রেজারেকশন
রেজারেকশন


শহরে আসার ঠিক তিন বছরের মাথায় হাশেম আলি ঠিক করলো, সে আর রাজমিস্ত্রির কাজ করবেনা।
এই তিনবছরে সে কোথায় কোথায় কাজ করেনি? ফ্ল্যাট বানিয়েছে, বাড়ি বানিয়েছে, দোকানপাট, রাস্তাঘাট সব বানিয়েছে। তার মতো অগুন্তি হাশেম আলি এই শহরে উদয়াস্ত কাজ করে চলেছে। মাটির উপরে কংক্রিট চাপা দেবার কাজ। মাটির দীর্ঘশ্বাস চাপা পড়ে গেছে কংক্রিটের নীচে। সর্বংসহা মা, যে মা তার তার বুকের রস নিঙড়ে তৈরি করে খাবার, তার সন্তানদের জন্য।
এখন তো পুরো শহরটাই বাঁধানো হয়ে গেছে। হাসেম আলি পায়ের নীচে মাটির পরশটুকুও আর পায়না। মায়াবী পরশটুকু। পাখির কলকাকলি নেই। বাতাস আর বইছেনা। সমস্ত মেঘ উড়ে চলে গেছে মহাশূন্যে, অন্য কোন গ্রহ খুঁজে নিতে, সজল সবুজ করে দিতে।
সেরাতে হাশেম আলি স্বপ্ন দেখলো, ধরিত্রী মা কেঁদে কেঁদে তাকে বলছে, "বা'জান, কেমন পোলা তুই? মা'র বুকে পাথর চাপা দিছস। মা'র বুকের দুধ খাইবার লগে আর কেউ রইলো না রে। আমার বুক যে দুধে ভরভরন্ত হইয়া আছে। খাইবার জন্য একটাও সন্তান আর নাই আমার। বড় কষ্ট, বা'জান, বড় কষ্ট।"
পরদিন সকালে হাশেম আলি দেখলো, শহরের শেষ জারুল আর অমলতাস আর কৃষ্ণচূড়া গাছের মৃতদেহ পড়ে আছে শহরের মাঝে। মূর্খ মানুষ তাদের মৃতদেহ টুকরো টুকরো করছে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাশেম আলি দাঁড়িয়ে প
ড়ে শহরের মাঝখানে। আমি নিজের হাতে মায়ের গলা টিইপ্যা মারছি , নিজেই ফিরায়ে আনুম তারে। সে দাঁড়িয়েই থাকে অনড়। ক্রমশ মলিন হয় তার বসন। চিড় ধরে তার চামড়ায়। তার গায়ে এসে বাসা বাঁধে অসংখ্য প্রাণ। পরম মমতায় হাশেম আলি আবাহন করে প্রাণের। তার মাথার চুল বাড়তে বাড়তে মাটি ছোঁয়। গরমে গলে যাওয়া পিচ রাস্তার ফাঁক দিয়ে তার শিকড় প্রোথিত হয় ধরিত্রীর অভ্যন্তরে। শীতল হয় তার কলিজা। যেন সারাদিনের কাজের শেষে ক্লান্ত সন্তান প্রত্যাবর্তন করলো মাতৃক্রোড়ে। অসম্ভব ধৈর্যবান হাশেম আলি দেখে, দূরান্ত থেকে আরো অসংখ্য হাশেম আলি আর হারু মন্ডল আসছে এই শহরে, সব শহরে। তারা সবাই এসে দাঁড়িয়ে পড়ে রাস্তার উপরে, ফ্লাই ওভারে, শপিং মলে, বাড়ি ঘর ফ্ল্যাট কমপ্লেক্স রেস্টুরেন্ট- কিচ্ছুটি বাদ যায়না। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে তাদের ছায়া।
মূর্খরা চেষ্টা করে তাদের সরিয়ে দিতে।
কিন্তু অগ্নি তাদের দহন করেনা।
কুঠার তাদের গায়ে ছিদ্র করেনা।
বাতাস তাদের গায়ে বুলিয়ে দেয় তার স্নিগ্ধ পরশ।
পাখিরা ফিরে আসে। তাদের দেহ থেকে বেরনো শাখা প্রশাখায় দোল খায়।
অবশেষে একদিন গভীর কালো মেঘে ছেয়ে যায় চারিদিক। শনশন করে বয়ে যায় বাতাস।
বৃষ্টি নামে।
নতুন বেরনো সবুজ পাতা দিয়ে সব নাগরিক গ্লানি শুষে নিতে থাকে হাশেম আলি আর তার ভাই বেরাদররা।