ASHIS KARMAKAR

Classics

5.0  

ASHIS KARMAKAR

Classics

প্রমীলার ঝর্ণাকলম

প্রমীলার ঝর্ণাকলম

3 mins
974


বাস এ জানালার পাশের সিটটায় বসে একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি, তাই বোধহয় রাস্তার চেনা গর্তটায় যে ভীষণ রকমের একটা ধাক্কা লাগল তা বুঝতে পারিনি। তাতে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম। সংবিত্ কিছুটা ফিরে পেতেই দেখলাম, আমার পাশে যে বৃদ্ধ ব্যক্তিটি ছিলেন যার মুখের খাঁজগুলো শহরের ঐতিহ্যের বার্ধক্যকে জানান দেয়, সে হয়ত আগের কোনো এক স্টপেজে নেমে গেছে।বেশ কয়েক বছর প্রতি সোমবারেই অফিসফেরৎ প্রায় একরকম নিয়মমাফিক বই পাড়ায় যাই, পুরোনো অভিজ্ঞতার স্বাদ পেতে। তাছাড়া সারা সপ্তাহে নিজের অস্তিত্বটাকে যে কিছু বিবর্ণ ফাইলের মধ্যে আবদ্ধ রাখি, এই একটা দিনেই তাকে স্বাধীনতার আনন্দ খুঁজে দিই। হঠাৎ বৃষ্টি আসায় আজ অনেকটা দেরি হয়ে গেছে ফিরতে, তাই দেখলাম সূর্যও নিজেকে সমর্পণ করেছে দিগন্তের বুকে। তবে তার ক্ষীণ আভাটুকু গোধূলির পা ধুইয়ে দিচ্ছে। জানালার বাইরে চেয়ে দেখি বেশ কয়েকটি কৃষ্ণচূড়া, নিম গাছ ও ইউক্যালিপ্টাস হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের জৌলুস অনেকটাই কেড়ে নিয়েছে প্রকান্ড একটা বটগাছ।আমার ফেরার পথে শুধু এই জায়গাটাতেই গাছপালার একটু বাড়বাড়ন্ত। তাদের সবুজ চাদরের আড়ালে একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই একটা পুরোনো স্মৃতির ভগ্নাবশেষ স্পষ্ট দেখা যায়, একটা স্কুল। তাকে দেখেই নিজের ছাত্রাবস্থার কিছু প্রাসঙ্গিক ঘটনা অনায়াসেই মনে পড়ে যায়।


সেটা বোধহয় আশির দশকের গোড়ার দিকে হবে। সবে মাত্র প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে কয়েকটা বছর হয়েছে। আগেই বলে রাখি, আমাদের স্কুলটি ছিল কো-এড। তখন সদ্য হাফ প্যান্ট ছেড়ে ফুল প্যান্ট। তবে অবনী অবশ্য হাফ প্যান্টেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত। কারন স্কুল ফেরত অন্তত ঘন্টাখানেক ফুটবল তার চাই। অবনী ছিল রোগা ধরনের , লম্বাটে এবং মাথায় তার কোঁকড়ানো চুল। বন্ধুমহল বলতে এই অবনীই ছিল একমাত্র। আমরা দুজনেই মধ্যবিত্ত পরিবারের অন্তর্গত ছিলাম। তাই সাজ পোশাকে বা পড়াশোনার সরঞ্জামে কোনো বাড়তি আড়ম্বর ছিল না। হাঁটা পথেই দুজনে দু-মাইল পথ পেরিয়ে বাড়ি ফিরতাম। ক্লাসে বাড়তি বন্ধুত্বের প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না বলেই হয়তো কোনো মেয়ের সাথে তেমন আলাপ ছিল না।

ঠিক যে বছর ম্যাট্রিকুলেশন দেব সেবার বর্ষাকালে আমরা একদিন আঁকার ক্লাসে বসে আছি। বাইরে বৃষ্টি ঝমঝম করে পড়েই চলেছে , আর যেন শহরের রূপরেখাগলিকে আরো স্পষ্ট করে তুলছে। সবাই স্যারকে নকল করার চেষ্টায় খাতায় নানান আঁকিবুকি টানছে। এদিকে অবনী একমনে জানালার বাইরে দৃষ্টিপাত করে বসে আছে। ভেতরের চাঞ্চল্যের প্রতি তার কোনোরকম ভ্রূক্ষেপ নেই। তার মোহ ভাঙল একটা অচেনা কন্ঠে।দেখলাম অপরিচিত এক সমবয়সী মুখ দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে , যার সৌন্দর্যের বর্ণনায় হয়তো সমস্ত বিশেষণও কম পড়ে যেত। সমগ্র ক্লাসটাতে একবার দৃষ্টিনিক্ষেপ করে, সামনের একটা বেঞ্চিতে এসে সে বসল। পোশাক থেকে শুরু করে সমস্ত কিছুতেই শৌখিনতার কোনো ত্রুটি ছিল না । তার মধ্যে সবচেয়ে যেটা আকর্ষণীয় ছিল সেটা তার আঙুলের মাঝে কোনো এক বিদেশি কোম্পানির ফাউন্টেন পেন , তাতে স্পষ্ট খোদাই করে লেখা "প্রমীলা"।পরে জেনেছিলাম বাবার বদলির চাকরির জন্যেই তাকে সেখানে ভর্তি হতে হয়েছে। তারপর আমাদের চিরপরিচিত বন্ধুত্বের শর্তগুলি মুছে গেল অনায়াসেই। সমস্ত সামাজিক বৈষম্যকে অগ্রাহ্য করে আমরা তিনজনেই সাবলীল ভাবে যেন কোন অলিখিত চুক্তিতে বন্ধু হয়ে গেলাম। অবনীর মধ্যে যেন একটা অপরিচিত পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। প্রমীলার সেই ফাউন্টেন পেনে লেখা কিছু চিঠি অবনী আমাকে দেখিয়েছিল, লেখাগুলো যেন মুক্তোর ন্যায় স্পষ্ট। তবে সবগুলোই ছিল বন্ধুসুলভ।সেবছর বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর কথার ছলেই সে বলেছিল তার মা মৃত্যুর পূর্বে তার সবচেয়ে প্রিয় সেই কবিতা লেখার কলমটি তাকে দিয়ে যায়। এরপর বছর অন্তে যখন পরীক্ষা শেষের সুখ সবেমাত্র কিছুটা উপভোগ্য তখন সবাই একে একে ভিন্ন পথে হারিয়ে যায়। যোগাযোগের দুরবস্থা শেষ বিদায়টুকুও ফিরিয়ে দেয়। এরপর কেটে গেছে প্রায় নিরেট , একঘেয়ে ত্রিশটা বছর, কারোর কোনো দেখা মেলেনি।হয়তো বা তারাও নৈমিত্তিক মুখোশের ভিড়ে ছদ্মবেশ ভাড়া নিয়েছে, তাই চেনা দায়। এইসমস্ত স্মৃতির দরজায় সজোরে একটা আঘাত পড়লো সেদিন, যখন আকস্মিকভাবে বাসটা থেমে যাওয়ায় হুমড়ি খেয়ে পড়লাম একজন লম্বা গড়নের ছিপছিপে লোকের গায়ে, আমার অন্যমনস্কতাও তার জন্য কিছুটা দায়ী ছিল বটে। প্রায় ততক্ষণে ধাক্কাটা সামলে নিয়েছি, দেখি এই আধুনিকতার যুগেও তার বুক পকেটে একটা ফাউন্টেন পেন উঁকি মারছে। প্রথমটায় যে খুব আশ্চর্য হয়েছি তা নয়, ভেবেছি হয়তো শখের খোরাক হবে। পরে সে বিভ্রান্তি ধূলিসাৎ হয়। চোখে চশমা অনেককাল আগেই পরেছে , কিন্তু পেনটাই লেখা চিরপরিচিত সেই নামটা পড়তে একটুও অসুবিধে হয়নি। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics