চোর
চোর
সোহিনী সকলের দিকে একবার ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে মাথা নীচু করে নিজের হাতটা অভিরূপের দিকে এগিয়ে দিল। অভিরূপ অবাক হয়ে দেখল, সোহিনীর হাতের মুঠোতে একটা ছোট নেলপালিশের শিশি। অভিরূপ বুঝতে পারল, আবার সেই একই ঘটনা ঘটেছে। সোহিনী অভিরূপকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মুখ লুকিয়ে বলল, আমি এটা এখানে আবার রাখতে এসেছিলাম, বিশ্বাস করো। ভর সন্ধ্যাবেলা শপিং-মলের গাদা গাদা লোকের সামনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল অভিরূপ। সোহিনীর হাত থেকে নেলপালিশটা নিয়ে সেটা আবার দোকানের ট্রে- তে রেখে দিয়ে অভিরূপ বলল, স্যরি, এক্সট্রিমলি স্যরি। দোকানদার চোখ কটমট করে তাকিয়ে বলল, চুরি করে স্যরি??!! অভিরূপ তাকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে বলল, না, না, আপনি ভুল ভাবছেন, ঐ শিশিটা পড়ে গেছিল, উনি সেটা ঠিক জায়গায় রাখতে......। ওকে কথা শেষ করতে না দিয়েই দোকানের ছোকরা ছেলেটা বলল, আমি স্পষ্ট দেখেছি, উনি নেলপালিশটা ওনার ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়েছিলেন, তারপর দোকানের মধ্যেই কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ঘোরার পরে আবার নেলপালিশটা ওখানে রেখে দিতে গেলেন, তখনই আমি ওনাকে হাতেনাতে ধরেছি। মনে হয়, এই কালারটা চুরি করতে ভালো লাগেনি, তাই, চেঞ্জ করতে যাচ্ছিলেন! সোহিনী কেঁদে ফেলে বলল, একটা সামান্য নেলপালিশ আমি কেন চুরি করতে যাব, বলুন তো?! আপনারা আমার নামে মিথ্যে দোষারোপ করছেন। দোকানদার উত্তেজিত হয়ে বললেন, যান, যান, আপনাকে যে পুলিশে ধরিয়ে দিইনি, এটাই আপনার ভাগ্য। দেখে তো ভালো ঘরের বৌ বলেই মনে হচ্ছে। তাহলে এসব করেন কেন? অভিরূপ কথা না বাড়িয়ে সোহিনীকে নিয়ে শপিং-মল থেকে বেরিয়ে এলো। প্রত্যেকটা মানুষের জিজ্ঞাসু, তাচ্ছিল্যভরা দৃষ্টি যেন ওকে গিলে খাচ্ছিল।
গাড়িতে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সোহিনী ঘুমিয়ে পড়েছে। গাড়ি চালাতে চালাতে অভিরূপের তিন বছর আগে ঘটা ঘটনার সূত্রপাত মনে পড়তে লাগল। সদ্য বিয়ের পর মাসতুতো বোনের বিয়েতে গেছিল ওরা। ঘর ভর্তি লোকজন, খুব আনন্দ করেছিল ওরা সব ভাই-বোন মিলে। বিয়ের পর দিন সকালে হঠাৎ বোনের হাতঘড়িটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সকলেই হতভম্ব, সারা বাড়ি তন্নতন্ন করেও কোথাও পাওয়া গেল না। বিয়েবাড়িতে এত দামি দামি উপহার চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, সেগুলো চুরি না হয়ে একটা সামান্য ঘড়ি চুরি হলো?! সবাই যখন এই ঘটনার কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না, তখন মামাতুতো বোন অঞ্জলি বলল, এইমাত্র সোহিনী বৌদিকে দেখলাম, ড্রেসিং-টেবিলের ওপর তোর ঘড়িটা রেখে দিচ্ছে। অঞ্জলির কথায় সকলেই বেশ অবাক হয়ে গেল। সোহিনী?! কিন্তু কেন?! অঞ্জলি মুখ বেঁকিয়ে বলল, অভি দা, বৌদিকে বোঝা। চুরি করে এখন ধরা পড়ার ভয়ে আবার যেই রেখে দিতে গেছে, ওমনি আমার চোখে পড়েছে। সকলের কথা শুনে লজ্জিত মুখে সেদিন ওরা ফিরে এসেছিল।
এরপর যত দিন যেতে লাগল, সোহিনীর এই প্রবলেমটা বাড়তে লাগল। প্রয়োজন ছাড়াও হঠাৎ করে সামান্য জিনিস চুরি করে আবার কিছুক্ষণ পর সেগুলো সঠিক জায়গায় রেখে দেওয়ার চেষ্টা করে। অভিরূপ তাকে অনেক বুঝিয়েছে, তাদের মানহানি, শাস্তি ইত্যাদির কথা বলে কিন্তু এই ঘটনা কমলো তো না- ই, উল্টে আরও বেড়ে গেল। সোহিনীকে বললে সে- ও কান্নাকাটি করে ক্ষমা চায়, পরক্ষণেই আবার সেই কাজ করে। বাধ্য হয়ে অভিরূপ একজন সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হয়।
.... ক্লেপটোম্যানিয়া..... সোহিনীকে পরীক্ষা করে ডাক্তারবাবু এই কথাই বললেন। দুরারোগ্য, বিরল এই রোগে না চাইলেও একধরণের মানসিক স্যাটিসফ্যাকশনের জন্য রোগী হয়তো খুব সামান্য কোনো জিনিস চুরি করে, সেগুলো সে হয়তো বিক্রিও করে না বা নিজে ব্যবহারও করে না, তবুও নিজেকে কাজটি করার জন্য কন্ট্রোল করতে পারে না। পরক্ষণেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে যখন তারা আত্মগ্লানিতে ভোগে, তখন তারা নিজেদের ভুল সংশোধনের জন্য জিনিসটি পূর্বাবস্থায় ফেরত রাখতে যায় আর যেহেতু এই ব্যাপারগুলি কোনোটিই তার পূর্বপরিকল্পিত নয় এবং প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন মস্তিষ্কের এক রাসায়নিক সেরাটোনিনের প্রভাবে সে এই ঘটনাগুলো ঘটিয়ে ফেলে, তাই, সহজে তারা ধরাও পড়ে যায়। সোহিনীর ডাকে অভিরূপের চিন্তার ঘোরটা কেটে যায়, তুমি কি আমাকে আজও ভুল বুঝলে? অভিরূপ হেসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, না, তুমি তো ইচ্ছে করে করোনি কিন্তু আর কোরো না। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে অভিরূপ ভাবল, ভালোবাসা ছাড়া যে আর এই বিরল রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। ভালো হয়ে ওঠো, সোহিনী......।