ফুলের জলসা
ফুলের জলসা


অনেক ছোট তখন আমি, আমাদের শহরতলীর বাড়ীতে তখনও ইলেকট্রিক আলো আসে নি। শেষ হেমন্তের হালকা শীত পাতলা সুতির চাদরেই দিব্যি কাবু, বেশ রাত হয়েছে তবে খুব গভীর নয়। বাবা হ্যারিকেনের হলদেটে আলোয় অ্যানুয়াল পরীক্ষার খাতা দেখছে আর মা বারবার তিনপুরুষের পুরোনো আদ্যিকেলে দেওয়ালঘড়িটা।
ঘুমে আমার চোখ জ্বলছে আর ক্ষিদেয় পেট। মায়ের আমাকে আগে খেতে দিয়ে দেবার তেমন গরজ নেই , ভাতের হাঁড়ির ঢাকা একবার খুললেই এই ঠান্ডাকালে ভাত একেবারে জুড়িয়ে জল হয়ে যাবে যে। বড়দা ফেরার খানিক দেরী আছে বোধহয় তখনো, শীতকাতুরে বড়দা যে ঠান্ডা ভাত একদম খেতে পারে না, তাই এই অপেক্ষা। সদর দরজায় ঠুকঠুক কড়া নাড়া, মা আঁচলটা মাথায় টেনে দরজা খুলে দিলো, বড়দা......সামান্য খোঁড়াচ্ছে। মা ভাতের হাঁড়ির ঢাকা তখনও খোলে নি , আবার সদর দরজায় কড়া নাড়া, এবার বাবা গেলো দরজা খুলতে।
কেমন একটা মুখ করে বড়দা জামা পাল্টানো রেখে হুড়মুড়িয়ে খিড়কি দরজার দিকে এগোলো খোঁড়াতে খোঁড়াতে। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে মা ছুটলো ছাদের দিকে, পেছনে আমি। আলসেয় হাত রেখে মা ঝুঁকে পড়ে অন্ধকারে চোখ পেতে অপলক।
অন্ধকার ফুঁড়ে অনেক টর্চের চোখ ধাঁধানো আলো! তারপর কান ফাটানো গুলির আওয়াজ, জলে ভারী কিছু পড়ার আওয়াজ, রাতচরা পাখির কর্কশ চিৎকার আর মায়ের বুক ফাটানো আর্তনাদ.....এর কোনটা ঠিক আগে আর কোনটা ঠিক পরে, নাকি সব একসাথে তা বুঝতেই পারলাম না।
এরপর বাবাকে দেখেছিলাম লুঙ্গি গেঞ্জি পরেই খালি পায়েই সদর দরজা পেরোবার সময় স্যালুট করে দুর্বোধ্য কিছু বলতে, বুঝি নি কথাটা। এরপর আরও দু'দিন পার, মা বিছানায়, বাবা বারবার কাকা আর পাড়ার দু-চারজনকে নিয়ে কোথায় কোথায় যাচ্ছে যেন জানি না। কাকিমা আমাকে দু'বেলা ওবাড়ী থেকে খাইয়ে আনছে। বড়দা ফেরে নি বলে বোধহয় বাবা-মা খাচ্ছে না....তাইই হবে হয়তো। সেদিন একটা ভ্যান থামার আওয়াজ পেলাম বাড়ীর ঠিক সামনে।
কিছুতেই ভুলতে পারি না আজও.......বড়দার সেই
ছ-ফুটের কালচে মুখের শরীরটাকে মায়ের গায়ের লাল সুতির চাদরটা দিয়ে চারপাশ মুড়ে ঢেকে দেওয়া। ফুলপ্রিয় বড়দার বুকের ওপর আমাদের বাগানেরই নানা রঙের কিছু মরশুমী ফুলের জলসা। বড়দা......আমার শীতকাতুরে জাঁদরেল নকশাল ছাত্রনেতা বড়দা..... চিতায় চলেছে গা-গরম করার উত্তাপ নিতে।