নতুন সকাল
নতুন সকাল
ফুল দিয়ে সাজানো ঘরটায় ঢুকে তৃণার ফটোটার দিকে চোখ পড়তেই বুকের ভিতরটা মুচড়ে ওঠে সবুজের। আজকের দিনে অন্তত ফটোটা এই ঘরে রাখার জেদ না করলেই মনে হয় ভালো হতো। একটা সিগারেট ধরিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় সবুজ। যদিও আর ভেবে কিছু করার নেই? তবুও মনের দ্বন্দটা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারছে না কিছুতেই।
রোগটা ধরা পরার পর তিনটে মাসও সময় পেলনা , ডাক্তারদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে তৃণা চলে গেছে আজ তেরো মাস হলো । তৃণার চলে যাওয়ার কষ্টটুকু সবুজ সহ্য করছে বাগিচাকে বুকে জড়িয়ে । আড়াই বছরের ছোট্ট মেয়েটা মৃত্যু কি বোঝেনি , শুধু মা-কে খুঁজেছিল আকুল হয়ে । আর অজানা অশঙ্কায় আরো আঁকড়ে ধরেছিল বাপীকে । খবরটা পেয়ে আত্মীয়স্বজন সবাই ছুটে এসেছিল ওদের শিলিগুড়ির ফ্ল্যাটে । সবাই মিলে ভাগ করে নিলে আনন্দ যেমন বাড়ে , শোক তেমনি কিছুটা লাঘব হয় । সবার মাঝে বাগিচাও কিছুটা সহজ হয়েছিল । কিন্তু সবাই ফিরে যেতেই যেন তৃণার না-থাকাটা আরো প্রকট হয়ে ওঠে । তৃণার মা-বাবা নাতনিকে দিল্লিতে নিজেদের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল । কিন্তু সবুজ মেয়েকে ছাড়তে পারেনি । সবুজের নিজের বাবা-মা বেঁচে থাকলে হয়তো এইসময় ওদের কাছে এসে থাকত । কিন্তু তাঁরা তো চলে গেছে সেই কবেই !!!!
জীবনের টানে শোক ভুলে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতেই হয় সবাইকে । সবুজকেও ধীরে ধীরে ফিরতে হয়েছে জীবনের ছন্দে । তবু তৃণাকে ছাড়া চলতে বারবার ছন্দপতন হয়ে যায় সবুজের । শরীরের ওপর অনিয়মে অনিয়মে ছ'মাস না যেতেই জন্ডিসে পড়ে সবুজ । কাজের লোক রান্না , ঘরের কাজটুকু করে দিয়ে গেলেও সংসারের হাল ধরার যে কেউ নেই । মেয়েটাও দিনে দিনে কেমন জেদি হয়ে উঠছে । যখন যেটা চাইবে বাপী সেটাই এনে দেবে এমন একটা অভ্যাস হয়ে গেছে । কি করে যে কি করবে দিশেহারা অবস্থা সবুজের ।
একদিন তো তৃণার ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদেই ফেলে , কেন এমন করে চলে গেলে তৃণা ? তুমি তো জানতে আমি তোমাকে ছাড়া কোন কাজটাই গুছিয়ে করতে পারি না ।
বাপী কাঁদছ কেন ?
বাগিচার কথায় হাতের তালুতে চোখের জল মুছে সঙ্গেসঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে যেতে হয়েছিল সবুজকে । ঐটুকু মেয়ে এখনো জানে না ওর মাম্মা আর আসবে না । ও জানে মাম্মা ডাক্তারের কাছে আছে , একদিন সকালে বাড়ি চলে আসবে ।
প্রতিরাতে ঘুম পাড়াতে হয় মাম্মের গল্প বলে ।
দিদিই প্রথম কথাটা বলেছিল ফোনে , তুই আর একটা বিয়ে কর ভাই । বাগিচাও একটা মা পাবে । সংসারটাও ভেসে যাবে না । আর তোর বাকি জীবনটাতেও একজন সঙ্গী তো চাই ।
দিদির কথা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল সবুজ । আবার বিয়ে ? বাকি জীবনের সঙ্গী ? তৃণাই সঙ্গী ছিল আর তৃণাই থাকবে , তৃণার জায়গায় কাউকে বসাতে পারবে না সবুজ । আর সৎমা এসে কি মায়ের ভালোবাসা দেবে বাগিচাকে ? উল্টে অশান্তি আরো বাড়বে ।
কিন্তু একে একে বন্ধুবান্ধব , আত্মীয়স্বজন সবার কাছ থেকে একই পরামর্শ শুনতে শুনতে সত্যিই চিন্তিত হয়ে পড়ে সবুজ । তবে কি ওর একার পক্ষে বাগিচাকে মানুষ করা সম্ভব নয় ? সত্যি কি অগোছালো সংসারটাকে আবার গোছাতে একজন স্ত্রী-র দরকার ? কিন্তু সে যদি বাগিচাকে নিজের সন্তানের মতো কাছে টেনে না নেয় ?
তিনচার মাস মনের সাথে টানাপোড়েনের পর সাথীকে বিয়ে করতে রাজি হয় সবুজ । ওর এক অফিস কলিগের খুড়তুতো বোন , মালদায় থাকে । বিয়ে হয়েছিল পাঁচবছর আগে । কিন্তু দুবছরেও সন্তান না আসায় ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল , তখনি পরীক্ষা নিরিক্ষা করে জানতে পারে সাথী গর্ভধারণে অক্ষম । সাথী কখনো মা হতে পারবে না । বংশরক্ষার দায়টুকুই যে পালন করতে পারেনা , সে কেমন স্ত্রী! সাথীর সংসারটা টেকেনি, ভেঙে গিয়েছে ওদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। এখন একটা মন্টেসরি স্কুলে পড়ায়। সবুজের মনে হয়েছিল স্বভাব সুলভ মাতৃত্বে সাথীই হয়ত পারবে বাগিচাকে কাছে টেনে নিতে ।
বিয়েটা ঠিক হয়ে থেকেই মেয়েকে সমানে বুঝিয়ে গেছে সবুজ , মাম্মা আবার বাড়িতে আসবে । যেন লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকে , মাম্মার সব কথা শোনে। সবটুকু মন দিয়ে শুনেছিল বাগিচা, কদিন খুব খুশি খুশি ছিল মেয়েটা ।
কিন্তু গতকাল সাথীকে নিয়ে এবাড়িতে ঢোকার পর কেমন যেন বদলে গেল মেয়েটা । সাথী যে ওর নিজের মাম্মা নয় বুঝতে পেরে গেল ? সবাই এখন বলছে ওকে বলা উচিত ছিল একটা নতুন মা আসবে । তাই হবে হয়তো , ভুলটা সবুজ-ই করে ফেলেছে । ভেবেছিল ঐটুকু মেয়ের স্মৃতিতে হয়তো অতো গভীর ভাবে ধরা নেই ওর মায়ের স্মৃতি । সাথী কতবার ডেকেছে , কাল থেকে একবার ও ওর কাছে যায়নি । দিদি এসেছে , দিদির কাছেই সারাটা দিন থেকেছে । কাল রাতে অবশ্য রোজকার মতো বাপীর সাথেই শুয়েছিল । তখন মেয়েকে আদর করে অনেক বুঝিয়েছে সবুজ । কতটা বুঝেছে আর কি বা বুঝেছে সে শুধু ওই জানে । আজো একবার ও সাথীর সাথে কথা বলেনি ।
রেজিস্ট্রি বিয়ে হলেও , নিয়মমত আজ ওদের ফুলশয্যা । তার ব্যবস্থাও হয়েছে । কিন্তু সবুজের মনে শান্তি নেই , মনে হচ্ছে বড় কোন ভুল করে ফেলল । বিয়ের আগে একবারো ভাবেনি বাচ্চা মেয়েটা নতুন একটা মানুষকে কিভাবে গ্রহণ করবে । বাচ্চারা যে এতটা সেনসেটিভ হয় ভাবতেও পারেনি সবুজ। সাথীও কিছুটা মনমলা। হয়তো আবারও মা হতে না পারার যন্ত্রণা।
বাপীকে ছাড়া রাতে শুতে পারেনা বাগিচা । মেয়েটাকে ঘুম পারিয়ে উঠে এসেছে সবুজ । দিদি বলেছে আজকের রাতটা মেয়েকে নিয়ে শুলে সেটা নাকি সাথীর প্রতি অন্যায় করা হবে । আজো ঘুম পারানোর সময় সবুজ কতবার বলেছে , এই মাম্মাটা তোমাকে খুব ভালোবাসে । তুমি যাচ্ছো না বলে মাম্মা কত্তো কষ্ট পাচ্ছে । বাগিচা ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়েছিল একবার ওর বাপীর দিকে । কি জানি কি বলতে চাইছিল !!!! নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগছে সবুজের ।
অনেকটা রাত হয়ে গেছে , ঠান্ডাও লাগছে বাইএরে । ঘরে ঢুকে ব্যালকনির দরজাটা বন্ধ করে দেয় সবুজ । ফুলে সাজানো ঘরটাও যেন মলিন লাগছে সবুজের । বিছানার একপাশে বসে আছে সাথী । ওর সাথেও ঠিকমত সহজ হতে পারছে না সবুজ । তৃণা ফটোর দিকে চোখ পড়তেই মনে মনে বলে ওঠে সবুজ , ক্ষমা কোরো , না বুঝে অনেক বড়ো ভুল করে ফেললাম । যদি পারো সবটুকু সহজ করে দাও তৃণা ।
বিছানার দুই প্রান্তে অচেনা দুটো মানুষ । অজানা ভবিষ্যতের চিন্তায় দুজনেই হয়তো জেগে । ভোররাতে চোখটা হয়তো লেগে গিয়েছিল দুজনেরই । হঠাৎ টেবিলের ফুলদানিটা মাটিতে পড়তেই ঘুমটা ভেঙে যায় দুজনের । খাটটা যেন নড়ছে , জানলার কাঁচগুলোয় কাঁপছে ।
ভূমিকম্প !!!!!!!!!
ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে সবুজ , পিছন পিছন সাথীও । অন্যঘর থেকেও বেরিয়ে পড়েছে সবাই । দিদির কোলে বাগিচা , হঠাৎ বাড়িময় হৈচৈ এর কারণটা বুঝতে না পেরে কাঁদতে লেগেছে । কিছু না বুঝুক এটা বুঝেছে , ভয়ের একটা কিছু হয়েছে ভেবেই ভয় পেয়ে গেছে বেচারী । দিদির কোল থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ছুটে আসে সবুজের দিকে ।
সবাইকে অবাক করে সবুজের বদলে জড়িয়ে ধরে সাথীকে । সাথী সঙ্গে সঙ্গে ওকে কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে ।
দুজনের মাঝে শুয়ে সাথীর গলাটা জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গেছে বাগিচা । একটা নরম হাত স্পর্শ করে সবুজের হাতটা । একটু চমকে গেলেও মুহুর্তে বুঝে যায় সবটুকু । নরম হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে নিজের মুঠোর মধ্যে ।
সবুজের অনেকটা হালকা লাগছে এখন নিজেকে।
ভোর রাতের ভূমিকম্পটা আজ ভাঙার বদলে নতুন করে জুড়ে দিল সবুজের ভাঙা সংসারটা ।
জানলার কাচ দিয়ে আসা আলোর আভা জানান দিচ্ছে নতুন সকালের।