Sanghamitra Roychowdhury

Inspirational

3.3  

Sanghamitra Roychowdhury

Inspirational

মেনোপজ্

মেনোপজ্

9 mins
1.1K


মেনোপজ্

সংঘমিত্রা রায়চৌধুরী

------------------------------


টিঙ্কু বসে আছে গায়নোকোলজিস্টের চেম্বারে একলা চুপচাপ। টিঙ্কুকে ডাক্তারের এই চেম্বারে পৌঁছে দিয়ে তনুময় অফিসে চলে গেছে। অফিসে তার জরুরি মিটিং আছে। মেয়েও ইউনিভার্সিটিতে চলে গেছে, পিএইচডির বড্ডো চাপ ওর এখন। টিঙ্কুর সাথে এতোক্ষণ সময় এখানে ডাক্তারের চেম্বারে বসে থাকতে পারবে যে কেউ, তেমন সময় কারুর হাতে নেই। বড্ডো ব্যস্ততায় সবাই। কেবলমাত্র একা টিঙ্কুই আজকাল খানিকটা অকেজো, শরীরে এবং মনে। বড়ো মানসিক ও শারীরিক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে টিঙ্কুর বর্তমান সময়টা পার হচ্ছে। বড়ো বেশী ইমোশনাল হয়ে পড়েছে টিঙ্কু, কিন্তু এই কথাটাই ও কাউকেই বোঝাতেও পারে না।



এই নিয়ে টিঙ্কু দ্বিতীয়বার এলো বেলভিউ ক্লিনিকে, এই গায়নোকোলজিস্টের চেম্বারে। মেয়ে এই ডাক্তারের সঙ্গে প্রথমবারে যোগাযোগ করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিয়েছিলো। সেবার তনুময় ছিলো সঙ্গে, যদিও খুব বিরক্তি নিয়েই, তবুও ছিলো। কিন্তু এবারে তনুময় অ্যাপয়েন্টমেন্টটা করে দিয়েছে তবু আগেরদিনে, এই না কত! যেসময়টাতে টিঙ্কুকে দেখার কথা ডাক্তারের, সেসময়টাতে তনুময় ওকে পৌঁছতে আসতে পারবে না, ওর জরুরি মিটিং। তাই সময়ের অনেকক্ষণ আগেই তনুময় টিঙ্কুকে নামিয়ে দিয়ে গেছে ক্লিনিকের বাইরের গেটে। ট্রিটমেন্ট সবে শুরু হয়েছে। সেদিন ডাক্তারের কাছে রিপোর্ট দেখিয়ে, কথা বলে, চেক-আপ হয়ে গেলে টিঙ্কু একলাই ট্যাক্সি ধরে বাড়ী চলে যাবে। তনুময় তেমনই নির্দেশ দিয়েছে। তার বাইরে চলার ক্ষমতা টিঙ্কুর নেই। আসলে কোনদিনই ছিলো না।



এই যেমন মেনোপজ্, আসলে তো শারীরবৃত্তীয় নিয়মে মেনোপজ্ একটা খুব সাধারণ অথচ অবশ্যম্ভাবী ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নারী জীবনে! অথচ অনেক মিথস্ অর্থাৎ ভুল ধারণা আছে এই নিয়ে পরিবারে, সমাজে। জানতে হবে ফ্যাক্টস্ অর্থাৎ আসল তথ্য ও ঘটনা। একটা বয়সের পর নারীদের মেনোপজ্ নির্ধারিত। নারীদেহে অনুপস্থিত হবে মাসিক ঋতুচক্র। অর্থাৎ মান্থলি পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যাওয়াই হোলো মেনোপজ্। তবে এই মেনোপজ্ সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণার কারণে অনেক মহিলাই বেশ কিছু সমস্যার শিকার হতে পারেন। মেনোপজ্ সম্পর্কে এই ভ্রান্ত ধারণার ব্যাপারে সচেতন থাকলে জীবন অনেকটাই মসৃণ হতে পারে। এই কথাগুলো খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেছিলো ডাক্তার মেয়েটি আগের দিনই, যখন প্রথমবার দেখাতে এসেছিলো। হ্যাঁ, মেয়েটিই বটে, অনেক ছোট হবে বয়সে টিঙ্কুর থেকে। খুব মিশুকে আর হাসিখুশি ডাক্তার মেয়েটি। ডাক্তার মেয়েটির সাথে কথা বললে, খুব একটা কেমন যেন ভরসা জন্মায়।




সারাদিন একা একা বাড়ীতে থেকে থেকে আজকাল হাঁপিয়ে ওঠে টিঙ্কু। শরীরটা ক্লান্তিতে ভেঙেচুরে আসে। সর্বক্ষণ কেমন যেন বিরক্তি আসে, রাগ হয়, মন খারাপ লাগে, কান্না পায়, মনে হয় দূরে চলে যায় কোথাও নিরুদ্দেশী ঠিকানায়। অসহায় লাগে খুব! টিঙ্কুর মনে হয় ওর জীবনটা ফুরিয়ে যাচ্ছে। ওর আর কোনো দাম নেই, এই সংসারে, তনুময়ের জীবনে, মেয়ের ভবিষ্যতে। টিঙ্কু আজকাল নিজেকে খরচের খাতায় ভাবতে শুরু করেছে। ওর যেন আর করার মতো কাজ নেই কিছু, খরচের খাতায় চলে গেছে মনে করে নিজেকে, আর খুব কষ্ট পায়। গলার কাছটায় সর্বক্ষণ দলা পাকিয়ে থাকা কষ্টটা যখন তখন চোখে শ্রাবণের অঝোর ধারার মতোই নেমে আসে। আর টিঙ্কুর এই অসহায় ইমোশনাল জার্ণিতে আছে তনুময়ের কটাক্ষ, আছে নিজের মেয়ের উদাসীনতা। টিঙ্কু বসে বসে ভাবছে এসবই।


*******


নিজের বাবা মাকে ছেড়ে, জন্ম থেকে চেনাশোনা নিজের শহর ছেড়ে, বিবাহসূত্রে অনেকদূরের অন্য এক শহরে টিঙ্কু এসেছিলো সংসার করতে। বন্ধু বান্ধব ভাইবোনদের সাথে হৈহৈ করে দিন কেটে যেতো তার অবাধ স্বাধীনতায়। বিয়ের পরে নতুন বাড়ী, নতুন ঘর, নিজের বর আর নতুন পরিবেশে নিজেকে ফিট করাতে করাতেই ভুলেছিলো অতীত, আর চেনাজানা পুরনো সব। শুধু যখন ঠাণ্ডা লেগে সর্দিকাশিতে কষ্ট আর জ্বর হয়, তখন খুব মাকে মনে পড়ে টিঙ্কুর। "টিঙ্কু বৃষ্টিতে ভিজিস না..... টিঙ্কু এতো আইসক্রিম খাস না..... টিঙ্কু একটু তেল মেখে স্নান কর..... টিঙ্কু একঢোঁক মধু-তুলসী পাতার রস খা, ভালো লাগবে, গলায় আরাম হবে......" ওহ্, একসময় অসহ্য লাগতো মায়ের এই খেয়াল রাখা, অতিরিক্ত মনে হোতো আদর-যত্ন। আর এখন? জ্বর হলে একলা ঘরে প্যারাসিটামল খেয়ে চুপ করে চোখ বুজে শুয়ে থাকে টিঙ্কু। আর মায়ের সেই অতি বাড়াবাড়ি রকমের যত্নটাকেই বড্ডো মিস্ করে।




উত্তরবঙ্গের মালদা জেলাশহরে একেবারে গায়ে গায়ে লাগানো পাশাপাশি বাড়ির পড়শী দু'টি মেয়ে ওরা, টিঙ্কু আর ইতু। একই সাথে বেড়ে ওঠা ওদের, পাশাপাশি গলাগলি করে। স্কুল, গানের স্কুল, নাচের স্কুল, আঁকার স্কুল, যোগব্যায়ামের ক্লাস সবই এক সাথে, গায়ে গা পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে। স্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে একই কলেজ, তারপর ইউনিভার্সিটি, উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়িতে, মাটিগাড়া ক্যাম্পাসে, এমনকি একই হস্টেলে থাকা। ওখানেই কি একটা অতি তুচ্ছ সামান্য কারণে ওদের আশৈশব বন্ধুত্বে ভাঁটা পড়লো, ফুটলো একটা ছোট্ট অদৃশ্য কাঁটা। দু'জনেরই অনমনীয় জেদের কাছে হার মানলো অতদিনের গভীর বন্ধুত্ব।



ইতু আর টিঙ্কু, ঘোরসংসারী তারা দু'জনেই এখন, বিবাহসূত্রে দেশের দুই প্রান্তে বাস করে। ওদের বাবা মায়েরাও গত হয়েছেন। ভায়েদের কল্যাণে এখন আর ওদের সেই পুরোনো শ্যাওলা ধরা মস্ত উঠোনওয়ালা বাড়ির অস্তিত্বই নেই। সেখানে এখন মাথা তুলেছে উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ি। সেখানে তাদের নামেও রাখা আছে দু'টি থ্রিবিএইচকে ফ্ল্যাট, আপাতত ভাড়ায় দেওয়া। তাদের সেই শান্ত নিরিবিলি জন্মস্থানের শহরে যাবার সময় কোথায়? দেশের দুই প্রান্তে থেকে দু'জনেই শুধু একলা ঘরে অলস দুপুরে মনে মনে ঘুরে আসে নিজেদের মেয়েবেলার বাড়ি থেকে। খুব মিস্ করে যে দু'জন দু'জনকেই তার প্রমাণ পাওয়া গেলো অচিরেই। ইতু ফেসবুক থেকে খুঁজে নিয়েছে টিঙ্কুকে, তারপর ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। আর টিঙ্কুও সাথে সাথেই অ্যাকসেপ্ট করেছে। দু'জনের মন থেকেই ধুয়ে গেছে বরফজমাট জেদী অভিমান, ভেসে গেছে তারা তাদের দু'জনের মেয়েবেলার অনেক গোপনকথার সাক্ষী আরেক পড়শী বন্ধু মহানন্দার অথৈ জলে। এই বেশ হয়েছে, দূরত্বটা যেন কখনো ছিলোই না মনে হয়।




এই দোলাচলের সময়টায় টিঙ্কুর সত্যিই খুব দরকার ছিলো ইতুকে। কত কথা হয় দু'জনে। ভিডিও কলিঙে, হোয়াটসঅ্যাপে। হাসি কান্না সুখ দুঃখ ভালো মন্দ.... জীবনের, সংসারের, সম্পর্কের.... সব অকপটে ভাগ করে নেয় দু'জনেই। কিন্তু এই সব কিছুতেই বড্ডো বাদ সাধছে আজকাল টিঙ্কুর শরীরটা। সেইজন্যই ইতুর পরামর্শেই তো টিঙ্কুর এই ডাক্তারের কাছে আসা। এতোদিন তনুময় হেসেই উড়িয়ে দিয়ে বলেছে, "কই, আমি তো কিছুই খারাপ দেখছি না। সারাদিন খাওয়া, ঘুম, সিরিয়াল, ফেসবুক.... সব নিয়েই তো দেখি দিব্যি আছো, সুখী গৃহবধূ।" তনুময়ের গলার শ্লেষ, বলার তাচ্ছিল্যের ব্যাঙ্গ..... বড্ডো বিঁধেছিলো টিঙ্কুকে। তবে ইতু খুব সাহস জুগিয়েছে, বলেছে, "যা খুশি বলুক, পাত্তা দিস না। তোর শরীর, তুই ডাক্তারকে দেখাতে যাবি, ব্যাস্। আমি তোর মেয়েকে বলে দেবো।"



ইউনিভার্সিটির গণ্ডী পেরোতে না পেরোতেই বিয়ে হয়েছিলো টিঙ্কুর। প্রথম সম্বন্ধেই পছন্দ করেছিলো তাকে পাত্রপক্ষ। মায়ের চোখের তারা টিঙ্কু বিয়ে হয়ে স্বামীর ঘর করতে এলো, একান্নবর্তী পরিবারে। প্রথম প্রথম টিঙ্কু যৌথ পরিবারে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলো। তারপর অবশ্য পৈতৃক বাড়ির বিরাট একান্নবর্তী পরিবার ছেড়ে নিউ আলিপুরে নিজের ফ্ল্যাটে চলে এলো তনুময়। খুব সমালোচনার মুখে পড়েছিলো টিঙ্কু, তনুময় মেয়ের স্কুলের দোহাই দিয়েছিলো। তবে টিঙ্কু বুঝেছিলো, যে ঐ হৈচৈ হট্টগোলের বাড়িতে আর তনুময়ের ভালো লাগছে না। বন্ধু বান্ধব কলিগদের নিরুপদ্রব নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি খুব টেনেছিলো তনুময়কে। কিন্তু টিঙ্কু? টিঙ্কু তো এই ফ্ল্যাটের চার দেওয়ালের মধ্যে একেবারে একলা হয়ে গেলো। কথা বলার পর্যন্ত কেউ নেই।



মেয়ের পড়াশোনা আর সংসারের কাজের মধ্যে ডুবিয়ে ফেলেছিলো টিঙ্কু নিজেকে। তাও কিছুতেই যেন যথাযথ মেলবন্ধন হোতো না অবসরের আর উদ্বৃত্ত সময়টুকু কাটানোর পন্থায়। শ্বশুরবাড়ীতে টিঙ্কু তবু উদয়াস্ত সযত্নে তার অপটু হাতের রান্নায়, সেলাইয়ে, ঘর গোছানোয়, খুঁজে খুঁজে বের করা কাজে, মিষ্টি ব্যবহারে সংসারের সবাইকে খুশি রাখতে চাইতো। কিসে যে সবাই খুশি হবে ভেবেই পেতো না। তবুও চেষ্টা করতো সবার মন জুগিয়ে চলার। প্রতি মুহূর্তে তার এই চেষ্টা ধাক্কা খেতো, বাড়ির বা পাড়ার বৌমাদের সুখ্যাতি শুনে শুনে শ্রান্ত ক্লান্ত টিঙ্কু গভীর রাতে বিছানায় যেতো, কিন্তু মনে কোনো অভিযোগ জমা হতে দেয় নি। নতুন সকালে, নতুন দিনে টিঙ্কু আবার নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে শুরু করতো নতুন উদ্যমে।




আজকাল টিঙ্কুর কাজে খুঁত ধরার কেউ নেই, নেই কেউ তুলনা করার লোক। সেখানটা ফাঁকাই থেকে গেছে, নাকি সেখানটাকে ভরাট করেছে নিশ্ছিদ্র একাকীত্ব, এটা টিঙ্কু ঠিক বোঝে না। শুধু খুব মিস্ করে ঐ ঠেলাঠেলির গাদাগাদির এজমালি বাড়িটার এক চিলতে তার আস্তানাখানাকে। ওঘরের সাবেকি আসবাবপত্রগুলোর সাথে ওখানেই পড়ে রয়েছে টিঙ্কুর আবেগগুলোও। প্রথম পুরুষ স্পর্শ, স্বামী সোহাগ, প্রথম মা হওয়া, প্রথম স্বপ্নের জাল বুনে আগামীর অপেক্ষাও.... ওই একফালি ঘরখানাতেই রয়ে গেছে। আনতে পারে নি তনুময় তাদের তুলে, এই ঝাঁ চকচকে চার কামরার ছড়ানো ফ্ল্যাটে। কিন্তু কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে টিঙ্কুকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলেছে জগদ্দল পাথরের মতো এই বিশ্রী একাকীত্ব। এই সময়ে ইতুকে ফিরে পাওয়াটা যেন টিঙ্কুর শুকনো মন বাগানে একপশলা তরতাজা করা বৃষ্টি।



টিঙ্কুর এই অসুস্থতার সময়ে.... বিশেষতঃ এই দুর্বিষহ মানসিক টানাপোড়েনের সময়ে, ইতু বিরাট ভরসা জুগিয়েছে। বুঝিয়েছে টিঙ্কুর মেয়েকে, যে মা ভালো থাকলে খুশী থাকলে, পরিবারও ভালো থাকবে খুশীতে থাকবে। তাই টিঙ্কুর মেয়েই উদ্যোগ নিয়েছে।আগে যে ডাক্তারের কাছে ট্রিটমেন্ট চলছিলো তার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে এই লেডী ডাক্তারের কাছে এনেছে। তনুময়কে মেয়েই বুঝিয়েছে ডাক্তার চেঞ্জ করার কথা। ইতুর পরামর্শে টিঙ্কুর মেয়েই ইন্টারনেট থেকে এই লেডী ডাক্তারের খোঁজ পেয়েছে। আসলে চিকিৎসা তো শরীরের নয়, চিকিৎসা তো মনেরও। হারানো আত্মবিশ্বাস আর মনের জোর ফিরে পাওয়ারও।



টিঙ্কুর সব রিপোর্ট বলছে, টিঙ্কুর ইমিডিয়েটলি মেজর একটি অপারেশন দরকার। খুব দ্রুত মাল্টিপল ফাইব্রয়েডস্ ছড়িয়ে পড়ছে ইউটেরাসে, ওভারিতে, এমনকি সারভিক্সেও। তাদের ক্যারেক্টারও সুবিধার নয়, বিপদজনক। সুতরাং রিমুভ করতে হবে সব রিপ্রোডাক্টিভ অরগ্যানস্, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। টিঙ্কুর কিন্তু কোনো টেনশন নেই, ডাক্তার ওকে তৈরী করেছে মানসিক ভাবে। বায়ো সায়েন্সের স্টুডেন্ট যে টিঙ্কু আর ইতু ভুলেই গিয়েছিলো নিজেরা, ওরা আসলে হারিয়ে গিয়েছিলো গৃহবধূর তকমায়। কিন্তু টিঙ্কুর অসুস্থতায় দুই বন্ধু ভিডিও কলিঙে বসে সব খুঁটিনাটি বিষয়ে আলোচনা করেছে। মনে মনে আরো শক্ত হয়েছে টিঙ্কু, ইতুর ভরসার ম্যাজিকে।



সব থেকে বেশী ধাক্কা খেয়েছে তনুময়। টিঙ্কুর এই অপারেশনের সিদ্ধান্তের পরেও ঠিক মানিয়ে নিতে পারছে না। তনুময় মনে মনে কী ভাবছে, তা আর ভাবতে চায় না টিঙ্কু। টিঙ্কুকে বাঁচতে হলে এই বিরাট অপারেশন করিয়েই বাঁচতে হবে। ভয় আর পাবে না টিঙ্কু, তনুময়ের অমত মেজর অপারেশনে, তাও টিঙ্কু মানতে পারবে না। ছাব্বিশ বছর সংসার করার পর, নিজের শত শতাংশ সংসারকে দেবার পর টিঙ্কু বুঝেছে, সংসার শুধু তার প্রাপ্যটুকুই বোঝে, কিন্তু যার হাতে এই প্রাপ্য মেটানোর দায় তার শারীরিক ও মানসিক সুস্থতাটাও যে খুব জরুরি, সেটা বোঝে না এক বিন্দুও। তবু ভালো ইতুর কাছে সব শুনে টিঙ্কুর মেয়ে বুঝেছে কথাটা।



টিঙ্কু বেলভিউ ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছে, খুব হাসিখুশি, ইতুর সাথে হোয়াটসঅ্যাপে চ্যাট করেছে, তারপর ভিডিও কলিং। টিঙ্কুর খুব খুশি খুশি ভাব, বললো মেয়েকে, "এবার আমি সুস্থ হয়ে যাবো। কী আর করা যাবে? মেনোপজ্ আনা হবে, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বাদ দিয়ে। তা দিক বাদ, আমি সুস্থ হয়ে নতুন মানুষ হয়ে বাড়ি ফিরতে চাই।"

পরদিন ট্রলিতে শুয়ে ওটির দিকে যাবার সময় তনুময়ের ভ্যাবাচ্যাকা মুখ দেখে ফিক করে হেসে ফেললো টিঙ্কু। কী নির্মল সে হাসি!

নানা কাজে ব্যস্ত তনুময়ের মাঝেমাঝে বড় বিরক্ত লাগতো, দিনের মধ্যে কতোবার যে টিঙ্কু ফোন করে করে জিজ্ঞাসা করতো... "টিফিন করেছো? জুস খেয়েছো? বিশ্রাম নেবে না? কখন ফিরবে? দেরী কোরো না, একা একা ভাল্লাগছে না গো....." রোজই কী বিরক্তটাই না হোতো তনুময়, উন্নতির শিখরে ওঠা তনুময়ের মনে হোতো, "সারাদিন কাজকম্ম, চিন্তা ভাবনা কিছু নেই, সারাদিন খালি একা একা ভাল্লাগছে না, ছেলেমানুষির একটা লিমিট থাকে!"




তনুময়ের সামান্যতম অসুস্থতায় উদ্বিগ্ন টিঙ্কু মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কান্না শুরু করে দিতো, আর টিঙ্কুর এই ইমোশন দেখে রাগারাগি চেঁচামেচি কম করে নি তনুময় ! তাও দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে টিঙ্কু বারংবার জানতে চাইতো, তনুময় ঠিক আছে তো? ঠিক সময়ে ওষুধ খেয়েছে তো? ওষুধে একটু আরাম হয়েছে কি?... এমন সব অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন। তনুময় রাগে, বিরক্তিতে ফেটে পড়তো। তবুও সেসব উপেক্ষা করেও টিঙ্কুর নিঃস্বার্থ সযত্ন জানতে চাওয়া বারবার, "তুমি ভালো আছো তো?"..... যেন সমস্ত বিশ্বসংসারে এর থেকে বড় আনন্দ-সংবাদ সে মুহূর্তে আর কিছুই নেই টিঙ্কুর কাছে।



আজ টিঙ্কুকে ওটিতে ঢোকানোর পর ওটির দরজা বন্ধ হয়ে যাবার পরে, দরজার মাথায় জ্বলা আলোটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এই প্রথমবারের জন্য তনুময়ের মনে হোলো, "কীইবা ক্ষতি হোতো হাসিমুখে শান্তগলায় টিঙ্কুর নির্দোষ কথাগুলোর ঠিক ঠিক জবাব দিলে? মেনোপজের আগে এরকম নানান সমস্যা দেখাই দেয়, বলে ঐ ডাক্তারের আণ্ডারে রেখে মাসের পর মাস হরমোন ট্রিটমেন্ট করানোর কী দরকার ছিলো? আমার উদাসীনতার মূল্য বড্ডো বেশীই দিচ্ছে টিঙ্কু!" এখন শুধু অপেক্ষা, টিঙ্কুর সুস্থ হয়ে ওঠার। তনুময় দাঁড়িয়ে আছে মেয়ের হাত শক্ত মুঠিতে ধরে। ইতু বারবার ফোন করছে সেই সুদূর ব্যাঙ্গালোর থেকে।



টিঙ্কুর অপারেশন হয়েছে, আইসিইউতে আছে এখন। আর তনুময় এখন মিস্ করছে টিঙ্কুর সেই মায়া জড়ানো সযত্ন কথাগুলো! হাসপাতালের যান্ত্রিক পরিবেশে দাঁড়িয়ে এখন তনুময় বুঝতে পারছে টিঙ্কুর কথাগুলো বিরক্তিকর বা একঘেয়ে ছিলো না, ছিলো একান্ত আপনজনের সযত্ন মায়ায় মোড়া অনুভবী খেয়াল রাখা! তনুময় পারে নি স্বামী হিসেবে সেই সচেতনতা দেখাতে। দেখাতে পারলে হয়তো তখনই মেনোপজের আগের সমস্যা শুরু হতেই টিঙ্কুর কষ্টের কথায় সাড়া দিতো সমব্যথী হয়ে, বিরক্ত হোতো না। আইসিইউ-এর কাঁচের দরজার এপার থেকে তনুময় মনে মনে বললো, "তাড়াতাড়ি ফিরে চলো টিঙ্কু বাড়িতে, আর তোমার অবহেলা হবে না।"



*****



টিঙ্কু বাড়িতে ফিরেছে দু'দিন আগে। তনুময় পাশে বসে বসে টিঙ্কুকে অরেঞ্জজুস খাওয়াচ্ছে। মেয়ে পায়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কোনোরকমে কঁকিয়ে কঁকিয়ে উঠে বসলো টিঙ্কু, তারপর বললো, "এই তোমাদের কাজকর্ম নেই? আমার পাশে বসে আছো কেন এরকম? আরে বাবা, মেনোপজের জ্বালাতন তো শেষ, এখন আমার সমস্যা নেই আর, যাও তো এখান থেকে।"

ইতু ভিডিও কলিং করছে, "এই দেখ টিঙ্কু তোর জন্য একটা কবিতা পাঠালাম..... রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর লেখা.... দেখ কী দারুণ!" টিকটিক আওয়াজে ঢুকলো কবিতাটা। ঝুঁকে পড়েছে ফোনের স্ক্রিনে দেখতে তনুময় আর ওদের মেয়েও। বেশ জোরে জোরেই আবৃত্তি করে উঠলো টিঙ্কু, মুখে ওর হাজার ওয়াটের উজ্জ্বলতা....

"বিস্মৃতির বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে রয়েছি একা,

কেউ আসছে না।

না স্বপ্ন, না ঘুম, কেউ নয়।

আঁধারপুরের বাস, কতোদূর থেকে তুমি আসো?"


                              

টিঙ্কুর মেয়ে আর স্বামী তনুময় হাততালি দিয়ে উঠলো। ভাগ্যিস দেরীতে হলেও শেষমেষ বুঝেছে ওরা, "মায়ের খুশীতেই পরিবারের খুশী"। একটি শব্দ মেনোপজ্, টিঙ্কুর কিছু নিয়ে গেছে, আবার ফিরিয়েও দিয়ে গেছে কিছু।


--------------------------------------

© সংঘমিত্রা রায়চৌধুরী



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational