Rinki Banik Mondal

Inspirational

3  

Rinki Banik Mondal

Inspirational

পতিতার জয়

পতিতার জয়

6 mins
679


  ১

 -----"বৌমা এক কাপ চা দেবে?"

 -----"হ্যাঁ বাবা। এক্ষুনি আসছি। আসলে বাবা কালকে পাড়ার প্যান্ডেল থেকে ফিরতে একটু দেরি হয়ে গেছিল, ছেলেমেয়েগুলোর এতদিন পরীক্ষা চলছিল, ঠিক মতো সময় পায়নি। তাই কাল একটু বেশি সময় ধরে ওদের নাটকের প্র্যাকটিসটা করাচ্ছিলাম।"

 -----"আচ্ছা, আমি কি তোমার কাছে এত কৈফিয়ৎ চেয়েছি বৌমা? আমি জানি তুমি কি ভেবেছিলে, যে আমি তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলাম। মোটেও না, ও তোমার মা ঘুমিয়ে পড়ে তাড়াতাড়ি। আমি না। কিন্তু কি বলতো মা, তোমার হাতের চা না হলে যেন সকালের সুন্দর আমেজটা নষ্ট হয়ে যায়। যাও যাও তুমি এখন যাও, আবার তো তোমায় অফিস যেতে হবে, পরী'কেও তো স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি করতে হবে। বিনয়'ও তো অফিস বেরোবে।"

 -----"হ্যাঁ বাবা। ঠিক আছে। আমি এখন যাই।"

তনয়ার সারাদিনের কাজকর্মের বিরুদ্ধে কখনো কোনো অভিযোগ করার সুযোগ কেউ পায়নি। ও সবার সব প্রয়োজনে পাশে থাকার চেষ্টা করে। স্বামী থেকে শুরু করে শ্বশুর-শাশুড়ি সবাই ওর প্রশংসা করে। তনয়া একদিকে যেমন সংসার সামলাচ্ছে, ঠিক সেরকমই মেয়ের পড়াশুনা, খাওয়া-দাওয়া, আবদার অভিযোগের দিকেও খেয়াল রেখেছে। তার সাথে অফিস তো আছেই।

 -----"মা, আজ টিফিনে কি দিয়েছ?"

 -----"তোর পছন্দের চিঁড়ের পোলাও।"

 -----"বা বা! দারুন, কি মজা!" এই বলে তনয়ার মেয়ে পরী দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল।

সকালে খাওয়ার টেবিলে খেতে বসে পরীর এই কান্ড দেখে তনয়ার শাশুড়ি রাগে একটু বিড়বিড় করতে লাগলেন। যদিও এর কারণ পরী আর বিনয় মানে পরীর বাবার জানা নেই, তবে কারণটা হয়তো তনয়ার জানা আছে। সকালের ব্রেকফাস্ট করে বাবা আর মেয়ের, অফিসে আর স্কুলের জন্য বেরিয়ে যাওয়ার পরে তনয়ার প্রতি শাশুড়ির গুরুগম্ভীর গলার প্রশ্ন-

 -----"মেয়েটাকে একটু বোঝাও বৌমা। এত দৌড়াদৌড়ি এই সময় ভালো না। আর যখন তখন ঠাকুর ঘরে চলে যাচ্ছে, রান্নাঘরে চলে যাচ্ছে, এগুলো কি ঠিক বৌমা? আমাদের সময় তো এক ঘরে করে রাখত।"

 -----"আমি আপনার বক্তব্য জানি মা। কিন্তু ও তো খুব ছোট। সবে তো বারো বছর বয়স। একটু একটু করে সব শিখে যাবে মা। আর ঋতু বিষয়ে আচার বিচার তো এক ধরনের কুসংস্কার। যুগ পাল্টেচ্ছে, আমাদেরও তো একটু পাল্টাতে হবে। যতটুকু না মানলে নয় ততটুকুই নয় ও মানুক। কিন্তু জোর করে ওর ওপরে এসব আচার-বিচার চাপিয়ে দিয়ে ওর মেয়েবেলাটা নাইবা নষ্ট করলাম। আর এইটা একটা স্বাভাবিক পদ্ধতি। এইটাই তো নতুন প্রাণের আধার।"

 -----"কি যে বলি, কথায় যুক্তি থাকলেও যে মন মানে না। তোমার সাথে তর্ক করতেও আমার ভালো লাগে না। কিন্তু..."

 -----"কোন কিন্তু নয় মা। এবার শুরুটা নয় আমরাই করি। সব ভালো হবে মা। আচ্ছা, মা আমি এখন আসি। না হলে অফিস টাইম, বাসে যা ভিড় হয়! আমি দুই রকম তরকারি করে গেছি। রমাদি শুধু ভাত আর মাছের ঝোলটা করছে। সময় মতো ওষুধ আর খাবারটা খেয়ে নেবেন। বাবাকেও দেখে রাখবেন।"

 -----"ঠিক আছে বৌমা। তুমি সাবধানে যেও।

 -----"এত জামাকাপড় কেনার কি দরকার বৌমা? আলমারি ভর্তি তো জামাকাপড়।"

 -----"সে তো জানি বাবা। আমি চাকরি করছি, তাই কিনতে পারছি। বছরে একবারই তো। কি হবে টাকা রোজগার করে যদি সেটা খরচাই না করি।"

 -----"তুমি তো এমনিতেই সবদিক সামলে আমাদের এত ভালো রেখেছ, আর কি দরকার?"

 -----"দরকার আছে বাবা। এই দেখুন রমাদি আর ওর ছোট্ট ছেলেটার জন্য এইগুলো কিনে এনেছি।"

 -----"সে ভালো করেছ মা। পুজোর দিনে ওরাও খুশি থাকুক। পনেরো বছর আমাদের সংসারটা তুমিই তো আনন্দে ভরিয়ে রেখেছ।"

 -----"আপনার ছেলে একটা দারুন জিনিস এনেছে আপনার জন্য।"

 -----"আবার বিনয়'ও জামা কাপড় কিনেছে নাকি?"

 -----"না বাবা। এই দেখুন আপনার খারাপ হয়ে যাওয়া রেডিওটা দোকান থেকে সারিয়ে এনেছে। কাল যে মহালয়া। আপনি তো রেডিওতে মহালয়া শুনতে পছন্দ করেন।"

 -----"আমি খুব খুশি হয়েছি বৌমা। জানি এটা তুমিই বিনয়কে মনে করে বলেছ। ওর এসব ব্যাপারে খোঁজ নেওয়ার সময় কোথায়? দশকাজ তো তুমিই সামলাও।"

 -----"ঠিক আছে বাবা, আমি এখন একটু বাপের বাড়ি যাচ্ছি। নতুন জামা কাপড়গুলো ওই বাড়িতে দিয়ে আসি। রাত্রে তো আবার প্যান্ডেলে ঠাকুর আসবে। তৈরী থাকবেন, একসাথে যাব।" 

প্যান্ডেলের ঠাকুর আসতে দেরি হচ্ছে দেখে পরীর তার মায়ের কাছে একই প্রশ্ন বারবার-

 -----"আর কতক্ষণ? ঠাকুর কখন আসবে মা?"

 -----"আসবে আসবে" এই বলে তনয়া ওকে শান্ত করতে ব্যস্ত।

ঐদিকে তো পাড়ার অন্যান্য গিন্নীদের সাথে কথা বলতেই ব্যস্ত তনয়ার শাশুড়িমা। কার বাড়িতে কি হয়েছে, কেন, কি ব্যাপার, উফ্! সে কত কথার ঝুলি! কেউ শাশুড়ি, আবার কেউ তার বৌমার নামে নিন্দাও করছে। তনয়া ভাবে, সে যদি সংসারটা ঠিকমতো করতে না পারতো, কিংবা ও যদি চাকরিটা না করতো, তাহলে হয়তো ওর শাশুড়িমা'ও ওর নামে নিন্দা করতে পারতো, কে জানে হয়তো তাই, অথবা তাই নয়, ওর ভাগ্যটা হয়তো ভালো। এইসব নিয়ে তনয়া বেশি ভাবতেও চায় না।

তনয়ার শ্বশুরমশাইও দেবী মায়ের আসার অপেক্ষায় মন্দিরের সিঁড়িতে বসে আছেন। বিনয় ঠাকুর আনতে গেছে। তনয়ার আজ ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। আবার একটা বছরের অপেক্ষার পর উমা তার বাপের বাড়ি আসছে। কচিকাঁচাগুলোও যে বড্ড খুশি। এরইমধ্যে পাড়ার ঘোষগিন্নী বলে উঠলেন- "ঐতো ঠাকুর চলে এসেছে।"

আহা কি সুন্দর মায়ের রূপ! অপার শক্তির ভান্ডার রয়েছে যে এই দেবী মায়ের কাছে। দেবীর অপূর্ব রূপ দেখতে দেখতে তনয়া যেন কোথাও হারিয়ে গেছিল। এরইমধ্যে রায়গিন্নী আর রায়বাবুর চিৎকার-চেঁচামেচি। তাদের কথায় কোন এক পতিতালয়ের মেয়ে নাকি মায়ের পায়ে নমস্কার করেছে। এই নিয়ে শুরু হয়েছে বাকবিতণ্ডা। একেই তো কত রাত হয়ে গেছে, প্রায় একটা বাজতে যায়। তার মধ্যে আবার এই বচসার সূত্রপাত।

তনয়া ঐ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখল এতগুলো লোকের কথায় মেয়েটা একদম হতভম্ব হয়ে গেছে, এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। সেই মেয়েটি স্বীকারও করল যে, সে ভুল করেছে। কিন্তু কে কার কথা শোনে। একের পর এক নিন্দাবাক্য ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে মেয়েটির দিকে। এখানে তনয়ার কি করা উচিৎ বা কিছু করা উচিৎ কিনা, তা তনয়ার মাথাতেই আসেনি। কিন্তু ঐ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে যে তনয়ার বড় মায়া হল। তনয়া মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে বলল-

 -----"ছেড়ে দিন না। ও তো স্বীকার করল যে, দেবী মায়ের চরণ স্পর্শ করে ও ভুল করেছে। তাহলে এত কথা উঠছে কেন? একবার ভেবে দেখুন না সত্যিই কি দেবী মায়ের চরণ ছুঁয়ে ও ভুল করেছে? হতে পারে ও আপনাদের চোখে একটি নষ্ট মেয়ে। কিন্তু সবশেষে ও তো আমাদের মতই রক্তমাংসের মানুষ। কোন সদ্যজাত সন্তানের জন্য বলে হিজড়ারা খুব শুভ, তাদের স্পর্শ সন্তানদের জন্য শুভ। কখনো কোন হিজড়াকে মায়ের বরণ করতে দেখেছেন? কখনো কোন বিধবা মাকে মায়ের বরণ করতে দেখেছেন? যাদের আশীর্বাদে আমরা মনে করি আমাদের সন্তানের কল্যাণ হবে, তাদেরই মায়ের বরণে অনুমতি নেই। কারণটা হলো আমাদের এই সমাজ। ঠিক তেমনিই দুর্গাপুজোয় কিন্তু পতিতালয়ের মাটি লাগে। শাস্ত্র মেনেই কিন্তু এটা হয়ে থাকে। আমাদের সমাজের অনেক পুরুষরাই কিন্তু তাদের বাড়িতে গিয়ে যৌনখেলায় মাতে। আর ঠিক সেই কারণেই সেই পুরুষ তার জীবনের সমস্ত সঞ্চিত পুণ্য সেখানে ফেলে আসে। তার বদলে পুরুষ সেখান থেকে মুঠো ভর্তি করে নিয়ে আসে পাপ। বহু পুরুষের পুণ্যে সেখানকার মাটি পরিপূর্ণ। এককথায় সমাজকে বিশুদ্ধ রাখতে সাহায্য করে এই অশুদ্ধ বনিতারাই। আমাদের একবারও মনে হয় না, সমাজে এরা ছিল বলেই হয়তো কিছু ধর্ষণ রচনা বেঁচে গেছে। নারীকে পতিতা বানায় তো পুরুষরাই। তাহলে শুধুমাত্র ওদেরকে কেন দোষের ভাগি করা হবে? ওদের সামনেই তো নতজানু হয় হাজার হাজার বিশুদ্ধ পুরুষ, এ কি কম পাওয়া? আর মা দুর্গা তো সমগ্র নারী শক্তির প্রতীক। পতিতাও এই নারী জাতির এক অঙ্গ। যখন মা দুর্গার কাছে একসন্তান রূপে তার স্থান আছে, তাহলে সমাজের কাছে সে ঘৃণ্য কেন?"

তনয়ার আজকের কথায় পাড়ার মন্ডপে যেন এক নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটে গেল। তাতে যেন সমাজের চোখে সেই অশুদ্ধ মেয়েটি সকলকে হারিয়ে মহিষাসুরমর্দিনীর আশীর্বাদ নিয়ে যুদ্ধ জয়ের হাসি হাসল।

রাত কেটে ভোর হয়ে আসছে। তনয়ার শ্বশুরমশাই তনয়ার কাছে এসে বললেন-"চল মা। ঘরে চল। দশভূজা না হয়েও যে তুই দশকাজে পারদর্শী তা আমি জানতাম। কিন্তু তুই তো শুধু পারিবারিক দিক আর অর্থনৈতিক দিক সামলাস না রে মা, তুই তো গোটা সমাজকেও পাল্টানোর ক্ষমতা রাখিস, তুই তো অশুভকে বিনাশ করে আলোর পথ দেখাস। তাড়াতাড়ি চল। বাড়ি গিয়ে রেডিওতে মহালয়া শুনবো।"

আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর;

ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা;প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা।'


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational