মনের মানুষ
মনের মানুষ
উটি বেড়াতে এসে এমনিতেই খুব খুশি ছিলাম। সেই হানিমুনে বেরিয়েছিলাম বরের সাথে, আবার এত বছর পর বেরোলাম। উটির সৌন্দর্য সত্যিই মনছোঁয়া। সংসারের যাঁতাকলে পড়ে ঘর ছেড়ে আর বেরনো হয় না। খাঁচার বদ্ধ পাখি উটির পাহাড়ি ভূমিতে যেন ডানা মেলে উড়ে বেড়ানোর সুযোগ পেয়েছে।
আজ যাব উটির রোজ় গার্ডেনে। নির্দিষ্ট সময়ে যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছলাম, সত্যিই আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। এত রকমারি ফুল ও এত বিভিন্ন প্রজাতির গোলাপ আমি এর আগে কখনো দেখিনি। কলকাতার বাড়িতে ছোট্ট এক টুকরো জায়গার মধ্যে আমি আমার গার্ডেনিং- এর সখ একটু আধটু মিটিয়ে থাকি বটে কিন্তু এত রকমারি প্রজাতি আমি কখনো দেখিনি।
এত বড় গার্ডেন ঘুরে দেখতে প্রচুর সময় লাগছিল। হঠাৎ এক জায়গায় দেখলাম, বহু মানুষ জটলা করে আছে। কৌতূহলবশত কাছে গিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখতেই বুঝলাম যে, এত সুন্দর ফুলগুলোর মধ্যে কোনো সিনেমার গানের শ্যুটিং চলছে। আশেপাশের লোকজনকে ঠেলে আরেকটু ভালোভাবে শ্যুটিং দেখতে গিয়ে দেখি, শ্যুটিং করছেন স্বয়ং আমাদের বুম্বা দা... প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ছোট থেকেই ভীষণ পছন্দ করতাম ওঁকে। একটা সময়ে তো ভাবতাম, ওঁকেই বিয়ে করব। এখনও ওঁর প্রতি সেই টানটা রয়েছে কিন্তু বিয়ে করার চিন্তাটা আর নেই কারণ যখন থেকে শুনলাম, একাধিক বিবাহ বন্ধন ও সম্পর্কে তিনি আবদ্ধ, তখন মনটাই ভেঙে গেল। আমার স্বপ্নের পুরুষ যে লয়াল হবে না, এ আমি ভাবতেই পারি না। তাই, মনটা সেই সময়ে খুব ভেঙে গেছিল। এখন ওঁকে দেখেই মনের মধ্যে সেই কথাগুলো, প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খেতে লাগল।
কিছুক্ষণ শ্যুটিং দেখে ফেরার পথ ধরলাম। ওখান থেকে বেরিয়ে পাশেই এক বড় রেস্টুরেন্টে খেতে ঢুকলাম। আমরা খাবারের জন্য অপেক্ষা করছি, ওমা, দেখি, বুম্বা দা- ও একই রেস্টুরেন্টে! একটা টেবিলে বসতেই ওঁকে দেখে আশেপাশের টেবিলের সকলে তাকিয়ে দেখতে লাগল। আমি এবার আর নিজেকে দমিয়ে রাখলাম না, ওঁর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার বরের তো চক্ষু চড়কগাছ। ওঁর দেহরক্ষীরা বলল, "কী চাই?" আমি সরাসরি ওঁর দিকে তাকিয়ে বললাম, "আপনার সাথে দু মিনিট কথা বলা যাবে, বুম্বা দা?" উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, "কী ব্যাপারে?"
-- আমি ছোট থেকে আপনার ভীষণ ফ্যান... প্লিজ়...।
আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই উনি বললেন, "বসুন, এই সোফায়।" দুরুদুরু বুকে ওঁর মুখোমুখি বসলাম। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, "বলুন।" আমি ঢোঁক গিলে বললাম, "অনেক ছোট থেকে আপনার ভক্ত আমি। আপনার 'বিয়ের ফুল' দেখে তো এক সময় আপনাকেই বিয়ে করব ঠিক করেছিলাম। 'অটোগ্ৰাফ', 'জ্যেষ্ঠপুত্র', 'দৃষ্টিকোণ', 'মনের মানুষ', 'বাইশে শ্রাবণ', 'অপরাজিতা তুমি', 'জাতিস্মর', 'শঙ্খচিল', 'প্রাক্তন' আপনার কেরিয়ারের সেরা ছবি বলে আমার মনে হয়।" একটু লাজুক হেসে বললেন, "থ্যাঙ্ক ইউ।"
-- আপনার এত ফ্যান ফলোয়ার্স, সকলকে সামাল দেন কীভাবে?
-- আমার ফ্যানেরা সকলে আমাকে ভালোবাসে। তাদের সামাল দিতে হয় না, শুধু ভালোবাসা দিতে হয়।
-- তবে আপনি 'সাথি' সিনেমাটা না করে খুব ভুল করেছেন।
-- আমার মনে হয় না, আমি ভুল করেছি। আমি করিনি বলেই বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসে নতুন নায়কের আগমন ঘটেছে। 'সাথি' বাংলা চলচ্চিত্রের একটা টার্নিং পয়েন্ট। বহু বছর বাংলা সিনেমা প্রসেনজিৎ-নির্ভর হয়েছিল, 'সাথি'- র পর প্রযোজকরা নতুন নায়কদের নিয়ে কাজ করার সাহস পেয়েছে, পাবলিকও সাদরে তাদের গ্ৰহণ করেছে। নতুনদের কাজ পাওয়া খুবই দরকার।
-- বাংলা ইন্ডাস্ট্রির জন্য আপনি এত ভাবেন, এত অবদান আপনার, সত্যি এমনটা আর কোনো নায়কের ক্ষেত্রে দেখিনি!
-- এই ইন্ডাস্ট্রি আমার মা, আমার মায়ের মতোই এঁকে আমি শ্রদ্ধা করি। তাই, নিঃস্বার্থভাবে এই ইন্ডাস্ট্রির মানুষগুলোর কথা ভাবি।
-- গ্ৰামে গঞ্জে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে যখন অন্ধ ভক্তদের 'পোসেনজিৎ' ডাক শোনেন বা 'মা, আমি চুরি করিনি' ডায়লগ বলার অনুরোধ আসে, তখন কেমন লাগে?
-- ওঁদের সরলতা, আতিথেয়তা দেখে মুগ্ধ হই। তাই, বারবার ওঁদের টানে ছুটে যাই।
ওঁর সাথে কথা বলতে বলতে বেশ সড়গড় হয়ে গেছিলাম। তাই, সাহস করে বলেই ফেললাম, "সব দিক দিয়ে আপনি একজন সেরা মানুষ কিন্তু পার্সোনাল লাইফে আপনার এতগুলো সম্বন্ধ, এতগুলো বিয়ে অনেক সময়ই আপনার ভক্তদের মন ভেঙে দেয়।" কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হেসে বললেন, "আসলে নায়ক হলেও আল্টিমেটলি আমি তো মানুষ। আর ভালোবাসা পাওয়ার ক্ষেত্রে সব মানুষের কপাল তো আর সমান হয় না। সারাদিন কাজে মগ্ন থাকলেও দিনের শেষে একটা সত্যিকারের মনের মানুষের, কাঁধে মাথা রাখার মতো মানুষের খুব প্রয়োজন হয়। আর সেই মানুষটা যদি ঠিকমতো না পাওয়া যায়, তবে শুধু শুধু সেই সম্পর্কটাকে বয়ে বেড়ানোর কোনো মানে হয় না, ওর বোঝা অনেক। মিথ্যে সম্পর্কের ভার বেঁচে থাকতেও মানুষকে মেরে ফেলে। তাই, সঠিক সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া না পর্যন্ত অনুসন্ধান তো চালিয়েই যেতে হয়।" ওঁর কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম আমি। কী নিদারুণ বাস্তবসম্পন্ন কথা বললেন উনি! আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি নিজেই আমার বরের দিকে দেখিয়ে বললেন, "উনি আপনার হাজ়ব্যান্ড তো?" আমি মাথা নেড়ে 'হ্যাঁ' বললাম।
-- উনি যদি আপনার মনের মানুষ হন, তবে রোজ আপনি নতুন নতুনভাবে আপনার বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পাবেন কিন্তু উনি যদি মনের মানুষ না হন, তবে রোজ বেঁচে থেকেও মরে যাবেন আর অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে করতে সম্পর্কের লাশ বয়ে বেড়াবেন।
ওঁর কথাটা বুকের মধ্যে গিয়ে যেন আঘাত করল। মনের কোণে প্রথম প্রেম পার্থর স্মৃতি ফুটে উঠল। বাবা-মায়ের চাপে সম্পর্কটা একদিন ভেঙে গেছিল।
-- আচ্ছা, অনেক কথা হলো। এবার আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আমি আসি? ভালো থাকবেন।
অন্যমনস্ক থাকার দরুন চমকে উঠলাম। হাসিমুখে ওঁর অটোগ্ৰাফ নিয়ে ওঁকে বিদায় জানালাম কিন্তু এখন মনের মধ্যে একটা নতুন প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল, সত্যিই কি আমরা সবসময় আমাদের মনের মানুষ পাই নাকি সারা জীবন অ্যাডজাস্টমেন্টই করে সম্পর্কের লাশ টেনে বেড়াই...?