Satabdi Sengupta Bhore

Classics Inspirational Others

4  

Satabdi Sengupta Bhore

Classics Inspirational Others

স্বপ্ন পূরণ

স্বপ্ন পূরণ

6 mins
598



সকাল থেকে ব্যস্ত রিমিতা। তার এতো দিনের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে আজ। ছোটো থেকে সে ভাবতো বড়ো হয়ে ডান্সার হবে,তার নিজের একটা নাচের স্কুল হবে। যে বাবা মা টাকার অভাবে সন্তানদের নাচ শেখাতে পারে না সেই বাচ্চরা ওই স্কুলে নাচ শিখবে। অনেক যুদ্ধ পেরিয়ে আজ সেই বিশেষ দিন, রিমিতার নতুন নাচের স্কুলের উদ্বোধন। মায়ের ইচ্ছে রাখতে নতুন স্কুলের নাম রেখেছে ছন্দনীড়।


  রিমিতা সরকার। ওর অবশ্য আরেকটা নাম আছে, বাবা মা আদর করে তিতলি বলে ডাকে। ছোটো থেকেই প্রাণোচ্ছ্বল রিমিতার ধ্যান জ্ঞান ছিল নাচ। বাবা সুন্দর গান করতো, মা গানের সাথে ভালো নাচ ও করতে পারত। এরই মাঝে ছোট্ট তিতলির দুচোখ ভর্তি স্বপ্ন নিয়ে বড়ো হওয়া। বাবার প্রাইভেট চাকরীর মাইনে দিয়ে কোনো নামকরা জায়গায় নাচ না শিখলেও, পাড়ার একটি ভালো নাচের স্কুলে রিমিতার ওড়িশি নাচের হাতেখড়ি। সেই থেকেই নাচের প্রতি প্রেম ভালোলাগা। নাচের গুরুজী বলতেন "রিমিতার পায়ে ঘুঙুর যেন জীবন্ত" এই কথার ব্যাখ্যা কখনো জানতে চাই নি ছোট্ট তিতলি। তার জীবনের লক্ষ্য গুরুজীর মতো সেও নাচের তালিম দেবে।


 ওড়িশি শেখার সাথে সাথে চলতে থাকে পড়াশুনো। ওই বছর উচ্চমাধ্যমিকে র্ফাস্ট ডিভিসন পেয়ে ইংলিশ অর্নাস নিয়ে রিমিতার নতুন কলেজ। একটা অন্য জীবন, চলতে থাকে নিজের মতো করে। তখন রিমিতার সেকেন্ড ইয়ার, কলেজের অ্যানুয়াল প্রোগ্রামের রির্হাসালে হঠাৎই পরিচয় সায়েন্স বিভাগের কৃতি ছাত্র দ্বৈপায়ন চৌধুরীর সাথে। 


   দ্বৈপায়ন চৌধুরী, বাবা সোনা ব্যবসায়ী, মা হাউসওয়াইফ। ছোটো থেকে দ্বৈপায়নের অঙ্কের প্রতি ভালোবাসা। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে বেশ ভালো নাম্বার পেয়ে অঙ্ক নিয়ে নামী কলেজের থার্ড ইয়ারের ছাত্র। 


  রিমিতার নাচে মুগ্ধ দ্বৈপায়ন যেচে আলাপচারিতা করে। তারপর ফোন নাম্বার দেওয়া নেওয়া। চলতে থাকে টুকটাক কারণে ফোনে কথা বলা, কলেজ ক্যান্টিনে আড্ডা, মাঝে মাঝে একসাথে বাড়ি ফেরা। 

 দ্বৈপায়ন ঠিক করল এবার সে রিমিতাকে জানাবে নিজের মনের কথা।


   একদিন কলেজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে দ্বৈপায়ন রিমিতাকে জানালো যে, সে রিমিতাকে ভালোবাসে। রিমিতা অবাক, মনে মনে বেশ খুশি হয়। রিমিতার ক্লাসমেট নিবেদিতার ভারি পছন্দ দ্বৈপায়নকে আর সেখানে দ্বৈপায়ন রিমিতাকে প্রোপোজ করছে এটা ভেবে রিমিতার অহঙ্কার হচ্ছে। প্রস্তাবে রাজি হয় রিমিতা, না হওয়ার কোনো কারণও ছিল না রিমিতার কাছে। অবশেষে শুরু হয় তাদের প্রেমপর্ব।


   দ্বৈপায়ন অঙ্কের কৃতি ছাত্র হলেও সে কখনো চাকরি বা হায়ার স্টাডি করতে চায় নি। সেও তার বাবার মতো ব্যাবসায়ী হতে চায়। রিমিতার সে ব্যাপারে কোনো আপত্তি ছিল না। করোর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কিছু জোর করা উচিত নয় বলে রিমিতার ধারণা। দ্বৈপায়নের কলেজ শেষ, সে বাবার ব্যাবসা জয়েন করে, অন্যদিকে রিমিতার এটা ফাইনাল ইয়ার। একই সঙ্গে পড়াশুনার প্রেসার আর নাচ দুটোই সমান ভাবে চলে।


