Sanghamitra Roychowdhury

Drama Romance Tragedy

4  

Sanghamitra Roychowdhury

Drama Romance Tragedy

প্রেমে পড়া বারণ

প্রেমে পড়া বারণ

9 mins
410



ফার্স্ট ইয়ারের প্রথম দিনের প্রথম ক্লাস। মধ্য বর্ষার গুমোট মধ্য সকাল। কিন্তু সেই গুমোট ভাবটা বেমালুম উধাও কলেজ চত্বরের লম্বা করিডোর থেকে কমনরুম হয়ে সিঁড়ি আর বাঁধানো চাতাল পেরিয়ে ক্যান্টিনের সাদামাটা রঙচটা চেয়ার টেবিল বেঞ্চের ভিড় কাটিয়ে লাইব্রেরীর রিডিংরুম থেকে ল্যাবরেটরির সামনের কোলাপসিবল গেট পর্যন্ত। গোটা কলেজের সবকটি ডিপার্টমেন্টে খুশি ঝলমলে ঝাঁকে ঝাঁকে ফুটে থাকা টকটকে ফায়ারবল অথবা নিদেনপক্ষে দেশী শিউলি, টগর বা কামিনীর মতো ফার্স্ট ইয়ারের দলবদ্ধ নবীনারা। সর্বত্র কলকল খলখল। নবীনেরা অবশ্য আরো কয়েকধাপ এগিয়ে। এখানে সেখানে যূথবদ্ধ হয়ে প্রথম সিগারেটের প্রথম টানে খকখক খ্যাকখ্যাক খুকখুক করে কলেজ কম্পাউণ্ডের কাটিং করা ঝোপঝাড় ঝাউ বা বাহারি গাছের পেছনের বায়ু ও শব্দ দূষণ ঘটিয়ে চলেছে। ফার্স্ট ইয়ারের প্রথম দিনের প্রথম ক্লাসের কয়েকটা ঘন্টা... কেটে গেলো একরকম করে। নবীনে প্রবীণে পরিচয় পর্বটি অবশ্য নির্ধারিত দিনকয়েক পরে। নবীনবরণ অনুষ্ঠানে।


আধা শহুরে মফস্বলি গন্ধমাখা শিউলি খুবই লাজুক। এক্কেবারে মুখচোরা মেয়ে। সে যে কোথাও আছে তা টেরই পাওয়া যায় না। কৃষ্ণা, কাবেরী, অমিতা, সুমিতা, রিমি, রিনিদের ভিড়ে সে একপাশে লুকিয়ে থাকে। তার উপস্থিতি আলাদা করে চোখেই পড়ে না, চেনাও যায় না তাকে আলাদা করে। কেউ হয়তোবা শিউলির সামনে দিয়েই চলে গেলো, অথচ শিউলি যে সেখানে আছে, তা সে মোটে বুঝতেও পারলো না। তবে এতে শিউলিরই লাভ... মানে সুবিধা বলা যায়। সে বেশ তার গায়ে মফস্বলি মেঠো সুগন্ধি মেখে দিব্যি থাকতে পারে। কোনো লোকদেখানেপনার দায়ভার বইতে হয় না তাকে।


নবীনবরণ অনুষ্ঠানের দিন এগিয়ে এলো হুড়মুড় করে... কলেজে প্রথম আসার ক'দিনের মধ্যেই অনুষ্ঠান। শিউলি অবশ্য পাঁচজনের ভিড়ের ফাঁকে মিশে রইলো একাকী হয়ে। বড়ো সাধারণ যে সে। কারণ তার রূপ নেই চোখটানা। সে খুব সাহসী বা ডাকাবুকোও নয়। খুব নিম্নবিত্ত ঘরের মেয়ে সে। পোশাক-আশাকের চটক বা সাজগোজের কেতাদুরস্ত জিনিস... কোনোটাই তার ভাণ্ডারে নেই। তবে ভগবান অবশ্য তাকে একটুখানি বিশেষত্ব কিছু জন্মগতভাবে দিয়েই পাঠিয়েছেন... গলায় একটু সুর। শিউলির গলায় একটু সুর আছে... একটু না, বেশ ভালোই সুর আছে, মানে যথেষ্ট ভালোই সুর আছে। উচ্চ মাধ্যমিকে শিউলির সহপাঠিনী ক'জন কলেজে এসেই ফাঁস করেছিলো কথাটা।

নবীনবরণ অনুষ্ঠানে পরিচয়পর্ব ও প্রবীণদের দেওয়া শুভেচ্ছাবার্তা ও উপহার বিনিময় পর্বের পরেই শুরু হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। জমজমাট কায়দায়... বেশ এক আদান-প্রদানের মতো করে... প্রবীণরা শুরু করছে কোনো একটি গানের দু'কলি গেয়ে, তারপর নবীনদের মধ্যে যে জানে ঐ গানটি ঠিকঠাক, সে বাকী অংশটুকু গেয়ে শেষ করছে। বেশ অভিনব ও মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান। কলেজের ফাইনাল ইয়ারের তমাল গাইতে শুরু করলো তার ভরাট গলায় মেঠো সুরের জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা গানটি...

"লাল পাহাড়ির দেশে যা... রাঙামাটির দেশে যা...


হিথাক তুকে মানাইছে না রে... ইক্কেবারে মানাইছে না রে..." সাথে সাথে শুরু হয়েছে হাতে হাতে তালি। গোটা অডিটোরিয়াম গমগম করছে। দু'টো কলিই রিপিট করছে তমাল। চোখ ঘুরছে সামনে বসে থাকা নবীনদের ভিড়ে। কে আসবে বাকিটুকু গাইতে? তমাল আবারও গাইলো ঐ দুই কলিই... কারণ তার ঐটুকুই গাইবার কথা। নবীনদের মধ্যে একটু ঠেলাঠেলি... একটু ফিসফিস... তারপর দু-চারজন নবীন নবীনা মিলে এক নবীনাকে হাত ধরে তুলে দিলো স্টেজে। অতি সাধারণী এক মফঃস্বলি সরলতা চুঁইয়ে পড়া সদ্য তরুণী। পরনে সাদা জমিতে কমলা রঙের বুটিদার হালকা কাজ করা টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ি। বহু ব্যবহৃত... পাট লাট হয়ে যাওয়া শাড়ির পাড়ে এক ইঞ্চি চওড়া কমলা মন্দির মন্দির নকশা... ঠিক যেন একটা সার বেঁধে দাঁড়ানো পোড়ামাটির মন্দির বহুদূরে। সাদামাটা পোশাকে সাদামাটা মেয়ে শিউলি... ঠিক যেন একমুঠো শরতের শিউলির মতোই শুভ্রস্নিগ্ধ। মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ঘামে ভেজা হাতদুটো জড়ো করে কিছু বললো না... সোজা ধরে নিলো গানটা তমালের পুনরাবৃত্তি করা জায়গায় গিয়ে... "হিথাক তুকে মানাইছে না রে, ইক্কেবারে মানাইছে না রে...


লাল পাহাড়ির দেশে যা, রাঙামাটির দেশে যা..."! নবীন প্রবীণ একসাথে হাতের তালে অডিটোরিয়াম ভরিয়ে তুলেছে আর শিউলি ছোট-বড়ো সবার হৃদয় ভরিয়ে তুলেছে। গান থেমেছে একসময়... রেশটুকু শ্রোতাদের কর্ণকুহরে রয়ে গেছে তখনও। ব্যাস্, তারপর থেকেই কলেজের ছোট বড় মাঝারি সব অনুষ্ঠানে শিউলির ডাক পড়ে। ডেকে নিয়ে যায় কলেজের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অর্জুন। দু'জনের একই ইয়ার, আলাদা ডিপার্টমেন্ট।


অর্জুনকে শিউলি বড্ড ভালবেসেছিলো। বড্ড নির্ভর করেছিলো অর্জুনের উপর। কিন্তু অর্জুন তা লক্ষ্য করেছে কি করেনি তা নিয়ে শিউলির মাথাব্যথা ছিলো না। অবশ্য সহপাঠীরা ধরেই নিয়েছিলো যে শিউলি আর অর্জুন প্রেমের সম্পর্কে আছে। তবে অর্জুন তাকে বোনের মতোই দেখতো। স্নেহ করতো। আবার বন্ধুত্বও ছিলো। কোনো সমস্যায় পড়লে যখন কষ্টে দুঃখে শিউলির বুক ফেটে যেতো, কারুর কাছে প্রকাশ করতে পারতো না, সেসময় ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে যেতো অর্জুন। যেন তেন প্রকারেণ... শিউলির দুঃখ লাঘব করতে অর্জুন ঝাঁপিয়ে পড়তো। আর এই বিষয়টাই সবার চোখে ধরা দিতো অন্যভাবে... অর্জুন আর শিউলি প্রেমের বাঁধনে বাঁধা পড়েছে। নিখাদ বন্ধুত্ব মেয়ে পুরুষে হয় না... এমনই চালু-চলতি ধারণা আমাদের এই সমাজের সবখানে। তাই হয়তো সর্বসমক্ষে অর্জুন আর শিউলি দুজনেই একটু গুটিয়েই থাকতো। টিকা-টিপ্পনি এড়াতে এছাড়া ওদের কাছে অন্য কোনো উপায়ও খোলা ছিলো না।


দেখতে দেখতে কলেজের তিনটে বছর পার হয়ে গেলো হুহু করে। অর্জুন শিউলির পরীক্ষা শেষ হলো। দুজনেই পাশ করলো ভালোভাবে। তবে পাশ করে যাবার পরেও দু'জনের যোগাযোগটা রয়েই গেলো। দুজনেই এখন চাকরির চেষ্টায়।


অর্জুন খুব তাড়াতাড়ি চাকরি পেয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠিত সফল পুরুষ হয়ে গেছে। ওদের আরো অনেক সহপাঠী চাকরি পেয়ে গেছে। অনেক মেয়েবন্ধুর বিয়ে হয়ে গেছে। শিউলি এখনো চাকরি পায়নি। একা একাই চুপচাপ তৈরি হয়ে যাচ্ছে চাকরির জন্য। ওদের ক্লাসের পলাশ কিন্তু একদিন চিঠি পাঠিয়েছিলো, প্রেমপত্র। এমনকি সাদাসিধে মুখচোরা কৃষ্ণও একদিন একটা প্রেমপত্র পাঠিয়েছিলো। চিঠির রঙিন খাম দেখে শিউলি আরও বেশি রাঙা হয়েছিলো লজ্জায়... লজ্জাবতী লতার মতো। কিন্তু সে কোনো উত্তর দেয়নি। অর্জুনকে তো এখনো এসব কিছু জানাতে পারেনি শিউলি। মনটা ছটফট করছে শিউলির। সরকারি চাকরি নিয়ে অর্জুন এখন উত্তরবঙ্গের শেষপ্রান্তে ছোট এক শহরে। কতদিন দেখা নেই, সাক্ষাৎ নেই। শিউলির খুব অভিমান হয়। বন্ধুত্বে ভাটা পড়লো নাকি? নিজের মনকে নিজেই স্বান্ত্বনা দেয় শিউলি, "অর্জুন বেচারা হয়তো সময়ই পাচ্ছে না কাজের চাপে। নতুন চাকরি। চিঠি লেখার অভ্যেস তো কোনোকালেই অর্জুনের ছিলো না। তবে এতো মনখারাপের কীইবা আছে? শিউলি ভাবতে ভাবতে চাকরির পরীক্ষার পড়ায় ডুবে যায়। পড়া, তারপর পরীক্ষা, ইন্টারভিউ, ফলপ্রকাশের অপেক্ষায় আর অভিমানে অর্জুন একটু একপাশে সরেই গিয়েছিলো। একদিন লম্বা এক সরকারি খামবন্দী হয়ে এলো এক মহাখুশির খবর। শিউলির চাকরিটা হয়ে গেছে... সরকারি চাকরি। যে চাকরিটা অর্জুন পেয়েছে, ঠিক সেই একই চাকরি। মনটা আনন্দে নেচে উঠলো শিউলির। আবার দুজনে একসাথে... একই চাকরি করবে। আবার দেখা হবে, আবার গল্প হবে, আবার বন্ধুত্বের খুনসুটি হবে।


শিউলিও সৌভাগ্যক্রমে উত্তরবঙ্গেই প্রথম পোস্টিং পেলো। যেখানে অর্জুন চাকরি করছে এবং আছে সেখান থেকে মাত্রই দু'ঘন্টার দূরত্ব গাড়িতে। জয়েন করার মাস দুয়েক পরে দুজনেই ফুরসৎ পেলো কাজের ফাঁকে একটা ছুটির দিনের একটি বেলায়... দেখা করবার... এতোদিন পরে। প্রায় দুটো গোটা বছর পার হয়ে গেছে... সামনাসামনি দেখা হয়নি ওদের। কত কথা জমে আছে স্তুপাকার হয়ে। ফোনে কি আর সব কথা হয়? সকাল থেকে শিউলি উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে। এই শিউলি সেই কলেজবেলার লাজুক মুখচোরা শিউলি নয়। এই শিউলি চনমনে... সপ্রতিভ... সরকারি চাকুরে। অর্জুনের সহকর্মী। সহপাঠী থেকে সহকর্মী। এমন সৌভাগ্য ক'জন বন্ধুর মধ্যে দেখা যায়? খুব বিশেষ দেখা যায় না। কিন্তু অর্জুন আর শিউলির ভাগ্যে ঘটেছিলো সেই বিরলতম ঘটনাটি। কলেজের তিন-তিনটি বছরের সহপাঠী... তারপরও বন্ধুত্ব অটুট পরের পাঁচটি বছর... আর তারও পরে এই চাকরি জীবনে এসে আবার দু'জনে সহকর্মী। ষাট বছর বয়স পর্যন্ত অটুট বন্ধন। শিউলি আর অর্জুন দুজনেই একই সরকারি দপ্তরে চাকরি পেয়েছে খবর পেয়ে ওদের পুরোনো বন্ধুরা... যাদের সাথে ফোনে বা ফেসবুকে যোগাযোগ ছিলো... তারা বেদম ঠাট্টা করেছে "অটুট-জোড়" বলে। শিউলি আর অর্জুন উপভোগ করেছে। সামিল হয়েছে ঠাট্টায়... সায় দিয়েছে বন্ধুদের কথায়।

অর্জুন চলে এলো সকাল সকাল... শিউলির বাসাবাড়িতে। তারপর সারাদিন হৈহৈ... আড্ডা... গল্প... আর দুজনে মিলে জমিয়ে খাওয়া-দাওয়া। তারপর সন্ধ্যে হতেই দুজনেই মুখ ভার করে দুজনকে বিদায় সম্ভাষণ জানায়। পরেরবার শিউলি যাবে অর্জুনের বাসায়... কথা দেয় শিউলি। দিনটা যেন বড্ড তাড়াহুড়ো করে শেষ হয়ে গেলো। বিদায় নিয়ে উদাস মনে অর্জুন ফিরে যায় নিজের জায়গায়। শিউলি একলা হয় জানালার ধারে পাতা আরাম চেয়ারে। ভাবে পুরোনো দিনের কত কথা। ডায়েরির পাতায় লেখা কালির অক্ষরগুলো যেন নড়েচড়ে হেঁটে দৌড়ে বেড়ায় শিউলির মনে। অর্জুনেরও দমবন্ধ লাগে একলা বাসায়। তারপর একসময় রাতটা শেষ হতেই পরদিন থেকে আবার দুজনেই নিজের নিজের কর্মক্ষেত্রের চরম ব্যস্ততায়। মাঝেমাঝে দু-চারটে মামুলি মেসেজ চালাচালি হোয়াটসঅ্যাপে। দিন যায় একটা একটা করে। সপ্তাহ যায়। মাস যায়। দু'মাস যায়। শিউলির আর ফুরসৎ মেলে না যে একবার যাবে অর্জুনের বাসায়।


তিনমাস পরে এক শনিবারের ভরসন্ধ্যাতে অর্জুনের ফোন। অনেক অভিযোগ, "তুই তো সময়ই পাচ্ছিস না আসার।দেওয়া কথা না রাখতেও শিখেই গেছিস আজকাল তবে! তুই যখন আসবিই না... তখন কাল সকালে নাহয় আমিই আসি। কিরে আপত্তি আছে?" কাজের চাপে আর পরিবার থেকে দূরে একলা থেকে মুষড়ে পড়া শিউলি যেন জেগে উঠলো, "না না, আপত্তি কি বলছিস? আয়, আয় কালই।"


পরদিন রবিবার। ভালোমন্দ বাজার করলো শিউলি। একা থাকে। কোনোরকমে সেদ্ধ ভাত ফুটিয়ে খায়। ইচ্ছে করে না একলা খেতে। অর্জুন আসছে সেদিন... ভালোমন্দ একটু না করলে হয় নাকি? অর্জুন এলো। খুব সকালে নয়। একটু বেলা বাড়তে... এই এগারোটা নাগাদ। শিউলি জলখাবার নিয়ে বসেছিলো... লুচি আর আলু চচ্চড়ি। অর্জুন খুব ভালোবাসে। কলেজে পড়ার সময়ে মাঝেমধ্যে মা করে দিতো টিফিনে... যেদিন কোনো অফ পিরিয়ড থাকতো না, অথবা মায়ের হাতখালি থাকতো। কিনে কিছু খাবার টাকার বদলে মা খুব হাসি হাসি মুখ করে অ্যালুমিনিয়ামের গোল টিফিন কৌটোয় পুরে লুচি আর আলু চচ্চড়ি দিয়ে দিতো। শিউলি কোনদিন কেন মা কী করে... সবই বুঝতো। কিন্তু কখনোই কিছু মুখে বলতো না, কারণ শিউলির সবকিছু মুখ ফুটে বলার স্বভাব নয়। শিউলির টিফিন কৌটো খুলে সেই ন্যাতানো লুচি আর ঠাণ্ডা আলু চচ্চড়ি সবটাই অর্জুন খেয়ে ফেলতো আঙুল চেটে চেটে। তারপর লজ্জায় জিভ কেটে নিজের পকেট ঝেড়েঝুড়ে শালপাতায় ঘুগনি বা চুরমুর বা ভেলপুরি খাওয়াতো শিউলিকে কলেজ গেটের পাশ থেকে। ক্যান্টিনে অত সস্তায় কিছু পাওয়া যেতো না কিনা! এতোদিন পরে কথাগুলো বড্ড মনে পড়লো শিউলির।


অর্জুন এলো ঠিকই... তবে মুখখানা যেন একটু ভারভার। হালকা দু-একটা কথার পরে অর্জুন শিউলিকে বলে, "এই শোন, একটা খুব জরুরি আলোচনা আছে, বুঝলি?" চোখে কৌতুক আর ঠোঁটে হাসির মিশেল দিয়ে হালকা চালে বলে শিউলি, "আছেতো বলেই ফ্যাল। দেরি কিসের?" একটু থেমে মুখ নীচু করে অর্জুন। তারপর শিউলির মুখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে অর্জুন বলে, "চল, আমরা বিয়ে করে নিই। দুজনকে তবে আর আলাদা আলাদা থাকতে হবে না।" অর্জুনের কথা শুনে হতভম্ব শিউলি ফিক করে হেসে ফেলে, "এই কথা? নারে, তোকে বিয়েটা করতে পারলাম নারে অর্জুন। তুই বন্ধু ছিলি, বন্ধু আছিস আর বন্ধুই থাকিস। তুই যদি বর হয়ে যাস তবে বরের সঙ্গে ঝগড়া হলে কার কাঁধে মাথা রেখে বরকে গালমন্দ করে শ্রাদ্ধ করবো বল? আর তুইইবা বৌয়ের সাথে ঝগড়া করে এসে কার কাছে বৌয়ের ভূত ভাগাবি বল দেখি? ভেবেছিস সেটা? আজকাল বন্ধুর বড়ো অভাব রে... বর বৌয়ের কিন্তু ততটা আকাল নেই। কিরে, ঢুকলো মাথায়?"

তারপর সেদিন আর গল্পগুজব তেমন করে জমলো না। শিউলি আর অর্জুন দুজনেই অন্যমনস্ক ছিলো। তারপর সন্ধ্যের আগেই অর্জুন ফিরে গেলো নিজের বাসায়। একলা শিউলি রইলো বসে অন্ধকার বারান্দায়, "এত বোকা না অর্জুনটা? বয়সে বড়োই হয়েছে শুধু! বুদ্ধিশুদ্ধি হয়নি। শিউলি যে তার জন্যে একসময়... থাক ওকথা। অনেক পুরোনো জরাজীর্ণ হয়ে গেছে সেকথা! কোনোদিন বোঝেওনি, আর বুঝবেও না। না বুঝেই থাকুক। অর্জুনই তো প্রথম বন্ধু বানিয়েছে, বোনের নজরে দেখে বলেছে। শিউলি যখন তাতেই অভ্যস্ত হয়ে গেলো তখন আবার সেই অর্জুনই ভূমিকা বদলাতে চাইছে?" একবার যখন নিজেকে সরিয়ে নিতে পেরেছিলো শিউলি বন্ধুত্বকে প্রাধান্য দিয়ে, তখন কি করে আর শিউলি বন্ধুত্বের গণ্ডী ভাঙবে? কিছু আবেগ নাহয় তার একলারই থাক... আর অর্জুন থাক তার অমূল্য বন্ধু হয়ে।

সেই থেকে শিউলি উত্তরবঙ্গে একাই থাকে। কলকাতায় ট্রান্সফার নেবার আগ্রহ তার নেই। বুকে তার ঝুপসি হয়ে সব ব্যথা আর লুকোনো অনুরাগ শরতের শিউলির মতোই ক্ষণস্থায়ী। আসে আর যায়। অর্জুনের ছেলের মুখেভাতে কলকাতায় গিয়ে ওর বৌকে ওদের কলেজবেলার শেষদিনের গ্রুপ ছবিটা দিয়ে এসেছে... উপহার সামগ্রীর সাথে। মা মারা যাওয়াতে শিউলি অর্জুনের বিয়েতে যেতেই পারেনি যে। বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক কি আর ছবি দিয়ে বাঁধা যায়? ওতো মনের গভীরেই থাকে।





Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama