটা সেলফি... আর ছবির নীচে ছোট্ট একটু মেসেজ, "আমি তো আর অত ভালো করে ছবি-টবি তুলতে পারি না ফোনে! তবুও তোদের মতো চেষ্টা করলাম একটু! পঁয়ষট্টি বছরে এসে যতটুকু হয় আরকি?" সাথে একটা হাসির ইমোজি... আর তার তলায় একটা বিরাট বড়ো ধুকপুক করা হার্টের জিফ নাকি স্টিকার। মাথা নেড়ে নিজের মনেমনে হাসলাম, "মাসীমা পারেনও বটে সকাল সকাল! থাক, তবু কিছু একটা নিয়ে মেতে থাকুন... এই বয়সে। অনেক সহ্য করেছেন এককালে।"



তারপর কাজেকর্মে সারাদিনে আর মাসীমার কথা একবারও মনে পড়েনি। সারাদিন টইটই... এখানে ওখানে, স্টুডিওয়। কম্পোজিশন, রেকর্ডিং, অ্যারেঞ্জমেন্ট সব নিয়ে বিরাট চাপে ছিলাম। ফোনটা হ্যাণ্ডব্যাগে সাইলেন্ট মোডে পড়েছিলো। রাতে বাড়ি ফিরে স্নান খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় আধশোয়া হয়ে ফোনটা হাতে তুলে নিলাম। ইস্, সারাদিন ধরে বহুবার মেসেজ করেছেন আভা মাসীমা... কবে যাবো জানতে চেয়ে। আমিও ঘড়ির দিকে তাকালাম, এগারোটা বাজে... এখনো ঘুমোননি বোধহয় মাসীমা। মেসেজ করলাম, "রবিবার সকালের দিকে যাবো।" প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ব্লু-টিক। রিপ্লাই এলো, "সারাদিন থাকবি... তোর ফেভারিট ডিশ রাঁধবো।"

আমি একটা‌ বড়সড় হাসিমুখ স্টিকার পাঠিয়ে ফোন সুইচ অফ করে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। খুব ক্লান্ত শরীর... তাও ঘুম আসছেই না। হাবিজাবি কতকিছু মনে চলে আসছে। চোখ বুজেই রইলাম।



দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসছে সুরেলা যন্ত্রসঙ্গীত... সেতার। কী মিঠে বাজনা! এতো সুন্দর তান! অপূর্ব মুড়কি! রাগ বিলাবল। আমার খুব প্রিয়।আসলে রক্তে আমাদের সঙ্গীত... কন্ঠে হোক কিম্বা যন্ত্রে। হঠাৎ কানে এলো চিল চিৎকার... ছোট শিশুর। আর তারপরেই গাঁকগাঁক করে এক পুরুষকন্ঠের বিকট চিৎকার। তারপরই পুরুষটির উদ্ধত চিৎকারে মিশে গেলো অশ্রাব্য গালাগালি। গালাগালির মাঝেই এক ভীষণ জোর ধড়াম শব্দ। তারপর আবার ধড়াম আর ঝনঝন ঝনাৎ... সেই শব্দেই নাকি অন্য কোনো কারণে কে জানে... শিশুটির কান্না থেমে গেছে। আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। ভয়ানক আতঙ্কে আমি জবজবে ভিজে হয়ে ঘেমে গেছি। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে উঠেছে। বিছানা থেকে নেমে গিয়ে ঢকঢক করে ঠাণ্ডা জল খেলাম ফ্রিজ থেকে নিয়ে। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম অল্প কিছুক্ষণের জন্য। তার মাঝেই এই স্বপ্ন... কানে শোনা দুঃস্বপ্নের মতো এক কাহিনী আজ আমার কাছে স্বপ্ন হয়ে ধরা দিয়েছে... আভা মাসীমার জীবনের সেই কালো দিনটা।



দিদিমার কাছে মা আর আমার মাসীমা... দুজনেরই সঙ্গীতের হাতেখড়ি হয়েছিলো। মা শেষপর্যন্ত কন্ঠ সঙ্গীতেই থেকে যান। আভা মাসীমার বিশেষ আগ্রহ যন্ত্রসঙ্গীতে দেখে দিদিমা খুব দক্ষ ওস্তাদজীর কাছে মাসীমাকে তালিমের ব্যবস্থা করান। অল্পদিনেই খুব সুন্দর আয়ত্ত করেন মাসীমা সেতারের তারে নিজের ভালোবাসা আর প্রতিভার মিশ্রণ ঘটিয়ে। তারপর তালিমের মাঝেই একদিন আভা মাসীমার সঙ্গে মেসোমশাইয়ের পরিচয়... কলেজে পড়াকালীন, কোনো এক বন্ধুর বিয়েতে। তারপর যা হয় যৌবনের ধর্ম অনুযায়ী... প্রথমে প্রণয়, তারপরে পরিণয়। আমার মা তখনো বিয়ে করতে রাজি হননি। দিদিমা অযথা দেরী না করে মাসীমার বিয়ে দিয়ে দিলেন সুপাত্র যেচে এসেছে দেখে। প্রথম কয়েকমাস ভালোই কেটেছিলো। তারপর থেকেই অশান্তি শুরু... মাসীমা সেতার নিয়ে রেওয়াজে বসলেই। মাসীমাও এই অশান্তিতে গুটিয়ে যেতে থাকলেন। তবে সেতারের তারেই যে মাসীমার প্রাণভোমরা বাঁধা। সেতার থেকে দূরে থাকবেন কী করে? মেসোমশাইয়ের অগোচরে এবং বাড়িতে শাশুড়িকে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে রেওয়াজ করতেন। তবে মাসীমার শাশুড়ি ঠিকই টের পেতেন এবং যথারীতি মেসোমশাইয়ের কানেও তুলে দিতেন সে কথা। তবে সাবধানী মাসীমা ঠিক নিজেকে বাঁচিয়েই চলতেন। তবে সেদিনে আর শেষরক্ষা হলো না। মাসীমা নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করেই তুলছিলেন রাগ বিলাবল। তখনতো আর ওস্তাদজীর কাছে যেতেন না... নিজেই স্বরলিপির খাতা দেখে তুলছিলেন। খাতাটি মাসীমা লুকিয়ে আমার মায়ের হাত দিয়ে পাঠিয়ে ওস্তাদজীর কাছ থেকে স্বরলিপি লিখিয়ে আনাতেন। চলছিলো ওভাবেই। ক'দিনের চেষ্টায় সেদিন রাগ বিলাবল আয়ত্তে এসেছে। মাসীমা ডুবে আছেন সুরে। মাসীমার আঙুল সেতারের সাত তারে অনায়াসে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। সুরের মায়াজালে মাসীমা বিভোর... সময়ের খেয়াল নেই। চারবছরের ছেলে টুবাই যে তারস্বরে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছে... তা মাসীমার কানে ঢুকছে না। রান্নাঘরে স্টোভে বসানো ভাত পুড়ছে... সে পোড়াগন্ধও মাসীমার নাকে পৌঁছচ্ছে না। মাসীমা তখন রাগ বিলাবলে মজে আছেন... সুরসাধনায় মগ্ন প্রতিমার মতো।



মেসোমশাই বাড়িতে ঢুকেই প্রথমে লাথি মেরে দরজার ছিটকিনি ভাঙলেন... তারপর শুরু হলো অশ্রাব্য অকথ্য গালাগালি। তারপর প্রবল হুঙ্কার দিয়ে বীরবিক্রমে মেসোমশাই তুলে আছাড় মেরে ভেঙে ফেললেন মাসীমার সেতারটি। আমার কানে যেন ধড়াম শব্দটি আবার ধড়াম করে বেজে উঠলো। তারপর মাসীমা আর কখনো সেতারের নামও উচ্চারণ করেননি এই এতো বছরেও। আমার মা মাসীমার এই পরিণতি দেখে আর বিয়েই করতে চাননি। পরে অবশ্য আমার সারেঙ্গীবাদক বাবার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো কোনো এক অনুষ্ঠানে। তারপর প্রণয়... পরিণয়। সঙ্গীতচর্চায় মায়ের কোনো সমস্যা হয়নি। আমিও জন্মসূত্রে বাবা মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছি সুর ও সঙ্গীতের উত্তরাধিকার। তবে আমি ভারতীয়ের সঙ্গে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের তালিমও নিয়েছি... এখন আমি পেশায় মিউজিক কম্পোজার, মানে গানের সুর... আবহ তৈরি করি। মাসীমার সামনে কখনো আমি সঙ্গীত নিয়ে কোনো কথা বলিনি... মায়ের ও দিদিমার নিষেধাজ্ঞা ছিলো।



তাই মাসীমার আবার এই বয়সে সেতার বাজানোর শখে সব ঘটনাগুলো পরপর স্লাইড শোয়ের মতোই মনে পড়ে গেলো... যদিও সবটাই মায়ের আর দিদিমার মুখে শোনা, কারণ এই ঘটনাতো আমার মায়ের বিয়েরও আগেকার। তবুও আমার কাছে বড্ড স্পষ্ট এই বেদনার কাহিনী। আজ মাসীমার আবার সেতার শেখার সিদ্ধান্ত খুব নাড়িয়ে দিয়েছে আমাকে ভেতর থেকে। মাসীমার একমাত্র ছেলে টুবাই এখন বিদেশবাসী। আর মেসোমশাই শয্যাগত প্রায়। মাসীমা বোধহয় নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলেন দ্বিতীয়বার... তাই এই সিদ্ধান্ত। সেতারের তারে নিজেকে আরেকবার খোঁজার ইচ্ছা এবং চেষ্টা... দুইই। আমি এই রবিবার থেকেই যাবো প্রত্যেক সপ্তাহে ঠিক সময় বার করে... মাসীমাকে সেতার শেখাতে। মেসোমশাইয়ের আরকিছু বলবার সামর্থ্য নেই। মাসীমাকে আমি আরেকবার অবসাদে ডুবতে কিছুতেই দেবো না... আমাদের ফ্যামিলি ফটোগ্রাফের সামনে দাঁড়িয়ে শপথ করলাম... আমার স্বর্গগতা দিদিমা আর মায়ের কাছে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama