Siddhartha Singha

Classics

2  

Siddhartha Singha

Classics

ফার্স্ট জানুয়ারি

ফার্স্ট জানুয়ারি

6 mins
522


গুটি কতক পাক মদত পুষ্ট জঙ্গি ১৯৯৯ সালে কাঠমান্ডু থেকে দিল্লিগামী আইসি-৮১৪ বিমানটি ছিনতাই করে। মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে খবর। গোটা পৃথিবী জুড়ে হইচই শুরু হয়। নজর রাখা হয় তাদের যাবতীয় গতিবিধির ওপর। দেখা যায়, অমৃতসর-লাহৌর-দুবাই হয়ে শেষ পর্যন্ত তারা তালিবান শাসিত আফগানিস্তানের কন্দহরে বিমানটি নামিয়েছে। জানা যায়, ছিনতাইকারীরা যাত্রী সেজে কাঠমান্ডুু বিমানবন্দর থেকে ওই বিমানে উঠেছিল। তারা চার জন ত্রাস জাগানো কট্টর উগ্রপন্থীর মুক্তি দাবি করে। হুমকি দিতে থাকে, তাদের দাবি মানা না হলে, প্রতি এক ঘণ্টা অন্তর একজন করে যাত্রীকে গুলি করে বিমানের বাইরে ফেলে দেওয়া হবে। বাদ দেওয়া হবে না নারী বা শিশুকেও।

ঘন ঘন জরুরি বৈঠকে বসেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনী ও বিমান মন্ত্রকের কর্তারা। যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতিও। একদিন-দু'দিন নয়, একটানা সাত দিন ধরে চলতে থাকে দু'পক্ষের মুহূর্মুহু আলোচনা। দম বন্ধ করা দর কষাকষি। অবশেষে...

সেই রুদ্ধশ্বাস ঘটনাটার সঙ্গে ওই লময় আরও একটা ঘটনা সংবাদের শিরোনাম হয়ে উঠেছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতেই নড়েচড়ে বসেছিলেন গোটা দুনিয়া। পৃথিবীর তাবড় তাবড় সব বিজ্ঞানী। তাঁরা তখন মাথার চুল ছিঁড়ছেন। কোনও কূলকিনারা পাচ্ছেন না। ৩১ ডিসেম্বরের রাত বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই তো সব শূন্য শূন্য হয়ে যাবে, এই ঐতিহাসিক ওয়াই টু কে বিপর্যয়ের কী করে সামাল দেবেন তাঁরা! সময় কি তা হলে থমকে দাঁড়াবে! শুধু বিজ্ঞানীরাই নন, মনে মনে সবাই শঙ্কিত এবং চিন্তিত।

সেই দিনটা ছিল একত্রিশে ডিসেম্বর। ওই রকম দু'-দুটি ঘটনার মুখোমুখি হলেও, যেহেতু বহু আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে ছিল, তাই কেউ কেউ বাতিল করার পরামর্শ দিলেও শেষ পর্যন্ত তা আর বাতিল হয়নি। সেই রাতে বিশাল জাঁকজমক পূর্ণ একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিল সল্টলেক স্টেডিয়ামে। গোটা স্টেডিয়াম উপচে পড়েছিল লোকে। প্রতিটা ক্ষণ চেটেপুটে নিচ্ছিল সবাই। দারুণ নাচাগান চলছিল। তার রেশ ছড়িয়ে পড়ছিল দর্শকদের মনেও। গানের তালে তালে সবাই পা মেলাচ্ছিলেন। রাত বারোটা বাজতে তখন মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। হঠাৎ সেই অনুষ্ঠান মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে উদ্যোক্তারা ঘোষণা করলেন--- এইমাত্র খবর এসেছে, যাঁরা বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন, তাঁরা ওই বিমানের ১৯০ জন যাত্রীকে এইমাত্র মুক্তি দিয়েছেন। 

ঘোষণামাত্র গোটা স্টেডিয়াম করতালি আর উল্লাসে ফেটে পড়েছিল। স্বস্থির নিশ্বাস ফেলেছিল গোটা ভারতবাসী। পরে অবশ্য জানা গিয়েছিল, না, ওরা কাউকেই এমনি এমনি ছেড়ে দেয়নি। তার বিনিময়ে ওই জঙ্গিদের দাবি মতো ভারতীয় জেলে আটক মৌলানা মাসুদ আজাহার-সহ তিন জঙ্গিকে মুক্তি দিতে হয়েছিল।

ওই ঘোষণার ঠিক কয়েক মিনিট পড়েই মাঝপথে একটি উদ্দাম নৃত্যকে থামিয়ে দিয়ে করা হয়েছিল আর একটি ঘোষণা--- সমস্ত উদ্বেগের অবশান ঘটিয়ে বিজ্ঞানীরা শেষ পর্যন্ত ওয়াই টু-কে'র সমস্যা সমাধান করে ফেলেছেন।

তখন ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটা বাজতে মাত্র কয়েক মুহূর্ত বাকি। হ্যাঁ, তার পর দিনই মহাসমারোহে পালিত হয়েছিল ফার্স্ট জানুয়ারি।

ঐতিহাসিকদের মতে,এই যুগে আমরা যেটাকে ইংরেজি সাল বলি, মানে খ্রিস্টাব্দ, সেটা হচ্ছে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। আসলে এটি একটি সৌর সাল। আমাদের পূর্বপুরুষেরা চন্দ্র-সূর্য দেখে সময়ের হিসাব করলেও, ধারণাটা প্রথমে এসেছিল চাঁদের হিসাব থেকে। চাঁদের ওঠা এবং ডুবে যাওয়ার হিসাব কষে দিন, মাস ও বছরের হিসেব করা হত। আকাশে চাঁদ ওঠার সময়টাকে তাঁরা বলতেন--- ক্যালেন্ডস। পুরো চাঁদ ওঠাটাকে বলতেন--- ইডেস আর চাঁদের মাঝামাঝি অবস্থাকে বলতেন--- নুনেস। চাঁদের এই হিসাব বাদ দিয়ে মাসের দিন ও তারিখ প্রথম ঠিক করেন সিজার। পরে, অনেক পরে সৌর গণনার হিসাব চালু হয়। তারও পরে সেই হিসেবের নানা পরিবর্তন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন, বিবর্তন ও যোগ-বিয়োজনের মধ্য দিয়ে অবশেষে বর্ষ গণনায় এই বর্তমান নিখুঁত কাঠামোটি নির্ধারিত হয়।

আসলে মানুষ তাঁর কাজের সুবিধার জন্য সময় গোনা শুরু করেছিলেন। সময় তো কালের একটা অংশ, ক্ষুদ্র অংশ। আর কাল হল অনন্ত। সেই তুলনায় মানুষের জীবন তো ক্ষণিকের মাত্র। মানুষ অনেক অসাধ্য সাধন করেছে, বহু দুর্লঙ্ঘ্য বাধাকে জয় করেছে। কিন্তু একটি জিনিসের কাছে মানুষ বারবার হার মেনেছে। হ্যাঁ, হাজার চেষ্টা করেও মানুষ কখনও অমর হওয়ার কৌশল করায়ত্ব করতে পারেননি। 

তাই নিজের কাজের মধ্যে দিয়ে তাঁরা অমর হওয়ার চেষ্টা করেছেন। কখনও অবিস্মরণীয় কোনও কীর্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। কখনও একের পর এক দেশ জয় করে গোটা পৃথিবীকে করতে চেয়েছেন নিজের কুক্ষিগত। কখনও এমন সুশাসনের প্রবর্তন করেছেন, যাতে তাঁকে সবাই চিরকাল মনে রাখে।

কেউ কেউ তো এমন নির্দেশও দিয়ে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর পরেও যাতে তাঁর দেহ নষ্ট করে দেওয়া না হয়। তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি, মিশরের পিরামিডে সংরক্ষিত মৃতদেহ দেখে। শুধু দেহ নয়, তিনি যদি কখনও সেই চিরঘুম থেকে জেগে ওঠেন,

তিনি যাতে চোখ মেলেই তাঁর প্রিয় জিনিসগুলো দেখতে পান, প্রিয় খাবার মুখে তুলে নিতে পারেন, প্রিয় পোশাক পরে নিতে পারেন, তাই সেগুলোও তাঁর মৃতদেহের পাশে অতিযত্নে রেখে দেওয়া হত। তাঁর দেহে যাতে পঁচন না ধরে, বিকৃত না হয়, সে জন্য জড়িবুটি আর লতাগুল্ম দিয়ে বানানো ঔষুধির প্রলেপ মাখিয়ে দেওয়া হত তাঁর সারা শরীরে। কোনও পোকামাকড় বা কাটপতঙ্গ, ইঁদুর যাতে তাঁর শরীরের কোনও অংশে দাঁত বসাতে না পারে, ব্যবস্থা করা হত তারও।

মানুষ সময়ের সঙ্গে কখনও পাল্লা দিতে পারেনি। তাই সময়কে বাঁধতে চেয়েছেন দিন-ক্ষণ, সপ্তাহ, মাস, বছরে। আর এই পয়লা জানুয়ারিই হল গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জী অনুসারে বছরের ১ম দিন। অর্থাৎ বছর গণনার সুরুয়াত। যদিও মধ্যযুগে অন্য একটা দিনকে জুলীয় পঞ্চিকার প্রথম দিন হিসাবে ধরা হত এবং ওই দিনটিকেও বছরের প্রথম দিন হিসেবে পালন করা হত। কিন্তু তার পরে, মানে ১৪৫০ থেকে ১৬০০ সালের মধ্যে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীটাকেই পশ্চিম ইউরোপের বেশির ভাগ দেশই মানতে শুরু করে। বছরটাকে ভাগ করা হয় বারোটা মাসে। মাসগুলো হল জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর।

ডিসেম্বর মাসের শেষ দিন মধ্যরাত থেকেই শুরু হয়ে যায় পয়লা জানুয়ারি উদযাপন। কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে তো তিল ধারণের জায়গা থাকে না। নানান বয়সের ছেলেমেয়েরা রকমারি পোশাক পরে নেমে পড়ে রাস্তায়। কাছে-পিঠে পিকনিকের জন্য সকালের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বাসে করে দলে দলে লোকজন রওনা হয়ে যান আটান্ন গেট, বারুইপুর, বনগাঁ, গাদিয়াড়ায়। বাসে বসে খেতে থাকেন পাঁউরুটি, কলা, ডিমসিদ্ধ। এবং যেহেতু এটা শীতের মরশুম, তাই সঙ্গে দেওয়া হয় অন্তত একটা মোয়া। জয়নগরের মোয়া।

আর কেন জানি না, পঁচিশে ডিসেম্বরের সঙ্গে এই ফার্স্ট জানুয়ারির কোথায় যেন একটা মিল আছে। যতই ভেঁতো বাঙালি হই না কেন, সারা বছর না খেলেও বছরের এই শুরুর দিনটিতে অন্তত একটা বড় কেক বাড়িতে আনা চাইই চাই। সে বেকারির কেক বলেও কোনও আপত্তি নেই।

এ দিন চিড়িয়াখানার টিকিট কাউন্টারের সামনে বিশাল লম্বা লাইন পড়ে যায়। সুদূর সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসা বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখিদের যেমন আমরা দেখতে যাই, ওরাও যেন মানুষ দেখার জন্য জলের মধ্যে ও রকম ছটফট করে। বাদ যায় না জাদুঘর, ভিক্টোরিয়া, দক্ষিণেশ্বর, বেলুড়। সে সব জায়গায় ভিড় একদম উপচে পড়ে।

আর দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি? কিংবা সারদা মায়ের বাড়ি? অথবা কাশীপুর উদ্যানবাটীতে? একদম ভোর থাকতে লাইন পড়ে যায়। কারণ, এই উদ্যানবাটীতেই ১৮৮৬ সালের পয়লা জানুয়ারিতে ঠাকুর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস কল্পতরু হয়েছিলেন। সেই কল্পতরু উৎসব এখন মহাধুমধাম করে সর্বত্র পালিত হয়। পালিত হয় এই পয়লা জানুয়ারিতেই।

আর যাঁরা কোথাও যান না? বনভোজনেও না? তাঁরাও এ দিন বাড়িতে নয়, খাওয়াদাওয়াটা বাইরেই করেন। সে যত পাতি হোটেলই হোক না কেন।

আমাদের এখানে মূলত বর্ষবরণের উৎসব শুরু হয়  রাত ১২টায়। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত হয় সবাই। কিন্তু তার বেশ কয়েক ঘন্টা আগেই নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া-সহ বিভিন্ন দেশে আলোর রোশনাই, আতসবাজির ভেলকি, মদোর ফোয়ারা আর উচ্চস্বরে নাচাগানের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়ে যায় বর্ষবরণ৷ 

এর পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, গোটা পৃথিবী কিন্তু এই পয়লা জানুয়ারিকেই নববর্ষের সুরুয়াত হিসেবে গ্রাহ্য করে না। যেমন আরব দেশ। ওখানে ১ জানুয়ারিরকে হিজরি অর্থাৎ নববর্ষ হিসেবে মান্য করা হয় না। ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা কিংবা তিউনিসিয়ায় নতুন বছর শুরু হয় অগস্ট থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে। নভেম্বর মাসে চিন এবং মার্চ মাস ইতালিতে নববর্ষ উদযাপন করা হয়। তাদের চিরাচরিত রীতি মেনে। শুধু এরাই নয়, এ রকম আরও অনেক দেশই কিন্তু গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে এখনও পর্যন্ত গ্রহণ করেনি।

যেমন সৌদি আরব, নেপাল, ইরান, ইথিওপিয়া ও আফগানিস্তান। এ সব দেশে ইংরেজি নববর্ষ পালন করা হয় না। আবার ইসরায়েল গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করলেও ইংরেজি নববর্ষ পালন করে না। আবার কিছু কিছু জাতি ও দেশের নিজস্ব নববর্ষ আছে। ইংরেজির পাশাপাশি তারা নিজেদের সেই কৃষ্টি আর সংস্কৃতিকেও ধরে রেখেছে মর্যাদার সঙ্গে। যেমন ইহুদি ও মুসলমানরা তাদের নিজ নিজ ক্যালেন্ডার অনুসারে নববর্ষ পালন করে থাকে। তবে হ্যাঁ, এখন এ সব অনেক শিথিল হয়েছে। নিজস্ব রীতিনীতি, ঐতিহ্য এবং ঘরানা বজায় রাখলেও, ফার্স্ট জানুয়ারি কিন্তু ইতিমধ্যে মহাসমারোহে পালন করা শুরু করে দিয়েছে অনেকেই।যে যে-দিনই নববর্ষ উদযাপন করুন না কেন, সে দিনটি কিন্তু নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, ব্রাহ্মণ-অচ্ছুৎ--- সবাই, সবাই সব দুঃক্ষ-কষ্ট, পরাজয় আর হতাশা, পুরনো যা কিছু আছে, জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলে বছরের এই নতুন দিনটিতে আবার নতুন করে জীবন শুরু করার জন্য মেতে ওঠেন। ভাগ করে নেন আনন্দ। এখানেই ফার্স্ট জানুয়ারির সার্থকতা এবং জয়।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics