পথ
পথ
বাবা, এবার কিন্তু পুজোয় আমার নতুন জামা চাই"- যুগিনের সাত বছরের মেয়ে যমুনার একটা সহজ দাবী। পুজোতে সে নতুন জামা পড়ে ঠাকুর দেখবে।যুগিন বলে- " ঠিক আছে মা। এখনো তো পুজোর ঢের বাকী। আজ কেবল সেপ্টেম্বরের দশ। হবে, তোদের সবার এবার নতুন জামা হবে।" মেয়ে হেসে বাবাকে আদর করে দেয়। বাপ মেয়ের ভালোবাসায় যেন স্বর্গীয় সুষমা নামে ওদের ফুটোফাটা দোচালা ঘরে। এক ছেলে, এক মেয়ে আর বউ তুলিকে নিয়ে যুগিনের ভরা সংসার। বছরখানেক আগে কারখানাটা বন্ধ হলে বউ তুলির পরিচারিকার রোজগারে কোনো মতে বস্তির ঠাসবুনটে জীবন চলতে থাকে। তবে ছেলে মেয়ে দুটো সরকারী স্কুলে পড়ে, দুপুরের খাবারটা ওখানেই পায়। লকডাউন কিছুটা শিথিলের পর মাসখানেক হলো যুগিন ৭৫ টাকা রোজ ভাড়ায় রিক্সা চালাচ্ছে। কিন্তু এখন টোটোর রমরমা বাজারে রিক্সার চাহিদা কম। তাছাড়াও মানুষের প্রতিদিনের জীবন সংসার হঠাৎ যেন ছন্নছাড়া। ভাড়াও খুব একটা মেলে না। মালিককে ভাড়ার টাকা দেবার পর হাতে বিশেষ আর কিছু থাকেও না। বউ তুলির একারপক্ষে সংসার খরচ মিটিয়ে নতুন জামা কাপড় কেনা বর্তমান অবস্থায় বিলাসিতার নামান্তর। তবু ও চেষ্টা করবে। মেয়ে চেয়েছে। মেয়ে তো জানে না গরীব বাবা হওয়ার যন্ত্রণা! ছেলে শচীন বোনের থেকে তিন বছরের বড়ো, তাই হয়তো ও এই বয়সেই বুঝে গেছে জীবনের জটিল হিসাব। বাবার কাছে তার কোনো আবদার নেই। উপরন্তু সে স্কুলে না গিয়ে বস্তির কাছে জীবনকাকার চায়ের দোকানে কাজ করে বাবাকে একটু সাহায্য করতেই চায়। যুগিন না করেছে। সে চায় না তার ছেলের জীবনও তার মতো অশিক্ষার হোক। বাবা হিসাবে সে তো এটুকু ছেলের জন্য করার ইচ্ছে বুকে লালন করতেই পারে! তার এই ইচ্ছে দেখে ভগবান বুঝি মুচকি হেসেছিলেন!
কষ্ট করে হলেও যুগিন আর তুলি এতোদিন কোনোমতে সামলে দিয়েছে সব। কিন্তু এই লকডাউনের সময় থেকে সব হিসেবে গোলমাল। তুলির কাজ প্রায় বন্ধই। সবাই এখনো সাহস পাচ্ছেনা আমাদের মতো ছোটলোকের সাথে পাশে আসতে। যেন অসুখটা আমরাই প্লেনে করে নিয়ে এসেছি দেশে! তুলির বেতনের টাকা পাওয়াটাও অনিশ্চিত। দয়ামায়া হলে বাবুরা দেবেন। দু একজন দিয়েছেনও, বাকীরা পরে দেবে বলেছেন। জমানো টাকাও কিছু নেই। অতোটুকু শচীনও বুঝে গেছে দুনিয়ার অঘোষিত নিয়ম! বাচঁতে হলে টাকা দরকার আর কিছু নয়! তাই তো সে কাজে নামতে চায়। রোজগারের টাকায় আদরের বোনকে জামা কিনে দিতে চায়। পড়াশোনা করে কি হবে? সে বুঝতে পারেনা।
যুগিন বেশ কিছুদিন থেকে ভাবছে কি করে এবার পুজোতে সবাইকে নতুন জামা কাপড় দেওয়া যায়? কূল কিনারা যদিও সে কিছু পায়নি। যমুনাকে বলেছিলো বটে, সবার জন্য সে জামা কাপড় আনবে। কি করে আনবে সে জানেনা। যদিও বউ বা ছেলে তার কাছে কিছু দাবি করেনি তথাপি তার জেদ চেপে গেছে।সে তো কোনো অন্যায় করেনি, তবে কেন সে সংসারের এই দাবিটুকু মেটাতে পারবে না? একটু ভালো করে কি বাচাঁর অধিকার নেই তাদের? এভাবে পোকামাকড়ের মতো বেচেঁ কী লাভ?
আজ যে করেই হোক একটা ব্যবস্থা করবেই সে। পুজোর আর মাত্র কুড়িদিন। সকালে বাড়ি থেকে রিক্সা নিয়ে বের হবার সময় পণ করেই বের হয়েছে। আলো না হয় আধাঁর কোনো একটা পথ সে নেবেই আজ!
সারাদিন রিক্সা চালিয়ে না খেয়ে ঘুরেঘুরে কোনমতে দুশো টাকা হলো। যাত্রী আর কোথায় পাবে, সবাই তো ঘরবন্দী। খুব দরকার ছাড়া কেউ বের হচ্ছেনা বাড়ী থেকে। কি একটা ভাইরাস এসেছে করোনা নাম, যুগিন ভালোই টের পাচ্ছে; কি করুনাটাই না,সে করছে তার জীবনে! বিগত সাত আট মাস ধরে জেরবার জীবন। একটু নিয়মকানুন শিথিল বলেই রিক্সা নিয়ে বের হতে পারছে নইলে তো প্রথম দিকে পুলিশে ধরে মারত। একবার সে নিজেও মার খেয়েছে। বড়োলোক হলে সেও বের হতো না কিন্তু চার চারটে পেটে আগুন, খিদের জ্বালা; কেউ বোঝো? কদিন আর মানুষের কাছে হাত পাতা যায়,সাহায্য নেয়া যায়; বস্তিতে থাকি বলে কি মান সন্মান নেই? আর যারা চাল ডাল দিতে আসেন তার সব ছবি তোলাতেই ব্যস্ত! স্বভাবে তো নয়, অভাবে পড়েছি বলে কি খেলার পাত্র হবো সবার কাছে?
এখন সন্ধ্যা সাতটা বাজে। খিদে ভালোই লেগেছে। সারাদিনে কোনো দানাপানি পেটে পড়েনি। রোজগারের এক টাকাও আজ সে খরচ করেনি। এই টাকায় কী হবে? কী করে দেওয়া কথা সে রাখবে? জলে চোখ ভরে উঠে। কান্নাই কি তার সম্বল? চোখ মুছতে মুছতে রাস্তা দিয়ে যেতে থাকে। রাস্তার পাশ দিয়েই গেছে রেললাইন। দেখতে পায় ট্রেন আসছে। কু ঝিক্ ঝিক্, কু ঝিক্ ঝিক্ মৃদুমন্দ শব্দ।আসছে ট্রেন। রিক্সা থেকে নেমে দাঁড়ায়। বিড়ি ধরায়। বিড়ি টানতে টানতে ট্রেন আসা দেখতে থাকে। আর মাত্রা ত্রিশ হাতখানেক দূরে ট্রেন । হঠাৎ যুগিন বিড়ি হাতেই লাইনের উপর শুয়ে পড়ে। আশেপাশে কে-ও-ও-ও-উ নেই। একদম নিশ্চিত! সবার জন্য নতুন জামা কাপড়ের ব্যবস্থা সে করতে পেরেছে! হলোই বা তা সাদা! শুয়ে বিড়িতে সুখটান দিতে দিতে হেসে ভাবে- যাক্ সততাই সর্বোকৃষ্ট পন্থা এবং তার যে শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার, আজ হয়তো তাই সে পাচ্ছে! স্বর্গে দাস হয়েই রইলো, নড়কে রাজত্ব করার মতো মনোবল আর পেল না। বিড়িটা ফেলে দিয়ে উপরের দিকে একবার তাকিয়ে মুচকি হাসলো। সে হাসির কী অর্থ তা কেউ জানতে পারবেনা। তারপর চোখ বন্ধ করলো। শেষবার। চোখ বন্ধ হতেই একেবারে কানের কাছে ট্রেনের হুইসিলের তীব্র শব্দ শুনতে পেল...
