রাজনৈতিক ক্রুসেড
রাজনৈতিক ক্রুসেড
ক্রুসেডের রাজনীতি ও আজকের ভারত/ রূপঙ্কর দে
ইতিহাস আমরা কেন পড়ি বা অন্য ভাবে বলতে গেলে ইতিহাস চর্চা আমাদের কি শিক্ষা দেয়? এই প্রশ্নের একটি সার্বিক গ্রহণ যোগ্য ধারার উত্তর হোল- অতীতের ভুল সিদ্ধান্ত ও তার ফলাফল বর্তমান বা ভবিষ্যতে পুনরাবৃত্তি না হওয়া। ইতিহাস সচেতন মানুষ ও সমাজ সব সময়ই একটি আপাত শান্তি পূর্ণ সহাবস্থানের সমাজ ব্যাবস্থা কায়েম করেছে বা রেখেছে। উল্টোদিকে এই ইতিহাস শিক্ষার বিমুখতা বা ইতিহাস সচেতনতার অভাব একটি সমাজ ব্যাবস্থা কে সার্বিক ভাবে ভঙ্গুর ও অসহনীয় করে তুলতে পারে।
আমরা সকলেই ক্রুসেড নামক ধর্ম যুদ্ধের কথা জানি।সামগ্রিক অর্থে ক্রুসেড খ্রিষ্টীয় সমাজ এবং মুসলমান সমাজের মধ্যের ধর্মীয় যুদ্ধ হলেও আক্ষরিক অর্থে, এই যুদ্ধ মূলত রাজনৈতিক,এবং অর্থনৈতিক কারণ কে কেন্দ্র করেই সংগঠিত হয়। পোপ আরবান-২ যিনি এই যুদ্ধে সমস্ত খ্রীষ্ট সমাজ কে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি কিছুটা নিজের স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য এই যুদ্ধকে ধর্মের রঙ দেন। এইটুকু পড়ে হঠাৎ আপনার মনে হতে পারে আমি ইতিহাসের কোন ঘটনা বোঝাতে শুরু করলাম। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য হল ক্রুসেডের- রাজনীতিতে ভারতবর্ষের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বোঝা।
আমরা কেউই এই ১০৯৬-১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ধর্ম আন্দোলনের সময় জন্মাইনি কিন্তু কালচক্রের এমনই পরিহাস যে একাদশ শতকের এই ঘটনা আবারও নতুন করে পরবর্তী ইতিহাসে লেখা হবে। এই লেখায় আমার মূল বক্তব্য হল প্রায় ১০০০ বছরের আগের ক্রুসেডের রাজনীতির সাথে বর্তমান ভারতের রাজনীতির তুলনা মূলক আলোচনা ও যুক্তি পূর্ণ সাদৃশ্য খোঁজা। নিচের কিছু তত্ত্ব ও তথ্য ভিত্তিক উপস্থাপনা আমার বক্তব্যের সপক্ষে যুক্তি খুজতে সাহায্য করবে।
গত ২৭ বছর আগে ভারতবর্ষের মাটিতে উত্তর প্রদেশের অযোধ্যা নামক একটি জেলাকে কেন্দ্র করে আবারও নতুন করে এক ধর্ম আন্দোলন শুরু হয়। বাবরী মসজিদের ধ্বংস (১৯৯২) এবং রাম জন্ম ভূমিতে রামের মন্দির নির্মাণ কে কেন্দ্র করে, যা আমাদের দেশের ধর্ম নিরপেক্ষ আদর্শকে নস্যাৎ করে দেশবাসীকে ধর্মের নামে দ্বিধাবিভক্ত করে দেয়। এই ঘটনার সূত্রপাত হয় "হিন্দু হৃদয় সম্রাট" লাল কৃষ্ণ আডবাণীর গুজরাটের গান্ধী নগরে দেওয়া বক্তৃতা (১৯৯০) দিয়ে, যা হিন্দু সমাজের সংখ্যা গরিষ্ঠ ধর্মভীরু লোকেদের ধর্ম উন্মাদনাকে জাগিয়ে মুসলিম বিদ্বেষ তৈরি করে। ঠিক যেমন পোপ আরবান-২ তার ক্লেরমন্টে দেওয়া বক্তৃতার (১০৯৫) দ্বারা সম্পূর্ণ খ্রীষ্ট সমাজকে আবেগ তাড়িত করার চেষ্টা করে। পোপ আরবান-২ বলেন যে ভাবে সেলযুক তুর্কিরা খ্রীষ্টানদের পুণ্যভূমি জেরুসালেম কে অধিকার করেছে ঠিক তেমন ভাবেই একদিন খৃষ্টধর্মালম্বিদের অস্তিত্বও ইউরোপের মাটি থেকে মিটিয়ে ফেলবে এই মুসলমানরা। তাই সমস্ত খ্রীষ্ট সমাজকে যে করেই হোক এই যুদ্ধে নামতে হবে এবং তাদের পূণ্যভূমি রক্ষার মাধ্যমে পূণ্য লাভ করতে হবে। অনেকটা পোপ আরবান-২ মতই, লাল কৃষ্ণ আডবাণী হিন্দুত্বের স্বার্থ রক্ষার্থে হাজারো নিরীহ মানুষের প্রাণের ব্যাপারে একটি বারের জন্যও ভাবেননি, এবং তিনি বেরিয়ে পড়েন রাম রথ যাত্রায়। পরবর্তী কালে এই যাত্রা তথা আন্দোলনের মূল দাবি হয়ে ওঠে রাম মন্দির নির্মাণ। এই ঘটনার সাথেই দুটি বিখ্যাত স্লোগান সকলের মুখে মুখে আলোচিত হতে শুরু করে জয় শ্রী রাম এবং মন্দির ওহী বানায়গে যা পরবর্তী সময়ে যুদ্ধ ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়।
কিন্তু বাবর নামায় অর্থাৎ বাবরের জীবনীতে কোথাও অযোধ্যা দখল বা সেখানে মন্দির ভেঙে মস
জিদ তৈরীর কথা লেখা নেই। তাই হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠীর দ্বারা প্রচারিত এই তথ্য সম্পূর্ণ অসত্য। সেখানে কোনো মন্দির ছিল যা বাবর ধ্বংস করেছিলেন। উল্টে তারা কখনো বলেন না যে আকবরের মত মুঘল সম্রাট মন্দির বানাবার জন্য হিন্দুদের জাগীর দিয়েছিলেন এবং হিন্দু রাজ কুমারীকেও বিবাহ করেছিলেন। আসলে ব্রিটিশরাই হিন্দুদের মধ্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এই ধারণা তৈরি করে, যা দেশ স্বাধীন হবার কয়েক দশক পর থেকেই হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠীরা নতুন করে পোষন করা শুরু করে। যার ফল স্বরূপ সারাদেশে ধর্মীয় হিংসা এবং বিদ্বেষের রাজনীতি শুরু হয়।
এবার ফিরে যাই আডবাণীর রথ যাত্রার কথাতে। দেখতে গেলে এই রথ যাত্রা রাম মন্দির নির্মাণের ভূমি প্রস্তুতি হলেও, এর পেছনে একটি কুট নীতি নির্ধারিত হয় আডবাণীর দ্বারা। ১৯৮৪ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি কেন্দ্রে সরকার গঠনের ভোটে ভরা ডুবির পর আস্তে আস্তে ঘুরে দাড়াবার ছক কষতে শুরু করেন। তিনি তাঁর গুরু বীর সভারকারের প্রভু ইংরেজদের দেখানো পথেই ভাগ বাটোয়ারার নীতি নির্ধারণ করেন। খুব চতুর ভাবে সুদো সেকুলার পার্টি কংগ্রেসের মুসলমান তোষণের নীতিকে বহু সংখ্যক হিন্দু মানুষের মধ্যে তুলে ধরেন এবং একটি মিথ্যে ভয় তৈরি করেন তাদের মধ্যে যে হিন্দু ধর্ম বিপত্তিতে আছে যা হিন্দি ভাষায় বলা হয় "হিন্দু খাত্রে মে হায়"। ঠিক যেমন পোপ আরবান ২ তার শিষ্য গণের কাছে একটি ভয় সৃষ্টি করে ছিলেন যে খ্রিস্টানরা যদি ক্রুসেড ঘোষণা না করেন তাহলে সম্পূর্ণ মুসলমান সমাজ তাদের অস্তিত্ব মিটিয়ে ফেলবে। কিন্তু আসল কারণ ছিল যে সেই সময় পোপের পদের মর্যাদা সামান্য ক্ষয় হয়েছিল এবং সেটি তিনি যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে ফিরে পেতে চেয়েছিলেন। ঠিক তেমনই নিজের পার্টির মর্যাদা রক্ষার্থে এবং পরের নির্বাচনে কেন্দ্রে সরকার গঠনের স্বপ্ন দেখে হাজারো নিরীহ মানুষকে ধর্মের নামে একে অপরের রক্ত পিপাসু করে তুলেছিল। রাম মন্দির নির্মাণ কিছুই না এটি একটি ভাঁওতা মাত্র আসলে এটা একটি কুট নীতি যা পরবর্তী কালে তাদের পার্টির আসন সংখ্যা বাড়িয়ে তোলে ২ থেকে ৮৫, ৮৫ থেকে ১৮২ এবং অবশেষে ৩০৩।
অন্য আরেকটি দিক থেকে ক্রুসেডের যুগের সঙ্গে বর্তমান সময়ের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। একাদশ শতকের সময় পশ্চিম ইউরোপে দেখা দেয় তীব্র কৃষির সংকট, যার ফলস্বরূপ তীব্র বেকারত্ব ও কর্মহীনতা সাধারণ মানুষকে গ্রাস করে বসে। এই সংকট কালে পোপ আরবান ২ ঘোষণা করেন সমস্ত কর্মহীন মানুষকে ধর্ম যুদ্ধে অংশ নিতে। সঙ্গে তিনি নিধান দেন এই ধর্ম যুদ্ধ কর্মহীন মানুষের মুক্তি লাভের পথ সুগম করবে এবং জীবিকার দিশা দেখাবে। ঠিক একই ভাবে বর্তমান ভারতের কর্মহীনতা ও অর্থনৈতিক সংকটের মাঝে ধর্মীয় আবেগের বুদবুদ তুলতে পারলে সাধারণ মানুষকে এই সংকটের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা যাবে এবং এই সুযোগে দলে দলে বিজেপির সদস্য সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটবে।
ক্রুসেডের যুগেও যেমন ইতালির বণিকেরা যুদ্ধে টাকা যোগান দিয়েছিলেন ঠিক তেমনি আজও কিছু ব্যাবসায়ী তাদের ব্যাবসা স্বতস্ফূর্ত ভাবে চালাবার জন্য কোটি কোটি টাকা যোগান দিয়ে চলেছে নিজেদের পরিচয় আত্ত গোপন করে।
শেষ করবার আগে বলা দরকার যে বহু বছরের এই রক্তক্ষয়ী ক্রুসেডের সংগ্রামে হাজারো মানুষের প্রাণ যায় এবং খ্রীষ্ট সমাজের মোক্ষ প্রাপ্তি অধরা থাকে। ঠিক সেই ভাবেই আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এই ধর্মযুদ্ধ যেই জিতুক হেরে যাবে কিন্তু ভারতবর্ষ। তাই প্রত্যেক মানুষের ইতিহাস জানা এবং ইতিহাস সচেতন সমালোচনা মূলক চিন্তা ভাবনা জিইয়ে রাখা খুব প্রয়োজন আজ।