   রিমিতার মা অনেকদিন ধরেই লক্ষ্য করে তার মেয়ের বেশ কিছু বদল ঘটেছে, অন্যমনস্ক ভাব, সারাদিন ফোনে কথা বলা, কলেজ থেকে দেরি করে ফেরা। একদিন সুনয়না জিজ্ঞাসা করলো মেয়েকে সব ঠিক আছে কিনা! পরীক্ষার অজুহাত দিয়ে রিমিতা লুকিয়ে গেল তার আর দ্বৈয়পায়নের সর্ম্পকের কথা।


    পরীক্ষা শেষেও রিমিতার ব্যবহারে পরিবর্তন না হওয়ায় সুনয়না একটু কড়া ভাবেই মেয়েকে প্রশ্ন করে। এবার রিমিতা কিছু না লুকিয়ে দ্বৈপায়নের কথা মাকে জানালো। সেদিন রাতে রিমিতার বাবা বাড়ি ফেরার পর মেয়ের সর্ম্পকের কথা সুনয়না তার স্বামীকে বললে সে আপত্তি জানায়। রিমিতার বাবা রমেন বাবুর ইচ্ছা তার জামাই হবে সরকারি চাকরিজীবি। কিন্তু রিমিতা জনিয়ে দেয় সে দ্বৈপায়ন কে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবে না। 


  দ্বৈপায়নও বাড়িতে তার বাবা মা' কে রিমিতার কথা বলে। তবে দ্বৈপায়নের বাবা মা রিমিতার নাচ করা'টা ভালো ভাবে মেনে নেয় না। একদিন বিকেলে দুজনে দেখা করে নিজেদের সমস্যার কথা জানায়। রিমিতা স্পষ্ট জানায় সে নাচ ছাড়বে না, আর বাবার অমতে বিয়ে করবে না। এই জেদ নিয়ে তাদের কেটে গেলো আরও একটা বছর। ধীরে ধীরে রিমিতার বাবা মানতে বাধ্য হয় মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে, অপরদিকে দ্বৈপায়নের বাবা মা ছেলের জন্য মেনে নিলেও মন থেকে তারা রিমিতার নাচ মেনে নিতে পারেনি।


  এইসব দোটানার মধ্যে জাঁকজমক করেই রিমিতা আর দ্বৈপায়নের বিয়েটা হয়ে যায়। বিয়ের পর বেশ কয়েক মাস সুন্দর ভাবেই চলছিল। রিমিতা তার নাচের প্র‍্যাক্টিস, কয়েকটা পারফরমেন্স ও করে। রিমিতার প্রত্যেক অনুষ্ঠানে দ্বৈপায়ন সাথে থাকে কিন্তু রিমিতার শ্বশুর শ্বাশুড়ি কোনো না কোনো অজুহাতে রিমিতার প্রোগ্রামে যেত না। রিমিতার খারাপ লাগলেও সে মানিয়ে নেয়। কয়েকমাস কাটার পর চিত্রটা আস্তে আস্তে বদলে যায়। ব্যবসার কাজে পুরো সময়টা বাইরেই থাকে দ্বৈপায়ন, ওর রিমিতার জন্য সময় সেরমভাবে সময় নেই বললেই চলে। তার জন্য রিমিতার কোনো অভিযোগ ছিল না, সে জানে দ্বৈপায়ন কতোটা ব্যস্ত। এদিকে শ্বাশুড়ির সাথে কিছু না কিছু নিয়ে প্রতিদিন একটা লড়াই চলে রিমিতার, সেটা দ্বৈপায়নকে জানতে দিত না। দিন দিন ঝগড়ার পরিমাণটা বাড়তে থাকে, নাচ করা নিয়ে শ্বাশুড়ির কাছে কথা শোনা রিমিতার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। যেদিন রিমিতার প্র‍্যাক্টিসের দিন গুলো শ্বাশুড়ি শরীর খারাপের অভিনয় করে রিমিতাকে আটকে দিত। পরে বুঝল রিমিতা, শ্বাশুড়ির সবটাই ইচ্ছাকৃত । একদিন বাধ্য হয়ে দ্বৈপায়নকে জানায়, কিন্তু সেদিন দ্বৈপায়নের ব্যবহারে রিমিতা হতভম্ব। যে দ্বৈপায়ন রিমিতার নাচ দেখে দেখে তাকে ভালোবেসেছিল সেই দ্বৈপায়ন তাকে জানিয়ে দেয় সে যেন নাচ নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে। রিমিতা মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে, এরকম উত্তরের জন্য আশা করে নি। সে যে মানুষকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে আজ সেই মানুষটার সাথে বিস্তর ফারাক। 


  দিনের পর দিন দ্বৈপায়নের মা'র অত্যাচার বাড়তেই থাকে, সাথে দ্বৈপায়নের বাবা কোনো প্রতিবাদ না করে নিজে পশ্রয় দিয়ে গেছেন। রিমিতা নাচের শো না করতে পারে ঘরের মেঝেতে তেল ফেলে রাখা যাতে রিমিতা পড়ে গিয়ে চোট পায়, নাচের প্র‍্যাক্টিস থেকে ফিরলে রিমিতাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা, ঠিক করে খাওয়ার


 খেতে না দেওয়া। দ্বৈপায়ন বাড়ি ফিরতেই তার কাছে তার বাবা মা অভিযোগের খাতা খুলে বসে সবকিছুই রিমিতার সহ্যের বাইরে চলে যায়, তার প্রতিবাদে রিমিতার ওপর পাশবিক অত্যাচারের করা হয়। রিমিতার বাবা মা আসে মেয়ের হয়ে কথা বলার জন্য কিন্তু তাদের কেও অপমান করা হয়, সমাজের ভয়ে মেয়েকে মানিয়ে নেওয়ার উপ

দেশ দেয়। মেনে নেওয়া মানে তার স্বপ্নকে ভুলে যাওয়া, যেটা সব অত্যাচারের থেকেও অনেক বেশি যন্ত্রণার রিমিতার কাছে।


  পরের দিন রিমিতার নাচের প্রোগ্রাম। আগের দিন থেকে রিমিতার শ্বাশুড়ির সাথে নানান কারণে অশান্তি শুরু হয়েছে। রাত্রে বাড়ি ফেরার পর দ্বৈপায়ন মায়ের কথা শুনে রিমিতার ওপর অত্যাচার শুরু করে রিমিতা তার প্র


তিবাদ করায় দ্বৈপায়ন রিমিতাকে প্রচন্ড মারধোর করে এবং সিড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দেয়। পড়ে গিয়ে কপাল গাল ফেটে রক্ত, জ্ঞান হারায় রিমিতা। অনেকক্ষণ জ্ঞান না আসায় দ্বৈপায়ন রিমিতাকে নিয়ে হসপিটাল যায় এবং বলে রিমিতা পা পিঁছলে পড়ে গেছে। রিমিতার বাবা মা কে খবর দিলে তারা সেখানে যায় এবং বুঝতে পারে তাদের মেয়ে পা পিঁছলে নয় ইচ্ছে করে তাকে ফেলে দেওয়া হয়। তারা তখনি ঠিক করে নেয় রিমিতাকে আর শ্বশুরবাড়ি পাঠাবে না। হসপিটালে ভর্তি করে আসার পর থেকে দ্বৈপায়ন বা তার বাড়ির লোক কাউকেই সেখানে দেখা যায় নি। সুস্থ হয়ে রিমিতা নিজের বাড়ি ফিরে আসে। বাবা মা কে সাথে নিয়ে থানায় অভিযোগ করে রিমিতা, কিন্তু যর্থাথ প্রমাণের অভাবে সেই অভিযোগ ভিত্তিহীন হয়ে যায়। অন্যদিকে রিমিতা ডির্ভোসের নোটিস পাঠালে দ্বৈপায়ন তাকে অকথ্য গালিগাজ করতে ছাড়ে না সাথে ডির্ভোস না দেওয়ার হুমকিও দেয়। রিমিতা অবশ্য তাতে ভেঙ্গে পড়ে নি, সে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করে নিজের কাছে। আবার নিয়মিত জীবনে ফেরে, রিমিতা নাচ নিয়ে ফেলে আসা স্বপ্নগুলো আবার দেখতে শুরু করে। অবশেষে রিমিতার জেদের কাছে দ্বৈপায়নকে ডির্ভোস দিতে হয়, যদিও এই হার মেনে নিতে পারেনি দ্বৈপায়ন। তাতে অবশ্য রিমিতার কিছু আসে যায় না। সামনে অনেকটা পথ এখনো বাকি রিমিতাকে এগিয়ে যেতে হবে সেই পথের দিকে।


  সুনয়না দেবীর ডাকে হঠাৎই সম্বিত ফিরে পায় রিমিতা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ীর ভাঁজ ঠিক করতে করতে কখন যে রিমিতা অতীতে ফিরে গেছে! 


  হাত ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে রিমিতা এগিয়ে চলে সামনের দিকে, এক নতুন ছন্দের খোঁজে।।


    


 


   


 





Rate this content
Log in

More bengali story from Satabdi Sengupta Bhore

Similar bengali story from Classics