রক্তদান
রক্তদান


ক্রিং ক্রিং ক্রিরিং ক্রিরিং --,ল্যান্ডফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠল। ওপাশ থেকে তপ্ত স্বর,"কোথায় থাকো মা? মোবাইল বেজে বেজে কেটে গেল,হাতের কাছে রাখতে পারো না?" রিনা মেয়েকে শান্ত করতে চেষ্টা করে,"হ্যাঁ হ্যাঁ,রাখব রাখব,বল মামণি কি হয়েছে এত উত্তেজিত কেন?" মেয়ে সুমি একেবারে বেড়ালছানার মতো নরম হয়ে গেল,"ওমা,মা,শোনো না,আমাদের না ক্যাম্পাসিং শুরু হয়ে গেছে আর দু-তিনজনের পরেই আমার ডাক আসবে।" রিনার বিস্ময়,"ওমা সেকি,তুই যে বললি তোর S দিয়ে নাম তাই শেষের দিকে ডাক আসবে,তা কি হল,আজকেই?" "অতশত জানিনা আমাকে বলেছে আর দু-তিনজনের পরে ডাকবে,আর বেশি কিছু জানিনা আমি। শোনো না,অত বাজে কথা না বকে আমার জন্য একটু প্রে কর না মা প্লিজ,যাতে এই কোম্পানিটাতে আমার লেগে যায়,খুব বড় কোম্পানি মা,whole world এ এদের বিজনেস,পরিচিতি।" "ওমা,সেকি তোকে বলতে হবে? আমার মেয়ের জন্য আমি প্রে করব না? তুই কিচ্ছু চিন্তা করিস না,ঠিক লেগে যাবে তোর এখানে দেখিস,আমি মা,আমি বলছি। কেবল ঠান্ডা মাথায় ইন্টারভিউটা দে দেখি।" "Thank you maa,love you so much".
ফোন রেখেই রিনা চোখ বুজে দুই হাত জোর করে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করে,"মা গো মা,মেয়েটার দিকে মুখ তুলে চাও,ওর মনের আশা পূর্ণ কর,আমি তোমায় জোড়াপাঁঠা বলি দিয়ে পুজো দেব"। আবেগে কখন রিনার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এসেছে। রিনার মাথায় এখন আর কিছু নেই অহরহ ঠাকুরকে ডেকে চলেছে,"মাগো মেয়ের মনের আশা পূর্ণ কর"। বুকের ভেতরের ওঠানামাটাও বেশ জোরে হচ্ছে বুঝতে পারছে রিনা। ঘন্টা তিন পরে মোবাইলের পর্দায় মেয়ের নাম ভেসে উঠতেই রিনা খপ করে তুলে নিল মোবাইলটা,"হ্যাঁ মামনি,বল বল,কি হল?" "কি আনন্দ মা আজকে আমার উফফ,আমি সিলেক্টেড মা,৯ লাখ টাকা প্যাকেজ,হায়েস্ট প্যাকেজ অঙ্কুশ পেয়েছে ১১ লাখ, সেকেন্ড আমি মা ৯লাখ"। "এবারে তুই বাড়ি এলেই আগে মা কালীর পুজোটা দিয়ে দিতে হবে জোড়া পাঁঠা বলি দিয়ে"। "তার মানে? কি বলছ মা তুমি?জোড়া পাঁঠা বলি?" "হ্যাঁ রে মামণি,তুই ফোন করে প্রে করতে বলার সঙ্গে সঙ্গে ঐটাই মাথায় এল,মনে মনে বলে ফেললাম। আর এখন তোর চাকরির খবরে কি যে আনন্দ হচ্ছে সে আমি বলে বোঝাতে পারব না।" রিনা হাসছে আর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে নামছে গাল বেয়ে। "তা তো বুঝলাম,কিন্তু এ তুমি কেমন মানত করে ফেললে মা? তুমি তো জানো ছোট থেকে আমি রক্ত দেখতে পারি না আর তাই তোমায় বলে রেখেছিলাম ডাক্তারি আমি পড়ব না কিছুতেই যদিও তোমার ইচ্ছা ছিল আমি ডাক্তার হই।" "কি আর করা যাবে মামণি,বলে ফেলেছি যখন মানতেই হবে।"
ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে সুমি বাড়ি আসে তার চার মাস বাদে। দু'মাস বাকি চাকরি জয়েন করতে,এই দু'মাস বাড়ি থাকবে ও। কতদিন পর একটানা এতদিন বাড়িতে থাকতে পাবে সুমি। কালীবাড়িতে যায় বাবা-মায়ের সঙ্গে কবে পুজো দেওয়া যায় সে ব্যাপারে কথা বলতে কিন্তু মানতের কথা শুনে পুরোহিতমশাই বলেন,"এখন তো পাঁঠাবলি বন্ধ হয়ে গেছে,মন্দিরেও আর বলি হয় না,সব জায়গাতেই বন্ধ,জোড়াপাঁঠা কেন একটা পাঁঠাও বলি দিতে পারবেন না আপনারা।" মায়ের ব্যাকুল প্রশ্ন,"তাহলে উপায়?মানসা পূরণ হবে কি করে?" পুরোহিত মশাই কিছুক্ষণ ভেবে বলেন,"পাঁঠাবলি কোনোমতেই সম্ভব নয় কিন্তু মাকে রক্ত দেবেন যখন বলেছেন তখন পুজোর সময় নিজের বুক চিরে রক্ত আপনাকে দিতে হবে।" সুমি দু'হাতে চোখ ঢেকে ফেলে,রক্ত,তাও আবার মায়ের বুক চিরে!" পুরোহিত শান্ত করেন ওকে,"না না ভয় পাবার কিছু নেই,অনেকেই করে থাকেন এমন,বুকের এক পাশে বেলকাঁটা ফুটিয়ে একটু রক্ত বার করে দিলেই হবে নিয়ম রক্ষে।" এরপর দিনক্ষণ দেখা হল।
নির্দিষ্ট দিনে সুমি মায়ের একটা লালপাড় সাদা শাড়ি পর়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে চলল কালীবাড়ি পুজো দিতে। বেলকাঁটা রেডি। পুজো হল,অঞ্জলি হল,এবার রক্তদান। পুরোহিত বেলকাঁটা ধরিয়ে দিলেন মায়ের হাতে কিন্তু সে বেলকাঁটা কিছুতেই ফোটানো যায় না,রক্তও বার হয় না। অনেক চেষ্টা করে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অবশেষে একটু রক্ত বার হল,ততক্ষণ সুমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে। তার মা তার জন্য নিজের বুকে ব্যথা দিচ্ছে এটা ও সহ্য করতে পারছে না কিছুতে,রক্ত বেরোলে বেলপাতায় লাগিয়ে পুরোহিতের হাতে দিল রিনা। সুমি মাকে জড়িয়ে ধরল। রিনা মেয়েকে আদর করে বলল,"আমার লাগে নি রে সোনা,সন্তানের মঙ্গলের জন্য একফোঁটা রক্ত মায়ের চরণে দিতে পারলাম,এ আমার পরম সৌভাগ্য। এ আমার জীবনের স্মরণীয় মুহূর্ত হয়ে থাকবে চিরকাল।"