মিঠির একদিন
মিঠির একদিন


"মিঠি, মিঠি সোনা, উঠে পড়ো মা, সকাল হয়ে গেছে তো। স্কুল নেই বলে এতক্ষণ ঘুমোলে চলে, বলো? ওঠো সোনা মা, সাঁতারে যেতে হবে না? এইতো শুধু ছুটির ক'দিনই তো শুধু সকালে সাঁতারে যেতে পারবে।" মায়ের ডাকে মিঠি চোখটা আধখোলা করে ডাকলো, "মাম্মাম, আমার গাছটা কি বড় হয়েছে?"
মিঠি ওদের বাগানের এক কোণে একটা আমের আঁটি পুঁতেছে কয়েকদিন আগে। এই ক'দিন আগে মিঠিদের ক্লাস টুয়ের বিজ্ঞান ক্লাসের মিস মিতালী বলেছেন, "সবাই নিজের নিজের বাড়িতে বাগানে নয়তো টবে একটা গাছের চারা তৈরী করবে। প্রথমে মাটিতে একটা আমের আঁটি পুঁতে দেবে, তারপর রোজ তাতে একটু একটু করে জল দেবে। আর এটাও দেখবে যেখানে তুমি আমের আঁটিটা পুঁতেছো সেখানটা যেন ভালো করে রোদ পড়ে। এই আমের আঁটিটা হোলো বীজ আর তার থেকেই বেরোয় নতুন চারাগাছ। বীজ থেকে চারাগাছ বেরোনোকে বলে অঙ্কুরোদগম। আর এই অঙ্কুরোদগমের জন্য খুব দরকারি হোলো মাটি, জল, বাতাস এবং সূর্যের আলো।"
মিসের সব কথা একদম ঠিক ঠিক ভাবে মেনেই মিঠি ওদের বাগানে আমের আঁটিটা পুঁতেছে চারাগাছ বেরোবে বলে। এটাই এবারে ওদের গরমের ছুটির প্রোজেক্ট। অঙ্কুরোদগমের পুরো বিবরণ লিখতে হবে প্রোজেক্ট স্ক্র্যাপ বুকে .... একদম বীজ পোঁতা থেকে চারাগাছ বেরোনো পর্যন্ত, সঙ্গে ছবিও আঁকতে হবে সবকটা পর্যায়ের। তারপর আবার পারলে অঙ্কুরোদগম থেকে চারাগাছ হয়ে ওঠা পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ের ছবি তুলে প্রিন্ট করে আটকাতে হবে স্ক্র্যাপ বুকের পাতায়।
মিঠি বিছানায় বসেই মা'কে ডেকে বললো, "মাম্মাম, মিস্ বলেছে যে চাইলে আমি আমার চারাগাছটার ছবিও তুলতে পারি। মাম্মাম, আমি চারাগাছটার একটা ছবি তুলবো।" "দাঁড়াও, আগে চারাগাছটা পুরোপুরি বেরোক," মিঠির মায়ের উত্তর।
মিঠি এবার তাড়াতাড়ি উঠে দাঁত মেজে, চোখ মুখ ধুয়ে একেবারে তৈরী সাঁতারে যাবার জন্য। মিঠি সকালে দাদুভাইয়ের সাথেই যায় সাঁতারে। মিঠি সাঁতার ক্লাবের বন্ধুদের আর ট্রেনার কাকুদের সাথে সাঁতার কাটার আগে এক্সারসাইজ করতে করতে দেখতে পায় দাদুভাই আরও অনেকজন দাদুর সাথে সুইমিং পুল ঘিরে বাঁধানো রাস্তায় হাঁটছে। জলে নামার আগে মিঠি ভাবলো, "নাহ্, কাল থেকে আর দেরী করে ওঠা যাবে না। তাহলে সাঁতার ক্লাসে আসার আগেই একবার দেখে আসতে পারবো চারাগাছটা। কতটা বড় হোলো? আর গাছে জলও দিয়ে আসতে পারবো।"
সাঁতার শেষে বাড়ী ফেরার সময় দাদুভাই আবার অনেকগুলো গাছপাকা আম, কালোজাম, লিচু, তালশাঁস আর ঠাম্মির জন্য গরম জিলিপি কিনলো। মিঠি দাদুভাইকে তাড়া দিচ্ছে, "দাদুভাই, তাড়াতাড়ি চলো, বেশী রোদ উঠে গেলে গাছে জল দেওয়া যায় না বলেছো যে, তবে? আমার গাছে জল দিতে হবে না?" দাদুভাই মুচকি হেসে বললো, "মিঠি দিদিভাই, তুমি তো আজ দেরী করে ঘুম থেকে উঠেছো। তুমি ওঠার আগেই আমি তোমার গাছে জল দিয়ে দিয়েছি। সাঁতার কেটে ফিরতে ফিরতেই তো রোদ উঠে যায়, তাই না?"
দাদুভাইয়ের কথা শুনে মিঠি খুব নিশ্চিন্ত হোলো। যাক বাবা, ওর গাছের কোনো ক্ষতি হবে না। মিঠি রিনরিনে গলায় বললো, "আচ্ছা দাদুভাই, আমার ঐ চারাগাছটা একদিন অনেক বড় হবে? গাছে অনেক আম হবে?" দাদুভাই বললো, "নিশ্চয়ই, তুমি যদি গাছটার নিয়মিত যত্ন করো, দেখবে গাছটা একদিন অনেক বড় হবে। ঠিক আমাদের বাগানের অন্য গাছগুলোর মতোই।" একটু থেমে দাদুভাই আরো বললো, "আর তোমার গাছও একদিন সবার অনেক উপকার করবে। যেমন সব গাছেরা করে।" বড় বড় চোখ মেলে অবাক হয়ে মিঠি জানতে চায়, "গাছেরা কি কি উপকার করে দাদুভাই? ফলের গাছই তো একমাত্র শুধু ফল দেয়!"
গল্পে গল্পে মিঠিরা বাড়ী পৌঁছে গেছে। দাদুভাই বললো, "ঠিক আছে, আজ দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর তোমাকে আমি গাছেদের উপকারের গল্প বলবো। তুমি এখন জলখাবার খেয়ে নাও। তারপর একদম লক্ষ্মীসোনা মেয়ে হয়ে পড়াশোনা সব সেরে নাও, মায়ের কাছে বসে।"
দুপুরে খাওয়ার পরে দাদুভাই ইজিচেয়ারে বসে একটু খবরের কাগজ পড়ে। আর মিঠি ছুটির কাজের একপাতা হাতের লেখা চট করে সেরে নিয়েই দাদুভাইয়ের ঘরে চলে এলো। তারপর মিঠি ঠাম্মি আর দাদুভাইয়ের মাঝখানে শুয়ে শুয়ে শুনতে লাগলো দাদুভাইয়ের কাছে গাছেদের গল্প।
"গাছেরা না থাকলে পৃথিবীতে কেউ বেঁচে থাকতে পারবে না। গাছই তো প্রাণীদের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন দেয়। অনেক রকমের খাবার দেয়। ওষুধ দেয়, এমনকি লেখাপড়া করার বইখাতার কাগজ পর্যন্ত গাছ থেকেই তৈরী হয়। পেন্সিল, রাবার, কাপড় জামা তৈরীর সূতো, জানালা দরজা খাট টেবিল চেয়ার সব.... সবকিছু গাছ থেকে পাওয়া কাঠ দিয়ে তৈরী হয়। এছাড়া চাল-ডাল, নানা রকম ফল, শাক-সব্জি খাবার জন্য এসবই তো আমরা গাছের কাছ থেকেই পাই। তারপর কত রকমের পাখী, বাঁদর, হনুমান, কাঠবেড়ালি এসব প্রাণীরাও তো গাছেই থাকে। গাছেরা হোলো প্রকৃতি মায়ের উপহার। এজন্যই তো কক্ষণো গাছের ক্ষতি করতে নেই, গাছ কাটতে নেই।"
মিঠি মুগ্ধ হয়ে দাদুভাইয়ের কাছে গাছেদের উপকারের গল্প শুনছিলো। শুনতে শুনতে কখন যেন মিঠির দু'চোখের পাতা বুজে এসেছে।
ও বাবা, মিঠির ছোট্ট আমগাছের চারাটা বিরাট বড় একটা ঝাঁকড়া আমগাছ হয়ে গেছে তো! আমগাছের ঘন সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে রোদ লুকোচুরি খেলছে। ডালে অনেক পাখী কিচিরমিচির করছে। কতগুলো পাখীর বাসা, মোটা মোটা ডালগুলোর খাঁজে খাঁজে। কতগুলো বাঁদর, কাঠবেড়ালি, হনুমান সব হুটোপুটি ছুটোছুটি করছে। পাতাভরা ডালপালা গুলো বাতাসে দোল খাচ্ছে। আর কী সুন্দর ঠান্ডা মিষ্টি সে বাতাস.... অক্সিজেনে ভর্তি তো। মিঠি অবাক হয়ে দেখছে মিঠির গাছে কত আম হয়েছে, আমের ভারে যেন গাছের ডালগুলো ঝুলে মাটির কাছাকাছি নেমে আসছে।
মিঠির খুব ভালো লাগছে, খুব আনন্দ হচ্ছে। সত্যিই এই গাছটাকে বীজ থেকে চারা গাছ, তারপর এতো বড় একটা গাছ তৈরী করে সব্বাইয়ের কত উপকার করেছে মিঠি। আর প্রকৃতি মা'কেও মিঠি এই সুন্দর গাছটা উপহার দিয়েছে।
ঠাম্মি মাথায় হাত বুলিয়ে মিঠিকে জাগিয়ে দিয়েছে। চোখ মেলেই এদিক ওদিক তাকিয়ে আমগাছটা খুঁজে নিলো মিঠি। কিন্তু নাহ্, কোত্থাও তো কোনো গাছের কোনো লেশমাত্র নেই। ওতো এখনো ঠাম্মি আর দাদুভাইয়ের খাটেই শুয়ে আছে। তার মানে মিঠি বুঝলো যে, ও স্বপ্ন দেখছিলো এতোক্ষণ।
মিঠি উঠেই বাগানে ছুটলো ওর আমগাছের চারাটা দেখতে। দাদুভাই আর মা তখন বাগানে গাছে জল দিচ্ছিলো, মিঠি এসে যোগ দিলো গাছে জল দিতে। আর আড়চোখে দেখে নিলো, সত্যিই মিঠির পোঁতা চারাগাছটা আস্তে আস্তে বেশ বড়ো হয়ে উঠছে। বিরাট হবে একদিন, যেমনটি দাদুভাই বলেছে।
ভাগ্যিস স্কুলে মিস্ বলেছিলো এই আমের আঁটি পুঁতে চারাগাছ তৈরী করার প্রজেক্ট করতে, তাইই তো এত্তো কিছু জানতে পারলো মিঠি!
-----------------------------------------