STORYMIRROR

Mr. Ranajit Singh

Tragedy

3  

Mr. Ranajit Singh

Tragedy

নদীর ওপারে

নদীর ওপারে

6 mins
340

রাতের অন্ধকারে আকাশ ভেঙ্গে পড়া বৃষ্টি, তার ওপর পাহাড়ি রাস্তা। বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্য নিয়ে কার ড্রাইভ করছি। আজ প্রায় আট বছর পর আমি নিজের মা বাবার সাথে দেখা করতে চলেছি। “ দ্যি স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নিউ ইয়র্ক ” - আমি এডমিশন পেয়ে গেছিলাম। তাই পড়াশোনা পুরো করার জন্য আমাকে পাঁচ বছরের জন্য নিউ ইয়র্ক এ যেতে হয়েছিল। পড়াশোনা শেষ করার পরেও আরো তিন বছর ঐখানে ই ছিলাম চাকরির জন্য। আজ আট বছর পর আবার নিজের দেশে নিজের বাড়িতে ফিরছি। মা বাবার কথা খুব মনে পড়ছে। পুরো রাস্তা অন্ধকারময়। প্রবল বেগে ঝড়-বৃষ্টির কারণে সামনের রাস্তাটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। তার উপর হরহরে রাস্তা। ইতি মধ্যেই আমার গাড়ির গতিবেগ চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। হঠাৎ গাড়ির ব্রেকফেল!.. আমি ভালো ভাবে বোঝার চেষ্টা করলাম, কিন্তু না..., সত্যি সত্যি ব্রেকফেল ই হয়েছে!.. আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়ির গতিবেগ আগের তুলনায় বেড়ে চলেছে। গাড়ির পাগলের মতো এদিক ওদিক দৌঁড়াচ্ছে। আমি বহুকষ্টে গাড়িটাকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি অতিরিক্ত আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ একটা জোড়ে শব্দ হলো, আর চারিদিক নিস্তব্ধতায় পরিণত হয়ে গেল। 


মিনিট দশেক পর: 

আমার জ্ঞান ফিরে আসায়, আমি নিজেকে রক্তাক্ত অবস্থায় পেলাম। বহু কষ্টে আমি কোনো রকম ভাবে গাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলাম। আমার মাথা থেকে এখন ও রক্ত ঝরে পড়ছে। আমার হাতে এবং পায়ে ও ভালো রকম আঘাত লেগেছে। আমি নিজের মন কে শক্ত করে নিয়ে দাঁড়ালাম। আমার গাড়ির থেকে প্রায় হাত দশেকের দূরত্বে, একই অবস্থায় আরও একটা গাড়ি পড়ে আছে। আমি বুঝে গেলাম যে, নিশ্চিত এই গাড়ির সাথেই আমার গাড়ির এক্সিডেন্ট হয়েছে। আমি কোনো রকমে খোঁড়াতে খোঁড়াতে সেই গাড়ির কাছে গিয়ে পৌঁছলাম। দুঃখের বিষয় গাড়িতে এক ভদ্রলোক এবং তার প্রায় বছর ছয়েকের একটা বাচ্ছা মেয়ে ছিল। দুজনেই প্রচন্ড পরিমানে আহত। ভদ্রলোক আগেই প্রান হারিয়েছেন। কিন্তু সেই বাচ্ছা মেয়েটির নিঃশ্বাস এখন ও চলছিলো। আমি কোনো রকম ভাবে টেনে টুনে গাড়ির বাইরে বের করলাম। মেয়েটির তৎক্ষণাৎ চিকিৎসার প্রয়োজন। আমি সেই মেয়েটিকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে এই অপেক্ষার দাঁড়িয়েছিলাম যে, যদি এখান দিয়ে কোনো গাড়ি যায়, তাহলে একটু সাহায্য চেয়ে নেবো। এই সাহায্যের আশায় প্রায় মিনিট দশেক এক ভাবে দাড়িয়ে রইলাম। তার উপর মুষুলধারে ঝড়ে পড়া বৃষ্টি। অন্যদিকের চিন্তা-ভাবনার কারণ হলো, মেয়েটির তৎক্ষণাৎ চিকিৎসার প্রয়োজন। তা না হলে মেয়েটিকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। প্রথমে শুধু আমার দেহটাই আহত ছিল। কিন্তু এখন এই বাচ্ছা মেয়েটিকে এরকম রক্তাক্ত অবস্থায় দেখার পর, দেহের সাথে সাথে আমার মন ও আহত হয়ে পড়েছে। ক্লান্তির চাদর যেন আমার পুরো শরীরটাকে ঢেকে দিয়েছে। তার মধ্যে অনবরত বৃষ্টিও হয়ে চলেছে। এমন সময় হঠাৎ আমার চোখ পড়ল নদীর ওপারে। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তার ঠিক বাঁদিকে হাত পাঁচেক দূরে একটা স্বল্প খাই রয়েছে। খাই বেয়ে কিছুটা নেমে গেলেই, তার পাশ থেকে একটা নদী বয়ে গেছে। নদীটা খুব একটা দীর্ঘ নয়। নদীর ওপার থেকে একটা আলো আমার দৃষ্টি পর্যন্ত এসে পৌঁছালো। আলোটা কিসের ? তা ঠিক বলা সম্ভব নয়, কিন্তু আলো যখন রয়েছে, নিশ্চয়ই কোন ঘর অথবা দোকান-বাড়ি তো হবেই। সেখানে গেলে হয়তো কিছুটা সাহায্য পাব। এই ভেবে আর কোনো রকম সময় নষ্ট না করে, সেই দিকেই পা বাড়ালাম। আমার মায়ের জন্য একটা খুব সুন্দর শাড়ী কিনে ছিলাম। গাড়িটার ভেতর থেকে সেই শাড়ীটা বার করে নিয়ে, সেই মেয়েটিকে নিজের পিঠে নিয়ে, সেই শাড়ীটা দিয়ে তার সাথে নিজেকে শক্ত করে বাঁধলাম। তারপর খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে গেলাম। সাবধানতা বজয় রেখে, ধীরে ধীরে সেই খাই বেয়ে নীচে নেমে এলাম।


ভাবলাম নদীর আশেপাশে পার হওয়ার মতো কিছু তো হবেই। কিন্তু এদিক ওদিক খোঁজার পরেও পার হওয়ার যোগ্য কিছুই পেলাম না। নদীর জল-স্তরের গভীরতা নীচ পর্যন্ত পরিস্কার দেখা যাচ্ছিল। আমার কাছে আর কোন উপায় ছিল না। তাই আমি সাহস করে জলে নেমে পড়লাম। বৃষ্টির কারণে নদীর জল স্তর আরো বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি জলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে লাগলাম, নদীর ওপার পর্যন্ত যাওয়ার জন্য। এখানে দুঃখের বিষয় একটাই ছিল, যে আমি সাঁতার জানি না। যতদূর ঠাই পাবো ততদূরই যেতে পারবো। নিজেকে এর থেকে বেশি অসহায় আমার কোনদিনও মনে হয়নি এর আগে। আজ প্রথমবার আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম কেন আমি সাঁতার জানি না? যত হেঁটে চলেছি, জলের গভীরতা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। চলতে চলতে হঠাৎ থেমে পড়লাম। নদীর মাঝখানে দাঁড়িয়েই আমি সেই মেয়েটিকে পিঠের থেকে কাধে তুলে নিলাম। আরো কিছুটা দূর হেটে যাওয়ার পর, জল তখন আমার গলা পর্যন্ত। আমি নদীর ঠিক মাঝামাঝি চলে এসেছি। বুঝতে পারছিলাম না কি করবো?... এতদুর পর্যন্ত এসে, এই অবস্থায় আবার ফিরে যাওয়াটা কি উচিত হবে?.. সাহস করে আরও দু পায়ে এগিয়ে গেলাম। জল তখন আমার নাকের কাছ পর্যন্ত চলে এসেছে। আমি ভাবলাম এই যাত্রায় আর নদী পার হওয়া হবে না। কিন্তু কথায় আছে না রাখে হরি তো মারে কে?.. আরো দু পা এগিয়ে যাওয়াতে জলের গভীরতা কমতে শুরু করল।


এবার আমি একটু নিশ্চিন্ত হলাম। প্রায় দশ মিনিট একভাবে সেই জলের মধ্যে দিয়ে চলার পর, শেষমেষ আমি নদীর এপার পর্যন্ত এসে পৌঁছালাম। জল থেকে পাড়ে ওঠার পর আমার মনে হলো, আমি যেন একটা বড় ধরনের যুদ্ধ জিতে নিয়েছি। জল থেকে পাড়ে ওঠার পর মাথা তুলে তাকাতেই যেটা চোখে পড়ল,- আমার দৃষ্টি আকর্ষিত করা সেই আলোটি কোন ঘর অথবা দোকান বাড়ির ছিল না। সেটি ছিল একটি হাসপাতালের !!!..., আমি এতটাই আশ্চর্য হয়ে পড়লাম যে, যেন কোনো কল্পনা বাস্তবের রূপে সম্ভব হয়ে গেছে !!.. আমি প্রথমে ভেবেছিলাম যে এটা সত্যি নয়। এটা আমার একটা ভ্রম অথবা মায়া !!.. কিন্তু না এটা যে সত্যি !!... আজ বোঝা গেল যে ভগবান সত্যিই রয়েছেন। আমি কোনো রকম ভাবে কষ্টেসৃষ্টে সেই মেয়েটিকে নিয়ে হাসপাতালে ভেতর পর্যন্ত এসে পৌঁছালাম। আমার কাঁধ থেকে তাকে নামাতেই, ডাক্তার এবং নার্স দৌড়ে আসলো আমার কাছে। তারা কোনো রকমে মেয়েটিকে নিয়ে সাথে সাথে অপারেশন থিয়েটারের ভেতরে ঢুকে যায়। দাঁড়িয়ে থাকার মতো শক্তি আমার শরীরে আর নেই। আমার শরীর যেন এই মুহূর্তে শূন্য তে পরিণত হয়েছে। আমি কোনো রকমে হাত-পা নেরে, দেওয়ালের গাঁ ঘেঁষে রাখা বেঞ্চটাতে গিয়ে বসলাম গিয়ে বসলাম। এই মুহূর্তে আমার পুরো শরীর যন্ত্রণায় ভেঙে পড়েছে। আমার মাথা থেকে এখনো রক্ত ঝরে পড়ছে। হঠাৎ একটা শব্দ হওয়ায়, আমি বাঁদিক ঘুরে তাকালাম। একটা নার্স অপারেশন থিয়েটারের বাইরে বেরিয়ে এসে আমাকে বলল,- আপনি সঠিক সময়ে এই মেয়েটিকে আনতে সফল হয়েছেন। আর একটু দেরী হয়ে গেলে, হয়তো আমরা মেয়েটিকে বাঁচাতে পারতাম না। চিন্তা করার কোনো কারণ নেই, মেয়েটি এখন বিপদের বাইরে আছে। এই কথাটি শোনা মাত্রই আমার মন-প্রাণ যেন আনন্দে জুড়িয়ে গেল। হঠাৎ নার্স বলে উঠলো,- আরে আপনি ও তো অনেক বেশি আহত..., আপনি এখানেই বসুন।আমি এখনই আপনার চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি। এই বলে সে আবার চলে গেল। আমার চোখ থেকে জল ঝরে পড়তে লাগলো। আমার শরীরে তখন কিঞ্চিত মাত্র শক্তি নেই। আমার দৃষ্টিশক্তি আস্তে আস্তে আবছা হতে লাগল। চোখের সামনে টা কেমন যেন অন্ধকার হয়ে গেল। আমি বেঞ্চ থেকে নিচে পড়ে গেলাম। উঠে দাঁড়ানোর মতো ক্ষমতা আমার মধ্যে আর ছিল না। আস্তে আস্তে আমার চোখ বন্ধ হতে লাগল। বহুকষ্টে একটা নিঃশ্বাস আমার শরীর থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর চির নিস্তব্ধতায় সবকিছু পরিণত হল।

আজ হয়তো আমি আর বেঁচে নেই, কিন্তু সেই বাচ্ছা মেয়েটি আজ ও অবশ্যই বেঁচে আছে। মা বাবার সাথে দেখা করার আমার ইচ্ছাটুকু অসম্পূর্ণ ই রয়ে গেল। কিন্তু সেই বাচ্ছা মেয়েটির নতুন জীবন আমার জীবনের একটা বড় ধরনের শান্তির কারন হয়ে উঠলো।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy