STORYMIRROR

Rohini Mullick

Classics Inspirational Children

4.6  

Rohini Mullick

Classics Inspirational Children

স্বাধীনতার এক অন্য রং

স্বাধীনতার এক অন্য রং

7 mins
569


এটি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার অন্তর্গত সালেপুর নামে ছোট একটি গ্রামের কথা। সময়টা ১৯৪৯ সাল অর্থাৎ ভারত স্বাধীন হবার মাত্র দু'বছর পর। সালেপুর গ্ৰামে বসবাস করতেন তপন দত্ত ও তাঁর স্ত্রী আরতি দত্ত। ঐ সময় তাদের দুজনের সংসারে একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তার নাম রাখেন সুমিতা। সকলের আদরে যত্নে সুমিতা বড় হতে থাকে। ক্রমে সুমিতা মনযোগের সাথে স্কুলের পড়াশুনা করে তার উন্নত মেধার পরিচয় দেয় এবং সে সবার প্রিয় হয়ে ওঠে। খেলাধুলাতেও সে নিজেকে যথেষ্ট পারদর্শী করে নেয়। স্কুলের ও পল্লীর বিভিন্ন ক্রিড়া প্রতিযোগিতায় পুরস্কার বিজেতা হয়।

নিম্ন বিত্ত গরীব ঘরে জন্মালেও তার চিন্তা ভাবনা ছিল উন্নত মানের। বেড়ে ওঠার সাথে সাথে সমাজের বিভিন্ন সংস্কার নিয়ে তার মনে প্রশ্ন জাগতে শুরু ‌করে। সে তার নিজের বিচার বুদ্ধি দিয়ে সেই কুসংস্কারর অন্ধকার দিক বুঝতে সক্ষম হয়ে ওঠে। সুমিতা সেই মত নিজেকে তৈরি করতে থাকে। এ ভাবেই সুমিতা জীবনে এগিয়ে যেতে থাকে এবং যথা সময়ে সে ১৯৬৫ সালে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ নম্বর নিয়ে প্রথম বিভাগে স্কুলের দশম এবং ১৯৬৬ সালে একাদশ শ্রেণী উত্তীর্ণ হয়ে কলেজের স্নাতক ক্লাসে ইতিহাস নিয়ে কলা বিভাগে ভর্তি হয়। এই সময় সুমিতার বাবা ও মা সুমিতার বিবাহ দেবার জন্য প্রস্তাব রাখেন সুমিতার কাছে। সুমিতা বাবা মা'য়ের সেই প্রস্তাবে অসম্মতি জানায়। সে জানায় তার ইচ্ছা আরও পড়াশুনা করে নিজের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা এবং সমাজকে কুসংস্কার মুক্ত করা। সমাজের নারী জাতিকে শিক্ষিত ও সাবলম্বী হয়ে স্বাধীন ভাবে বাঁচার পথ দেখানোই তার জীবনের লক্ষ্য।

সেই মত সে পড়াশুনা করে ১৯৬৯ সালে স্নাতক পরীক্ষা দেয়। সুমিতা সমাজের কুসংস্কারের শিকল ভেঙে নিজেই নিজের এক আলাদা পরিচয় তৈরি করতে থাকে।

সুমিতা এখন তাদের গ্রামের মধ্যে একমাত্র

শিক্ষিতা নারী। শারীরিক গঠনে সে তখন অপরূপা সুন্দরী যুবতী। পরনে হলুদ শাড়ি পড়ে সে ঘুরে বেড়ায় গ্ৰামের দিক দিগন্তে, দূর দূরান্তে। চোখে হাজার স্বপ্ন নিয়ে উড়ে বেড়ায় সে ডানা মেলে।

সুমিতার মা আবারও অনেক আশা নিয়ে মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি করানোর চেষ্টা করে। মা : মেয়ে মানুষের কী আর অত স্বপ্ন দেখা সাজে! বিয়ে করে সংসার করাই তো মেয়েদের পরম ধর্ম।

সুমিতা : না মা, শুধু বিয়ে করে সংসার করাই মেয়েদের পরম ধর্ম নয়। মেয়েদের ও স্বাধীন ভাবে বাঁচার অধিকার আছে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের স্বাধিন পরিচয় গড়ে তোলার অধিকার আছে। আছে অনেক স্বপ্নকে বাস্তবায়িত অধিকার।

সুমিতা : আজ কলেজে গেছিলাম। আমি আমার বিষয় ইতিহাসে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছি। এই দেখো আমার পাশের মেধার তালিকা।

সুমিতা ছিল খুবই বুদ্ধিমতি মেয়ে, তাদের গ্ৰামের এক মাত্র পড়ুয়া ছাএী । কলেজে সে আজ কলা বিভাগে। ইতিহাস বিষয়ে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে। কিন্তু সমাজের কাছে মেয়ে মানুষের ধর্ম : বিয়ে করে সংসার করা। সুমিতা এই মানসিকতার পরিবর্তনের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা বদ্ধ । তার বাবা তপন দত্ত খুবই কঠোর নিষ্ঠাবান মানুষ। তপনবাবু তার মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছে ঐ পাড়ারই বীরেন বাবুর ছেলের সাথে।

তপনবাবু মেয়েকে ডেকে তার বিয়ে দেয়ার কথা বলেন।

সুমিতা তার বাবাকে জানায় সে বিয়ে করতে চায় না। স্বাধীন ভাবে নীজের পরিচয় গড়ে তুলতে চায়।

তপনবাবু : আর কী করতে চাও মা ?

সুমিতা : কিছু নিজের জন্য আর বাকিটা সমাজের নারী জাতির জন্য করতে চাই।

সুমিতার মা : আপনার মেয়ে এখন নিজের পরিচয় তৈরি করতে চায়।

তপনবাবু : আমি বীরেন বাবুকে কথা দিয়েছিলাম যে আমি আমার কন্যার বিয়ে তার ছেলের সঙ্গে দেব। কিন্তু সুমিতার ইচ্ছে কে ও আমি ফেলতে পারছিনা। আজ দেশ স্বাধীন তাহলে মেয়েরাই বা স্বাধীন হবে না কেন। আমি চাই সুমিতা নিজের স্বপ্নকে স্বার্থক করুক । আমি বীরেন বাবুর সাথে কথা বলবো।


সুমিতা তার স্বপ্ন নিয়ে ডানা মেলল দূর দেশে । সে পাড়ি দেয় এক নতুন শহরে। সংস্কৃতি ও পরাধীনতার শিকল ভেঙে ডানা মেলে সে পাড়ি দেয় ভিন্ন জেলায়। স্কুল শিক্ষিকার চাকরির সন্ধানে। সুমিতা মেধাবী ছাত্রী । সে চাকরির ইন্টারভিউ তে সফল হয়ে একটি বিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ের শিক্ষিকা পদে নিযুক্ত হল হুগলি জেলার চুঁচুড়ায় । সুমিতার এখন এক অন্য পরিচয় সে এখন বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। বিদ্যালয়ের ছাত্র- ছাত্রীদের পড়ানোই এখন তার এক মাএ লক্ষ্য।

সময় গড়িয়ে যায় । সুমিতার জীবন কাটে ওই শহরে শিক্ষিকার চাকরি করে অনেক দিন সে গ্ৰামে যায়নি। কিন্তু তার ইচ্ছা করছে তার মা বাবার সঙ্গে দেখা করতে। সুমিতা ছুটি নিয়ে নিজের গ্ৰামে যায়। তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে।

সুমিতার মা : সুমিতা তুই এসেছিস ! ও মা!আয় আয় ভেতরে আয় মা ।

সুমিতা : মা অনেক দিন তোমার সাথে দেখা হয়নি । এই গ্ৰামের কথা খুব মনে পড়ছিল তাই চলে এলাম। কিন্তু মা, আমি এসেছি এই গ্ৰামে এক নতুন স্বপ্ন নিয়ে।

সুমিতার মা: কি স্বপ্ন?

সুমিতা : এখানে একটা ছেলে মেয়েদের পড়ার জন্য একটা পাঠশালা খুললে কেমন হয় ! এখানে গ্ৰামের মেয়েরা পড়াশোনা করবে। স্বাধীন ভাবে বাঁচার পথ পাবে জীবনে। পুরুষদের শাসনের শিকল ভেঙে বেড়িয়ে আসার ক্ষমতা অর্জন করবে।

সুমিত

ার মা: কী রে বলিস কি ! সত্যি!


সুমিতা গ্ৰামের উন্নতির জন্য কাজ শুরু করল। তার নিজের বাড়িতে একটা পাঠশালা স্থাপন করল। কিন্তু সমাজের লোকেরা সুমিতার এই কাজকে মানতে রাজি হল না। সুমিতা কিন্তু তার কাজ না থামিয়ে এগিয়ে চলতে থাকলো তার লক্ষ্যের পথে। তার পাশের বাড়ির মেয়ে, বন্দনা আর কয়েকটি ছাত্র ছাত্রী কে নিয়ে শুরু করে তার সর্বশিক্ষা পাঠশালা । সুমিতা সাময়িক ভাবে নিজে এই পাঠশালায় শিক্ষকা রূপে ছাএীদের পড়ানো শুরু করে। পাশাপাশি সুমিতা গ্ৰামের উন্নতির জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ শুরু করল। সে গ্ৰাম বাসিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মহিলাদের মনে ভাষা শিক্ষা লাভ করে জ্ঞানের আলো দেখার ইচ্ছা জাগালো। সন্ধ্যাবেলায় গ্ৰামের অবিবাহিত ও বিবাহিত মহিলাদের বাংলা অক্ষর চেনা ও লেখা শেখানো শুরু করে দেয়। ক্রমশ তারা নিজেদের নাম সই করতে সক্ষম হয়।এরই মধ্যে সুমিতা মনস্থির করে নেয় সে আর হুগলি জেলায় শিক্ষিকার চাকরি করবে না। সে নিজের গ্ৰামের এই পাঠশালাতেই পড়াবে। সে চাকরি ছেড়ে দেয়। কয়েক বছর পর সুমিতা তার ছাত্রী বাণীর সাথে তাদের গ্ৰামের উন্নতির কাজ শুরু করে দেয়। সুমিতা ঐ পাঠশালায় বাংলার সাথে সাথে ইংরেজি পড়ানো শুরু করে দেয়। 

এখন তার গ্ৰামের মানুষেরা সুমিতার এই সমাজ সংস্কার ও তার উন্নয়নের মানসিকতাকে সম্মান ও প্রশংসা না করে পারছে না। গ্ৰামের প্রতিটি মেয়ের কাছে সুমিতা একটি প্রেরণা। সুমিতা গ্ৰামে থেকে গ্ৰামের মানুষদের মানসিক পরিবর্তন ঘটিয়ে সংস্কার মুক্ত করতে সক্ষম হয়। ক্রমশ গ্ৰামে পাকা রাস্তা হয়েছে, পাকা ঘর নির্মিত হয়েছে, ছাত্র- ছাত্রী দের জন্য নতুন নতুন সুযোগ হয়েছে, অনেক বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। মেয়েরা নতুন সুযোগ পেয়েছে, স্বাধীন ভাবে জীবনে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে। সুমিতার তৈরি করা বিদ্যালয় এখন মহাবিদ্যালয় এ পরিনত হয়েছে । অনেক ছাত্র- ছাত্রী এই স্কুল কলেজে পড়তে আসে।

সুমিতার ওই পুরনো দিনের লড়াইয়ের কথা খুব মনে পড়ে। মনে পড়ে তার নিজের নারী জীবনের স্বাধীনতা অর্জনের কথা। নারী জাতির পরাধীনতার শেকল ভাঙ্গার কথা। স্বাধীনতা পাওয়ার হাজার স্বপ্ন দেখেছি সেই লড়াইয়ের দিনগুলোতে - আজও মনে পড়ে। আজ আমি খুব খুশি এই স্বাধীনতার লড়াইয়ে আমি সফল হয়েছি , এই স্কুলে নিজেকে শিক্ষিকা পদে নিযুক্ত হতে পেরে আমি ধন্য। ১৯৮৪ সালের ১৫ অগাষ্ট স্বাধীনতা দিবসের শুভ লগ্নে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে সুমিতা আজ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকা পদে নিযুক্ত হবে!

বাণী : দিদিমণি আসব ? 

সুমিতা : কে? 

বাণী : দিদিমণি আমি বাণী ! 

সুমিতা : বাণী! এত বছর পর , কেমন আছিস ? কী করছিস আজ কাল? 

বাণী: দিদিমণি আমি ভালো আছি । আজ কাল আমি ভূগোল নিয়ে পড়াশোনা করছি । 

আপনি কেমন আছেন ? 

সুমিতা : আমি ভালো আছি রে। আমি খুব খুশি হলাম রে তুই ভূগোল নিয়ে পড়ছিস জেনে! তাহলে আমারা আমাদের লড়াইয়ে সফল হয়েছি বলে ! মেয়েরা স্বাধীনতা পেয়েছে ।

বাণী : আমাদের দুজনের দেখা স্বপ্ন সফল হয়েছে। আচ্ছা আমি জানতে পারলাম যে আজ থেকে আপনি এই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার দ্বায়িত্ব গ্ৰহণ করবেন! 

সুমিতা : হ্যা রে ঠিকই শুনেছিস‌ । আয় তোকে পুরো জায়গাটা ঘুরিয়ে দেখাই ।

আজ স্বাধীনতা দিবসের শুভ লগ্নে সুমিতা স্কুলের প্রধান শিক্ষকা রূপে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করল। “জান গন মন …….” , ভারতের জাতীয় সংগীতের ধ্বনি শোনা গেল। সুমিতা মঞ্চে উঠল প্রধান শিক্ষকা রূপে তার ছাত্রছাত্রীদের ভাষণ দিতে।।

সুমিতা : আজ ১৫ অগাষ্ট ভারতবর্ষ ব্রিঢিশ শাসকের বিরুদ্ধে অনেক কঠিন লড়াই করে স্বাধীনতা পেয়েছিল । এই স্বাধীনতা শব্দটি অর্থ সমগ্র ভারতীয় জাতীর স্বাধীনতা অর্থাৎ নারী পুরুষ ও শিশুর নির্বিশেষে সকলের সার্বিক স্বাধীনতা।

বাণী : দিদিমণি আমি আজ এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে চাই।

সুমিতা : এসো বাণী ।

বাণী : শ্রদ্ধেয় শিক্ষক শিক্ষিকাদের প্রণাম জানিয়ে আমার আজকের বক্তৃতা শুরু করছি। আজ আমি আপনাদের এক জীবন কাহিনী বলতে চাই। কয়েক বছর আগে আমাদের সমাজের মানুষেরা বলতো মেয়েদের একটাই ধর্ম - সংসার ধর্ম। এই সমাজের বাধা ভেঙে আমাদের সকলের প্রিয় শ্রদ্ধেয়া সুমিতা দিদিমণি স্বাধীন ভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখেন। বিবাহিত জীবনে অন্য জনের পরিচয়ে নিয়ে বেঁচে থাকা নয়। তাই এই বিদ্যালয়ের সৃষ্টি করে এখানেই শিক্ষিকা হয়ে নিজের পরিচয় তৈরি করেন। 

সুমিতা: এখন সমাজ বদলেছে , দেশ পরাধীনতার শিকল ভেঙে স্বাধীনতা পেয়েছে । অনেক মেয়েরা এখন শিক্ষিত , পড়াশোনা করে , স্বাধীন ভাবে এগিয়ে চলেছে । এই ব্ল্যাকবোর্ডে স্বাধীনতা দিবসের দিনে ভারতবষের স্বাধীনতা পালন করে ও দেশের আজাদীর লড়াইঢয়ের যোদ্ধাদের সরণে লিখছি #FreeIndia. 

সুমিতার কথা প্রেরণা দিল বিদ্যালয়ের ছাত্র - ছাত্রী দের। তারা সপৎ নিল জীবনে নিজের পরিচয়ে স্বাধীন ভাবে বাঁচার। দেখা গেল সেই উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা #FreeIndia। দেখা গেল ভারতের জাতীয় পতাকা উড়ছে আকাশ পানে চেয়ে।











 




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics