সব মানুষই যত্নে থাক
সব মানুষই যত্নে থাক
ধরাম্ ! হঠাৎ এক কানফাটা শব্দ ! কেউ কিছু বোঝার আগেই নিমিষে ধুলিস্মাৎ হয়ে গেল কয়েক'শ বাড়ি …. একটা কালো ঘন ধোঁয়ার চাদর ঢেকে ফেললো গোটা আকাশটাকে ….চারিদিকে যেন ধুলোর ঝড় উঠেছে… আর সেই ধুলো-ধোঁয়া আলো আঁধারির গোলকধাঁধায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে চলেছে কাতারে কাতারে মানুষ --- ভীত , ত্রস্ত।
আহতদের আর্ত চিৎকার যেন হাওয়ার বুক চিড়ে তীর গতিতে ছুটছে চৌদিকে। স্বজনহারাদের কান্নায় যেন ডুকরে কেঁদে উঠছে শহরটা ও। এত গোলযোগের মধ্যে কেউ খেয়ালই করছে না আর্শিয়া কে ---- বছর চার এক এর ছোট্ট মেয়েটা হাপুস নয়নে কেঁদেই চলেছে … তার অস্থির চোখ দুটো অনবরত খুঁজে চলেছে তার মাকে! টলমল পা গুলো বারবার এগিয়ে যাচ্ছে সেই দোকানটার দিকে যেখানে একটু আগেই তার মা ঢুকেছিলেন , তার প্রিয় পুতুলটা তাকে কিনে দিতে। আজ যে ওর জন্মদিন! মা তো তাকে বলেছিলেন , "ওখানে খুব ভিড় , জান। তুমি এখানেই দাঁড়াও, আমি আসছি …"
কিন্তু দোকান কই ? আর্শিয়া ভয়ে পিছিয়ে আসে। দোকানের জায়গায় যে শুধুই কাঁচ আর সিমেন্টের স্তুপ! ফুটফুটে উজ্জ্বল মুখটায় ঘনিয়ে এলো আষাঢ়ের মেঘের অন্ধকার। চোট পাওয়া হাত দুটো শূন্যে বাড়িয়ে, ধরা ধরা গলায় বলে উঠলো, "আম্মি,আমি হেরে গেছি তো! আর লুকিয়ে থেকো না প্লিজ!" চোখের জলের কল টা আজ যেন কে খুলে দিয়েছে, বন্ধই হচ্ছে না!
ধুলো ধোঁয়ার ঝড়ে, অন্ধকারে, অচেনা মুখের ভিড়ে ভয় আর অনিশ্চয়তা গিলে খেতে আসছে ২ ফটের মেয়েটাকে। ভয় লাগলেই আর্শিয়া লুকোত মায়ের বুকে, সেঁধিয়ে যেত মায়ের কোলের ভেতর … খানিকটা সেই অভ্যেস থেকেই বোধহয় সে গুটি গুটি পায়ে এগোয় বালি-সিমেন্টের স্তূপটার দিকে...ধুলো ধোঁয়ার খেলায় দুরে, স্তূপের তলা থেকে উঁকি মারছে ওটা কি? আর্শিয়ার এক মুহূর্তের জন্য মনে হল ওটা যেন মায়ের হিজাব, হ্যাঁ! মায়েরই তো! আসলে মায়ের হিজবটা ছিল সাতরঙা। তাই অগুনতি কালো হিজাবের অন্ধকারে, তা জেগে থাকতো স্বপ্নের মত!
কিন্তু মায়ের নাগাল পেলো না আর্শিয়া। তার অনেক আগেই হোঁচট খেয়ে পড়ল ইট পাথরে। ব্যাথায় কঁকিয়ে কেঁদে উঠতে যাবে, এমন সময় চোখ পড়ল একটা পুতলের ওপর , এক টুকরো সিমেন্টের তলায় চাপা পড়ে আছে। একটা হাত নেই,মুখ ভর্তি ধুলো, জামা কাপড়ও ছিঁড়ে গেছে…উঠে বসে গোলগোল হাত বাড়িয়ে অর্শিয়া বুকে তুলে নিল ওকে .."ওমা! তুমিও ব্যাথা পেয়েছ আমার মতন? তোমারও বুঝি মা হারিয়ে গেছে? আচ্ছা, আমি তোমার জন্যে দুয়া করছি।" আর্শিয়ারা আসলে আল্লাহের ফরিস্তা, তাই ওপরের দুঃখে তারা নিজেদের কষ্ট ভুলে যায় ---- "আল্লাহ তুমি ওর মা কে প্লিজ খুঁজে দাও, প্লিজ!" তারপর সেই পুতুল কোলে নিয়ে স্তূপের সামনে যে কতক্ষন কাটিয়েছে, তা আর ওর মনে নেই। শুধু মনে আছে ওমার দাদা, ফরিদ দাদা আর শাবানা দিদিদের সাথের সেই লম্বা সফরের আবছা ঝলক।
আসলে কিছুক্ষণ আগে মৃতুদূত হয়ে আসা বোমাটা ছিনিয়ে নিয়েছে এদের প্রিয়জনদের…. মা বাবার স্নেহচ্ছায়া থেকে টেনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে কাঠফাটা রোদ্দুরের রূঢ় পৃথিবীতে! তাই এরা সবাই চলেছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে, দানাপানির খোঁজে, নিস্তরঙ্গ জীবনের খোঁজে… আলেপ্পো ছেড়ে, সিরিয়া ছেড়ে ….
ধরাম্ ! হঠাৎ এক কানফাটা বিস্ফোরনের শব্দ! চেনা মুখগুলোর লুকোচুরি…ধুলো ধোয়ার ঝড়… আর মা… মা কোথায় যাচ্ছে ? " মা!মা!" কাঁদতে কাঁদতে উঠে বসে আর্শিয়া।ওর ইচ্ছা হল এক ছুটে মায়ের কোলে সেঁধিয়ে যায়, মায়ের আদরের জাদুকাঠিতে ভুলে যায় এইসব ভয়ঙ্কর স্মৃতি। কিন্তু এখানে মা কই? এ তো ইরাকের রিফিউজি ক্যাম্প…
সেদিনের ৪ বছরের আর্শিয়ার থেকে আজকের এই ৫ বছরের মেয়েটা অনেক বড়। সে যে জানে এখানে কেউ তাকে কোলে বসিয়ে আদর করে খাইয়ে দেবে না.. দেয় ও নি এই এক বছরে কোনোদিন। এখানে দিনশেষে নিজেদের খাবার আর্শিয়াদের,শাবানাদের, ওমারদের নিজেদেরই জোটাতে হয়। হাড়গিলগিলে হাতদুটো তাই চট করে মুছে ফেললো জল টলটলে চোখের কোণ। বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা পুতুলটাকে একটু আদর করেই পা দুটো পলকা শরীরটাকে কাঁধে চড়িয়ে ছুটল ব্যারেল ব্যারেল জল ভরতে। এটাই আজ তার সারাদিনের কাজ।
ভোরের নরম আলোয় গা ভিজিয়ে জল ভরতে ভরতে আর্শিয়া গুনগুনিয়ে উঠলো ওর প্রিয় আরবি গানটা। এখানের এক গান-দাদার কাছ থেকে শিখেছে ও ----
" সারা পৃথিবী জুড়ে, সবার ঘরে ঘরে গরম ভাতের গন্ধ থাক ,
তোমার দেশের,আমার দেশের, সব মানুষই যত্নে থাক… গরম ভাতের গন্ধ থাক ….. "