Meheli Ghosh

Tragedy Classics

5.0  

Meheli Ghosh

Tragedy Classics

পরিণতি

পরিণতি

4 mins
607



বছর চব্বিশের অভিজিত দাশগুপ্ত সদ্য চাকরি পেয়ে কলকাতায় আসে। কলকাতায় আসামাত্রই তার একটি অভিজ্ঞতা হয় । কলকাতায় তার সেরকম পরিচিতি না থাকায় তাকে ভাড়া বাড়িতে থাকতে হয়। যাতায়াতের সুবিধার্থে অফিসেরই কাছাকাছি একটি বাড়িতে সে ভাড়া নেয় । ভাড়ার ঘরটি এমনিতে খারাপ না তবে একতলায়, রাস্তার ধারে, ফলে জানলা খুলে ঘুমানো মুশকিল । এদিকে বিগত কয়েক বছর ধরেই কলকাতায় বেশ গরম পরছে । দিনের বেলায় অফিসে এ.সি.র হাওয়ায় গরমটা সেভাবে গায় লাগেনা কিন্তু রাতে ভালোই জানান দেয়। সেইরকমই একটি গ্রীষ্মের রাতে, গরমের চোটে ঘুমাতে না পেরে অভিজিত দরজা জানলা খুলে খাটে শুয়ে গল্পের বই পড়ছিল । এমন সময় একটি ছায়া দেখে সে চমকে গিয়ে চিল্লিয়ে ওঠে , "কে ? কে ওখানে ? "


ক্রমে ছায়াটা ঘরের দিকে এগিয়ে এলো । দরজা দিয়ে ঢুকে আসে একজন বয়স্ক মহিলা । দুর্বল চেহারা, বয়সের ভারে সম্পূর্ণ কুঁজো হয়ে গেছে, মুখে অসংখ্য বলিরেখা বিভিন্ন আকৃতি সৃষ্টি করেছে, সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে, মনে হচ্ছে তাকে না ধরলে এক্ষুণি মাটিতে পরে যাবে, দেখে মনে হচ্ছিলো ওনার সময় হয়তো ঘনিয়ে এসেছে, কাঁপতে কাঁপতে অনেক কষ্টে ক্ষীণ গলায় বলে উঠলেন, "এইডা কি হারানের বাড়ি  ?"


" হারান ? কে হারান ? আমি কোনো হারানকে চিনিনা ! আপনি কে ? কাকে খুঁজছেন ? এইভাবে রাত্রী বেলায় ঘরে ঢুকে পরছেন যে ! "


মহিলাটি অভিজিতের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে ঘরটিকে ভালো করে দেখে । তারপর আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে মেঝেতে বসে পরে । বড়ো অসহায় তবুও মুখে আলগা হাসি এনে বলেন , " বাবা পান আছে ? পান ? পান খাইলে মুখটায় বেশ সুবাস হয় । "


অভিজিতের অস্বস্তি হলেও একজন অসহায় বয়স্ক মানুষকে কি বলবে বুঝে পায়না । মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে হয়তো অনেকদিন পেটে কিছু পরেনি । ঘরে তখন কটা বিস্কুট ছাড়া খাওয়ার মতো আর কিছু ছিলনা, " পান নেই। বিস্কুট আছে। খাবেন ? " এই বলে মহিলাটিকে বিস্কুট আর জল দিয়ে অভিজিত বাড়ির মালিককে ডেকে আনে।


বাড়ির মালিক মহিলাটিকে দেখে চিনতে পারেন। মহিলাটির মেয়ের বাড়ি এই পাড়ায় । পাশের গলিতেই । উনি ঠিকই বলেছিলেন অভিজিতের বাড়ির মালিকের নাম হারান। বাড়ির মালিকের কাছেই সে জানতে পারে মহিলাটিকে তার দুই ছেলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর কিছুদিন তার মেয়ের কাছে ছিলেন। আজ তার মেয়েও তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। সারাদিন মেয়ের বাড়ির চারপাশেই ঘোরাঘুরি করেছেন কিন্তু মেয়ে ঘরে তোলেনি । রাতে কোথাও যাওয়ার জায়গা না পেয়ে দরজা খোলা দেখে অভিজিতের ঘরে ঢুকে পরে । ঘটনাটি জেনে অভিজিতের খুব খারাপ লাগছিল মহিলাটির জন্য । মা বাবাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা হামেশাই খবরের কাগজে পড়লেও চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা এই প্রথম।


হারন বাবু দুটি পাড়ার ছেলেকে জোগাড় করেন। তারপর অভিজিত, হারান বাবু এবং পাড়ার ছেলে দুটি মিলে মহিলাটিকে নিয়ে ঐ রাতেই ওর মেয়ের বাড়ি গিয়ে অনেক ডাকাডাকি করে কিন্তু কারুর সাড়া পাওয়া যায়না। ওরা বেশ কিছুক্ষণ ধরে অনেক জোরে জোরে সদর দরজা ধাক্কায় অথচ ইচ্ছাকৃত কেউ সাড়াশব্দ দেয়না,পাছে মহিলাটিকে পুনরায় ঘরে তুলতে হয়। 


এবার প্রশ্ন এতো রাতে মহিলাটি কোথায় যাবে ? হারান বাবু সাফ জানিয়ে দিয়েছেন ওনার বাড়িতে রাখা চলবেনা। পরের বাড়ির ঝামেলা কেউ নিজের বাড়িতে ঢোকাতে চায়না । তার উপর মহিলাটিরও অনেক ইতিহাস আছে। একটা সময় নাকি মহিলাটির চোলাই মদের ব্যাবসা ছিলো । অবশ্য পরে স্থানীয় বাসীন্দারা অভিযোগ করে সেই মদের ঠেক বন্ধ করিয়ে দেয়। সেই সময় একজনকে খুন করে পাশের ডোবাতে ফেলে দিয়েছিল এই মহিলা। আদালতে সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে তখন খুনের কোনো সাজা হয়নি এই মহিলার। তাই তার এই পরিণতিতে কারুর কোনো আপশোস নেই । অবশেষে সবাই আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে,একটা মশা মারার ধুপ, বিস্কুটের প্যাকেট, জলের বোতল এবং দুটো পান কিনে দিয়ে, মহিলাটিকে একটা বাড়ির রকে বসিয়ে রেখে যে যার বাড়ি চলে আসে।


অভিজিত সবার সাথে ফিরে এলেও তার মন ওখানেই পরে থাকে। মহিলাটিকে রাস্তায় ফেলে আসার ইচ্ছে না থাকলেও সেই মুহূর্তে সে নিরুপায় ছিলো । ভাড়াটে হয়ে মালিকের অমতে তো কাউকে আশ্রয় দিতে পারেনা ! সে সকালে উঠেই আগে মহিলাটিকে দেখতে যায়। ওখানে গিয়ে মহিলাটিকে দেখতে না পেয়ে ভাবে হয়তো তার মেয়ে তাকে ঘরে তুলেছে । এই ভেবে সে ফিরে আসে। কিছুক্ষণ পর হারান বাবু এসে খবর দেন মহিলাটি মারা গেছে । অভিজিত হারান বাবুর সাথে গিয়ে দেখে একটি ডোবার পাশে মানুষের ভীড়। ভীড় ঠেলে এগিয়ে এসে দেখে মহিলাটির মৃতদেহ পরে রয়েছে, মুখে তার কিনে দেওয়া সেই পান । হয়তো ভোরে ডোবাতে হাত মুখ ধুতে এসে ওখানেই পরে মারা যায় । অভিজিতের একটু খারাপ লাগছিল হাজার হোক মানুষটা রাতে তার ঘরে আশ্রয়ের আশায় ঢুকেছিল কিন্তু সে আশ্রয় দিতে পারেনি।


অবশ্য মানুষটির এই পরিণতিতে মনে হয় অনেকেই খুশী হয়েছিল। সেখানে উপস্থিত মানুষের ভীড়ের মধ্যে দিয়ে একটাই কথা ভেসে আসছিলো বারবার , " এই ডোবাতেই বুড়ি খুন করে বডি ভাসিয়ে দিয়েছিল না ! দেখো শেষে এই ডোবার ধারে এসেই বুড়ি মরলো। কথায় আছেনা 'ভগবানের মার, দুনিয়ার বার !' মানুষের আদালতে বিচারের ভুল হতে পারে কিন্তু ভগবানের আদালতে হয়না। তখন বুড়ি বেঁচে গিয়েছিল কিন্তু শাস্তি বুড়ির হলোই । খন্ডাতে পারলোনা। "


Rate this content
Log in

More bengali story from Meheli Ghosh

Similar bengali story from Tragedy