Sucharita Das

Inspirational

3  

Sucharita Das

Inspirational

নিষিদ্ধ প্রজাপতি

নিষিদ্ধ প্রজাপতি

7 mins
818


"ও মিনু তোর গায়ে প্রজাপতি বসেছে রে।দেখবি খুব তাড়াতাড়ি তোর বিয়ের ফুল ফুটবে"। ঠাকুমার সেই কথাগুলো আজ মিনুর খুব বেশি করে মনে পড়ছে। সত্যিই কি বিয়ের আগে গায়ে প্রজাপতি বসে নাকি। কিন্তু মিনুর ক্ষেত্রে তো কথাটা সত্যি হয়েছিল। মিনুর এরপরই বিয়ে হয়েছিল। সুন্দরী তো ও ছিলো ই। একবার দেখাতেই তাই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল।এরপরের ঘটনা গতানুগতিক। বিয়ে হয়ে গিয়েছিল মিনুর বেশ ধুমধাম করে। বিয়ের দিন সন্ধ্যে বেলা মিনুকে অসম্ভব সুন্দর লাগছিল। পাত্রপক্ষের অনেকেই মিনুর রূপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল। অবশ্য পাত্র হিসেবে ওদের কাছে সুনন্দ ও কোনো কম ছিলো না। মিনু বা ওর বাড়ির লোকজন তো স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে এরকম পাত্র বা তার পরিবারের সঙ্গে এতো কম দিনের মধ্যে ওদের আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠবে। তবে এসবই সম্ভব হয়েছিল শুধুমাত্র মিনুর চোখ ঝলসানো রূপের জন্য। আর মিনুর এই রূপ ওর বাড়ির লোকজনের কাছেও অত্যন্ত গর্বের বিষয় ছিল। কিন্তু কথায় আছে, অতি বড়ো সুন্দরীর না জোটে বর,আর অতি বড় ঘরনীর না জোটে ঘর। আর তাই মিনুর এই চোখ ঝলসানো রূপ কি ,এই প্রবাদ বাক্যের সঙ্গে মিলে গেল? সেটা জানতে হলে পরের ঘটনা জানতে হবে আমাদের।


বিয়েতে পাত্রপক্ষ কোনো রকম পণ দাবি করেনি। মিনুর বাড়ির লোকজন ভেবেছিল,এত অবস্থাপন্ন পরিবার। ওদের দরকার টা ই বা কি। শুধু মেয়ে সুন্দরী হয় যেন, এটাই তো ওদের দাবি ছিল। সেই দাবি ওদের পূর্ণ হয়েছে। বিয়ের পর মিনু শ্বশুর বাড়ি গিয়ে অবাক। কি সুন্দর ঘরবাড়ি ওদের। মনে মনে খুব খুশী হয়েছিল ও। এখন থেকে তো এটা ওর ও বাড়ি।এই বাড়িকে সাজিয়ে গুছিয়ে সর্বাঙ্গ সুন্দর করে রাখার দায়িত্ব তো ওর ও।বধূবেশে লজ্জাবনত মুখে ও প্রবেশ করেছিল সম্পূর্ণ নতুন এক পরিবেশে। মনের মধ্যে এক অজানা ভয়, উৎকণ্ঠা সব ই ছিল। নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে কি না?কেমন ই বা হবে অজানা মানুষগুলো।সব মিলিয়ে মিনু বেশ ভয়েই ছিল। দুধ-আলতায় পা রাঙিয়ে, আর মনের মধ্যে হাজার রঙিন স্বপ্ন সাজিয়ে মিনু নতুন বাড়িতে প্রবেশ করেছিল।


সেদিন সন্ধ্যে বেলা সবাই হেসে বললো মিনুকে, আজ ওদের কালরাত্রি। তাই ও সুনন্দর সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। মিনু লজ্জায় মাথা নিচু করে বসেছিল। হঠাৎই মিনুর ঘরে একজন কমবয়সী মহিলা খুব তাড়াতাড়ি ঢুকে এলো। ঘরে ঢুকেই মহিলা দরজাটা বন্ধ করে দিলো তাড়াতাড়ি। মিনু একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল ভদ্রমহিলার এহেন আচরণে।ও কিছু জিজ্ঞাসা করবার আগেই ভদ্রমহিলা ওকে বললো,"আমি তোমার সঙ্গে বেশি কথা বলতে পারব না এখন,কেউ এসে পড়বে। শুধু একটা কথাই বলতে চাই, যত তাড়াতাড়ি পারো এই নরক থেকে পালিয়ে যাও তুমি।"শুধু এইটুকু কথাই বলেছে ভদ্রমহিলা, তারপরই হঠাৎই দরজার বাইরে কারুর গলার আওয়াজ পেয়ে ভদ্রমহিলা তড়িঘড়ি দরজা খুলে দিয়ে ইতস্তত করে বললো,"ও কাপড় পাল্টাতে চাইল , তাই দরজা টা বন্ধ করে ছিলাম।" কথাটা বলেই মিনুর দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল ও তাড়াতাড়ি ভীত সন্ত্রস্ত মুখে। মিনু ঠিক বুঝতে পারছিল না ওর এই আচরণের অর্থ।


যাকে দেখে ভদ্রমহিলা তড়িঘড়ি বেড়িয়ে গেল, তিনি মিনুর শাশুড়ি। ঘরে ঢুকেই উনি জিজ্ঞেস করলেন, "কি বলতে এসেছিল ও তোমাকে?" মিনু কে উদ্দেশ্য করে কথাটা জিজ্ঞেস করলো ওর শাশুড়ি। কেন জানে না মিনু, ওই অল্পবয়সী মহিলার ওকে সাবধান করে যাওয়ার কথাটা ও বললো না ওর শাশুড়ি কে। যদিও উনি অনেকরকম ভাবেই চেষ্টা করেছিলেন জানবার,তাও মিনু বলেনি কিছুই। সেদিন রাত্রি বেলা মিনু একা ই শুয়েছিলো। নতুন জায়গা তাই ঘুম ও আসছিল না ওর। ভোরবেলা তাড়াতাড়ি উঠে ও বাইরের বাগানে একটু ঘোরাঘুরি করছিলো।কি সুন্দর ফুলের সমারোহ চারিদিকে। খুব ভালো লাগছিলো ওর। হঠাৎই কে যেন ওর হাতটা ধরে জোর করে ওকে টেনে নিয়ে গেল একটা গাছের আড়ালে। মিনু প্রথমটা হকচকিয়ে গেলেও পরে দেখলো ,সেই অল্পবয়সী ভদ্রমহিলা,যে গতকাল রাত্রি বেলা ওর ঘরে ঢুকে ওকে কথা গুলো বলেছিল। ভদ্রমহিলা আজও মিনুকে বললো," এই নরক থেকে যত তাড়াতাড়ি পারো বেরিয়ে যাও। তোমার বাবা মা বিয়ের আগে একটু খোঁজ খবর নিতে পারলেন না। " 

মিনু আজ ভদ্রমহিলা কে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, "আপনি কে?কেনই বা আমাকে এরকম ভয় দেখাচ্ছেন?"

ভদ্রমহিলা বললো,"তোমাকে ভয় দেখিয়ে আমার কোনো লাভ নেই। আমিও এই বাড়িতে অনেক আশা নিয়ে এসেছিলাম বিয়ের পর। কিন্তু আমার সব আশা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছিল এখানে আসার পর। আমার আর কোনো উপায় নেই এই নরক থেকে বেরোবার। কিন্তু তুমি এই নরকে থেকে নিজের জীবন নষ্ট করোনা। পালিয়ে যাও এখান থেকে। যদিও খুব কঠিন কাজ এটা, তাও চেষ্টা করে দেখো যদি পারো পালাতে।"

কথাগুলো কোনোরকমে বলেই মহিলা আবার তড়িঘড়ি চলে গেল। মিনু হতবাকের মত দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎই পেছন থেকে ওর শাশুড়ি এসে ওকে আবার জিজ্ঞাসা করলো যে কি বলছিল ওই ভদ্রমহিলা। মিনু তো এটাই বুঝতে পারছিল না যে, বারবার ওর শাশুড়ি ই বা কেন ও কোথাও একা থাকলে বা যদি কেউ ওর সঙ্গে কথা বলতে আসছে, তাহলে ওকে অনুসরণ করছে । তবে কি ভদ্রমহিলার কথাই ঠিক? এরা কি সত্যিই সন্দেহ করবার মতো? একটা অদ্ভুত দোটানা পরিস্থিতির মধ্যে মিনু পড়েছে । কাকে বিশ্বাস করবে ও সেটাই বুঝতে পারছে না।



আজ মিনু র বৌভাত। সারা বাড়িতে আলো ঝলমল করছে। খুব সুন্দর করে সাজিয়ে মিনুকে যখন বসানো হলো,ঠিক রাজেন্দ্রাণীর মত লাগছিলো ওকে। খুব বেশি অতিথি ছিল না অনুষ্ঠানে।ওর বাপের বাড়ির লোকজন ও কম ই এসেছিল। মিনুর চোখ কিন্তু একজনকেই খুঁজছিল। আর সেটা হলো কালকের সেই অল্পবয়সী ভদ্রমহিলা। কিন্তু কোথাও মিনু তাকে দেখতে পাচ্ছিল না।ওই ভদ্রমহিলার পরিচয় জানা খুব জরুরী ওর জন্য। আর তার সঙ্গে এটাও জানা জরুরী যে, কি অপেক্ষা করে আছে ওর জন্য। কিন্তু কোথাও ওকে দেখতে পাচ্ছিল না মিনু। অতিথিরা চলে যাবার পর, ওর শাশুড়ি মিনুকে আর সুনন্দকে নিয়ে খাবার জায়গায় গেল। মিনু একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছে যে, ওর শাশুড়ি ছাড়া সেভাবে আর কোনো মহিলা ওর কাছে আসেনি। শুধু কালকের ওই অল্পবয়সী মহিলা ছাড়া। তাও ওর শাশুড়ির অমতে। ওর শাশুড়ি কেমন যেন সবসময় চোখে চোখে রাখছিল মিনুকে সবসময়।যাতে ওর কাছে কেউ আসতে না পারে।



মিনু কে ওর শাশুড়ি খাওয়ার পর, একটা ঘরে নিয়ে গেল।না এটা কালকে রাতে মিনু যে ঘরে শুয়েছিল, সেই ঘরটা না। ঘরের ভেতর বিশাল একটা খাট সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো। সুসজ্জিত ফুলের বিছানায় মিনু কে বসিয়ে,ওর শাশুড়ি বললো, অপেক্ষা করতে সুনন্দ র জন্য। এবার যেন কিরকম একটা খটকা লাগলো মিনুর মনে।ও শুনেছে বা দেখেওছে যে ফুলশয্যার রাতে শাশুড়ি কোনো নববিবাহিতা বধূকে তার ঘরে ছাড়তে আসে না।আসে ননদ, বৌদি এরা। বিভিন্ন রকমের আচার অনুষ্ঠান ও হয় এখানে নব দম্পতিকে নিয়ে। কিন্তু কখনও কোনো শাশুড়ি এভাবে একা ছেড়ে দিয়ে যায় না । দূরে বাইরে একটা কুকুর কেমন যেন কেঁদে উঠলো। মিনুর বুকের ভেতরটা অজানা আশঙ্কায় কেমন যেন কেঁপে উঠল।ও খাটের উপর জড়োসড়ো হয়ে বসে রইল। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে গেছে ওর শাশুড়ি যাবার সময়। মিনু বসে বসে ওর চোখটা হালকা বন্ধ হয়ে এসেছিল।কাল সারারাত ঘুমোয় নি ও। হঠাৎই কেউ ওকে জোরে জোরে ধাক্কা দিতেই ও চমকে উঠে দেখলো, সেই অল্পবয়সী ভদ্রমহিলা। মিনু কিছু বোঝার আগেই সে বললো, আমার সঙ্গে চলো। নাহলে সারা জীবন এই নরকে বাস করতে হবে। আজ আর মিনু কোনো প্রশ্ন করলো না।কেমন যেন ঘোরের মধ্যে ও ওই ভদ্রমহিলাকে অনুসরণ করে গেল।এদিক ওদিক ভালো করে দেখে, ভদ্রমহিলা পিছনের বাগানের দিকে একটা দরজা দিয়ে মিনুকে পালিয়ে যেতে বললো। মিনুকে শুধু এটুকু ই বলেছিলো ভদ্রমহিলা যে,ওর নাম নমিতা। আজ থেকে দুবছর আগে ওকেও নাকি এইভাবেই বিয়ে করে নিয়ে এসেছিল এরা। তারপর থেকে প্রতি রাতেই নতুন নতুন পুরুষ মানুষ এনে ওর ঘরে ঢুকিয়ে দিতো এরা। এরা কেউই মা, বাবা, ছেলে না। পুরোটাই সাজানো একটা চক্রান্ত। প্রতিবাদ করতে গেলে খুনের হুমকি দেয় ওকে।ওর আগে ও নাকি আরও দুটো মেয়েকে এইভাবেই বিয়ে করে নিয়ে এসেছিল। তারা প্রতিবাদ করতে গিয়েছিল,তাই তাদের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। পয়সার জোরে এরা অপরাধী হয়েও সমাজে খোলাখুলিভাবে ঘোরাঘুরি করছে। নমিতা নিজেকে তো সেদিন বাঁচাতে পারেনি ‌। কিন্তু মিনু কে দেখে ও সেদিন ই ঠিক করে নিয়েছিল যে, মিনু কে ও নিজের জীবন দিয়ে হলেও বাঁচাবে।আর তাই বারবার ওকে সাবধান করতে আসছিল ও। নমিতা মিনু কে বলে দিলো কিভাবে গেলে ও তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পারবে স্টেশন। কিছু টাকাও ওর হাতে দিয়ে দিয়েছিলো ও। মিনু যাবার আগে নমিতার হাত দুটো ধরে কথা দিয়েছিল, বাঁচাবে ও নমিতাকে এই নরক থেকে।



পরদিন মিনু নিজের বাড়িতে পৌঁছে সব বলেছিল সবাইকে। তারপর বাবা,কাকা কে সঙ্গে নিয়ে পুলিশ স্টেশনে। ওখানে সমস্ত ঘটনা জানিয়ে পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে পরেরদিন গিয়েছিল ওদের বাড়িতে। কিন্তু ওরা কোনো ভাবে জানতে পেরে আগেই পালিয়ে গিয়েছিল সবাই। মিনুর খুব মনটা খারাপ লাগছিল নমিতার জন্য।যে মেয়েটা নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে ওকে বাঁচিয়েছে।তার জন্য কিছু করতে পারলো না ও। হঠাৎই সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে একটা অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ কানে গেল মিনুর।আওয়াজ শুনে কাছে গিয়ে দেখলো, একটা বদ্ধ ঘরের মধ্যে থেকে আওয়াজ টা আসছে। পুলিশ দরজা ভেঙ্গে হাত,পা,মুখ বাঁধা অবস্থায় নমিতাকে উদ্ধার করেছিল।কেমন যেন অচৈতন্য অবস্থায় আছে নমিতা। তাও ওকে উদ্ধার তো করতে পেরেছে এই নরক থেকে মিনু। নমিতাকে দেওয়া কথা ও রাখতে পেরেছে। মেয়েটা এতদিন অনেক কষ্ট সহ্য করেছে এই নরকে। একটা সুস্থ জীবন তো ওকে মিনু উপহার দিতে পারবে।আর অপরাধীদের শাস্তি দেবার জন্য পুলিশ তো আছেই।


***আপনার মেয়ে আপনার কাছে অমূল্য সম্পদ। তাকে কারুর হাতে তুলে দেবার আগে অবশ্যই যথাযথ খোঁজ খবর নিয়ে তবেই এগোন। মিনুকে বাঁচানোর জন্য নমিতা এগিয়ে এসেছিল। সবার ক্ষেত্রে সেটা না ও হতে পারে। তাই সতর্ক থাকুন।              


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational