Subhashis Roy

Classics Fantasy Others

4  

Subhashis Roy

Classics Fantasy Others

নজরুলের ‘বিদ্রোহী’- হুইটম্যানের ‘সঙ অফ মাইসেল্ফ’-এর প্রতিধ্বনী?

নজরুলের ‘বিদ্রোহী’- হুইটম্যানের ‘সঙ অফ মাইসেল্ফ’-এর প্রতিধ্বনী?

4 mins
398


১৯২১-এর ডিসেম্বর মাসে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনা করে নজরুল সরাসরি চলে যান জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে। উচ্চকণ্ঠে ‘দে গরুর গা ধুইয়ে’ গাইতে গাইতে নজরুল ঠাকুর বাড়িতে প্রবেশ করে ডাকলেন গুরুদেব আমি এসেছি।

“উলটে গেল বিধির বিধি

আচার বিচার ধর্ম জাতি,

মেয়েরা সব লড়ুই করে,

মদ্দ করেন চড়ুই-ভাতি!”


তারপর উচ্চস্বরে আবৃত্তি করতে থাকেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি।

“বল বীর-

বল উন্নত মম শির!

শির নেহারী’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রীর”!

তিনি রবীন্দ্রনাথকে বলেন, গুরুদেব আমি আপনাকে খুন করবো। রবীন্দ্রনাথ ‘বিদ্রোহী’ কবিতা শুনে কবিতার প্রশংসা করেন এবং নজরুলকে জড়িয়ে ধরে বলেন ‘সত্যিই তুই আমাকে খুন করেছিস’।

চলুন এই প্রসঙ্গে বিদ্রোহী কবিতার ইতিহাসটা তুলে ধরি। ‘বিদ্রোহী’ নজরুলের প্রথম প্রকাশিত কাব্য ‘অগ্নিবীণা’র দ্বিতীয় কবিতা। কাজী নজরুল ইসলাম দোয়াত-কলমে কবিতা লিখতেন। দোয়াতের কালিতে বার বার কলমের নিব চুবিয়ে তিনি কবিতা, গল্প, গান লিখেছেন। কিন্তু কালজয়ী বিদ্রোহী কবিতা লিখেছেন পেনসিল দিয়ে। ‘বল বীর বল উন্নত মম শির’ এমন লাইন একটানে কাঠ পেনসিল দিয়ে লিখে নিজে তো ইতিহাস হয়েছেন, বিদ্রোহী কবিতাও ইতিহাস হয়ে গেছে। এক বসাতেই তিনি কবিতাটি লিখেছেন। দিনে নয়, লেখা হয়েছে রাতে। কবে লেখা হয়েছে? সুনির্দিষ্টভাবে সেই তারিখ জানা না গেলেও কবিতাটি লেখা হয়েছে ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। কলকাতার ৩/৪ সি তালতলা লেনের ভাড়া বাড়িতে বসে নজরুল কবিতাটি লেখেন। কবিতার প্রথম পাঠক ছিলেন কমরেড মুজফ্ফর আহমদ। কবিতা লেখার জোশ একেবারে পরিপূর্ণ রাখার জন্যই নজরুল পেনসিল ব্যবহার করেছিলেন। বার বার দোয়াতে কলম চুবিয়ে লিখলে জোশ হারিয়ে যাবে, কবিতার সুর-তাল কেটে যাবে সম্ভবত এই আশঙ্কা থেকেই নজরুল পেনসিল দিয়ে কবিতাটি লেখেন। মাত্রাবৃত্ত মুক্তক ছন্দে কবিতাটি লিখে নজরুল দুনিয়া কাঁপিয়েছেন। কবিরা বলে থাকেন, ‘কবিতার প্রথম লাইন স্বর্গ থেকে আসে। এরপর কবি স্বর্গের সেই লাইন সাজিয়ে কবিতাকে পূর্ণপ্রাণ করেন।’ এক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য করেছি, নজরুল তাঁর বিদ্রোহী কবিতার প্রথম স্তবক মহাকাশ থেকে নিয়ে সাজিয়েছেন,


“মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’

চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি’

ভূলোক দ্যূলোক গোলোক ভেদিয়া

খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,

উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!”

মুজাফ্ফর আহমেদ ‘নজরুল ইসলাম-স্মৃতিকথা’-য় লিখেছেন নজরুলের রচনায় বিদেশী উপাদান একেবারে যে নেই তা নয়। কিন্তু খুব বেশি গভীর নয়। হয়ত তিনি হুইটম্যান ও শেলীর কোনও কোনও কবিতা আগ্রহ সহকারে পড়ে থাকতে পারেন।

নজরুল কাজী মোতাহার হোসেনকে ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯২৮ তারিখে একটি পত্রে লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ আমাকে প্রায়ই বলতেনদ্যাখ্ উন্মাদতোর জীবনে শেলির মতো কিটসের মতো খুব বড়ো ট্র্যাজেডি আছে। তুই প্রস্তুত হ।


শেলীর ভাবই তাই তার চিঠিপত্রে উল্লেখ করে তিনি-ফজিলাতুন্নেসাকে লিখেছেন (৮-৩-২৮),

আচ্ছাআমার রক্তে রক্তে শেলীকে কীটসকে এত করে অনুভব করছি কেনবলতে পারকীটসএর প্রিয়া ফ্যানিকে লেখা কবিতাটা পড়ে মনে হচ্ছেযেন  কবিতা আমিই লিখে গেছি। কীটসএর ‘সোরথ্রোট’ হয়েছিল– আর তাতেই মরল  শেষে– অবশ্য তার সোর্স হার্ট কিনা কে বলবে! – কণ্ঠপ্রদাহ রোগে আমিও ভুগছি ঢাকা থেকে আসা অবধিরক্তও উঠছে মাঝে মাঝে– আর মনে হচ্ছে আমি যেন কীটস। সে কোন ফ্যানির নিষ্করুণ নির্মমতায় হয়ত বা আমারও বুকের চাপধরা রক্ত তেমনি করে কোনদিন শেষ ঝলকে উঠে আমায় বিয়ের বরের মত করে রাঙিয়ে দিয়ে যাবে।

হুইটম্যানের ‘সঙ অব মাইসেল্ফ’ তার কাব্যগ্রন্থ ‘লিভস অব গ্রাস’এর (Leaves of Grass) প্রধান কবিতা। ৫২টি অসমান স্তবকে বিভক্ত ১৩৪৬ লাইনের এই দীর্ঘ কবিতা আত্মজীবনীমূলক।

এখানে তিনি নিজেকে celebrate করছেন, আপনা মহিমা প্রচার করছেন। তিনি উচ্ছল, প্রাণচঞ্চল, আত্মতৃপ্ত। তিনি নাচেন, হাসেন গেয়ে ফেরেন। তার ভাষার তিনি turbulent, fleshy, sensual, eating, drinking, breeding” বার বার উজ্বল স্বাস্থ্য দৈহিক শক্তি প্রখর ইন্দ্রিয় অনুভূতির উল্লেখ করেছেন। তার দেহ থেকে যে প্রচন্ড জ্যোতি বিচ্ছুরিত হয় তা সূর্যর রিশ্মকে প্রতিহত করে দেয়। তিনি সুমহান, অজর, অমর, নিজের ভিতর-বাহিরকে তিনি ঐশ্বরিক বলে বর্ণনা করেছেন। নিজেকে বস্ কিছুর কেন্দ্রবিন্দু বলে চিত্রিত করেছেন। তাকে অনুসরণ করার জন্য সবাইকে উদাত্ত আহবান জানাচ্ছেন। তার মধ্যে প্রকান্ড অহমিকা আছে এবং এই অহমিকা সম্বন্ধে তিনি সচেতন:

“I know perfectly well my own egotism,

Know my omnivorous lines and must not write any less,

And would fetch you whoever you are flush with myself.”

হুইটম্যানের ‘সঙ অব মাইসেল্ফ কবিতার শুরুতেই রয়েছেঃ

“I celebrate myself, and sing myself,

And what I assume you shall assume,

For every atom belonging to me as good belongs to you”.

নজরুলের ‘বিদ্রোহী কবিতাতেও অনুরূপ একটি চরিত্র পাওয়া যায়। তিনিও অসংখ্যবার ‘আমি’ সর্বনামটি ব্যবহার করে নিজের আত্মপরিচয় তুলে ধরেছেন। যে কারণে ‘সঙ অব মাইসেল্ফ’-এর ‘আমি’ এবং কবি এক ব্যক্তি নন, সেই একই কারণে ‘বিদ্রোহী’র ‘আমি’-কেও ব্যক্তি নজরুলের সঙ্গে এক করে দেখা হয় না। হুইটম্যানের ‘আমি’র মতো নজরুলের ‘আমি’ও একটি কাল্পনিক চরিত্র।

তিনি নিজেকে বিদ্রোহী হিসাবে চিত্রিত করেছেন।


হিমালয়ের চেয়েও উন্নত তার শির। তিনি মহাকাশ ফেড়ে, চন্দ্র সূর্য ছেড়ে, খোদার আরশ ভেদ করে চিরবিস্ময় হিসাবে আবির্ভূত রয়েছেন। তিনি উছৃঙ্খল, উন্মাদ, স্বেচ্ছাচারী, ত্রাশ সঞ্চারকারী। তিনি যখন রুশে উঠে মহাকাশে ছুটে চলেন তখন সবগুলো নরক কেঁপে কেঁপে নিভে যায়। তিনি বিধির দর্প চূর্ণ করতে চান। এই সব উক্তির অনেকগুলো তার প্রবল অহমিকার স্বাক্ষর বহন করে এবং এদিক দিয়ে ‘সঙ অব মাইসেল্ফ এর আমির সঙ্গে তার সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।

“আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,

আমি দুর্বার,

আমি ভেঙে করি সব চুরমার!

আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,

আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!”

নজরুল ইসলামতার অহমিকারও পটভূমি আছে এবং সে অহমিকাও ব্যক্তিগত সীমানা অতিক্রম করে নতুন গতিতে ভাস্বর হয়ে উঠেছে।

পরাধীনতার অভিশাপে যে হীনমান্যতা, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা দীর্ঘকাল ধরে পুঞ্জিভূত হয়েছিল, রাজনৈতিক পরিমন্ডল এবং গতানুগতিকতা যে ভাবে মনুষত্বকে খর্ব করছিল, আমির দৃপ্ত অহংকারকে তার বিরুদ্ধে একটা আবেগময় প্রতিক্রিয়া হিসাবে ব্যাখ্যা করাটা হয়তো কষ্টকল্পিত হবে না। তবে এটা স্পষ্ট যে ‘আমি’ শুধু একজন ব্যক্তি নন, তিনি এমন একজন অপূর্ব জাগরণের মহানন্দে উচ্চকিত। তিনি নিজেকে –

আমি   উত্থান, আমি পতনআমি অচেতনচিতে চেতন,

আমি   বিশ্বতোরণে বৈজয়ন্তীমানববিজয়কেতন”।

তিনি সহসা নিজেকে চিনতে পেরছেন।

“আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!

আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ”!

তিনি এখন সকল বন্ধনমুক্ত আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকে কুর্নিশ করেন না। তিনি অজর, অমর, জগদীশ্বর-ঈশ্বর পুরুষত্তোম সত্য।

https://swadestimes.com/magazines/nojrul-an-article-written-by-indrajit-sengupta


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics