মাতৃত্ব
মাতৃত্ব
নার্সিং হোমের কেবিনে চিন্তিত মুখে বসে আছে দেবারতি। সামনের চেয়ারে বসে থাকা মাঝ বয়সী স্ত্রী বিশেষজ্ঞ ডা. নীলিমা বসু ওর দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছেন। নিরবতা ভাঙলো ডক্টরের কথায় আর সঙ্গে সঙ্গেই দেবারতির পুরো জীবনটা নিকষ কালো অন্ধকারে ঢেকে গেল।
-"অ্যাম সরি টু সে বাট মিসেস ব্যানার্জী আপনি কোনোদিনও মা হতে পারবেন না।" ডক্টরের এই একটা কথাই মুহুর্তে দেবারতির সমস্তকিছু উল্টে পাল্টে রেখে দিল।
-"দেখুন আপনার কথা অনুযায়ী আপনি কিছু বছর আগে সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছিলেন হ্যাঁ সেই সময় হয়তো আপনি বুঝতে পারেননি বাট আপনার ইন্টারনাল ইনজুরি হয়েছিল আর সেটার কারণেই আপনি নিজের মা হওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছেন।" (ডক্টর নীলিমা)
-"এসব আপনি কি বলছেন?" বিস্ময়ে হতভাগ হয়ে তাকিয়ে বলে দেবারতি।
-"আমি জানি আপনার পক্ষে হয়তো সত্যিটা মেনে নেওয়া অনেকটা কঠিন বাট সত্যকে তো স্বীকার করতেই হবে আর আপনার রিপোর্ট সেটাই বলছে মিসেস ব্যানার্জী যে আপনি কোনোদিনও মা হতে পারবেন না।" ডক্টরের কথায় সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙে পরে দেবারতি। কোনো কথা আর বাড়ায় না নিশ্চুপ হয়ে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে বেরিয়ে আসে নার্সিং হোম থেকে বাইরে দাঁড়ানো গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ি চলতে শুরু করে নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। ভেতরে দম বন্ধ হয়ে আসে দেবারতির তাই ড্রাইভারকে বলে এসি অফ করে গাড়ির কাঁচ নামিয়ে দেয় বাইরের হাওয়া ঝাপটা মারে দেবারতির মুখে এতক্ষণের চেপে রাখা কান্নাটা এবার বুক চিরে বেরিয়ে আসে তবে কোনো শব্দ ছাড়াই। দেবারতির চোখের সামনে ভেসে ওঠে ওর আর ওর স্বামী অর্থাৎ সৌমের অতীতের কিছু অধ্যায়।
ওর সৌম্যের বিয়েটা হয়েছিল পরিবারের অমতে সেই কলেজ লাইফ থেকে সৌম্য আর ওর প্রেমের সম্পর্ক তারপরে সেই সম্পর্ক বিয়ে অবধি নিয়ে যেতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি ওদেরকে। দেবারতিদের অবস্থা খুব খারাপ না হলেও সৌম্যদের কাছে ওদের পারিবারিক অবস্থা কিছুই নয়। অন্যদিকে সৌম্যরা অভিজাত ধনী পরিবারের তাই সৌম্যের বাড়ির লোক কোনো কালেই মন থেকে ওকে বাড়ির বউ হিসাবে মেনে নেয়নি। আজ এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে যেখানে ওদের বিয়ের তিনটে বছর পূর্ণ হয়েছে এখনও দেবারতি জানে ওর এই অক্ষমতার কথা জানতে পারলে সৌম্যের বাড়ির লোক আবার ওকে অপমান করতে ছাড়বে না হয়তো বাড়ি থেকেও বের করে দেবে আর দেবারতি খুব ভালো করেই জানে সৌম্য এই সময়ও ওর পাশেই থাকবে ছেলেটা যে ওকে ভীষণ ভালোবাসে কিন্তু নিজের স্বার্থে দেবারতি কি করে একজন মায়ের থেকে সন্তানকে আলাদা করবে। ওর অপমান সহ্য না করতে পেরে হয়তো সৌম্য ওকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবে তাতে তো নিজের পরিবার থেকে দূরে সরে যাবে সৌম্য সেটা দেবারতি কি করে হতে দেবে।
-"আমি কিছুতেই তোমায় তোমার পরিবার থেকে আলাদা হতে দেবো না সৌম্য প্রয়োজনে এই দেবারতি নিজে হারিয়ে যাবে তোমার জীবন থেকে হয়তো তুমি কষ্ট পাবে কিন্তু পরবর্তীতে ঠিক মানিয়ে নিতে পারবে। আমার অক্ষমতা যে তোমাকে বাবা ডাক থেকে বঞ্চিত করলো সৌম্য!! পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও।" নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে কাঁদে দেবারতি।
বাড়িতে ফিরে কারোর সাথেই কথা বলেনা দেবারতি। রাতে সৌম্য ফিরলেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়না যেহেতু ও টেস্টগুলো সৌম্যকে না জানিয়ে করিয়েছিল তাই সৌম্যও জানতে পারে না দেবারতির এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ।
-"কি হয়েছে দেবা তুমি কেন আমার সাথে ভালো করে কথা বলছো না বারবার আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছ!! কি হয়েছে কি সমস্যা একটু বলো.. মা..মা আবার কিছু বলেছে তোমায় তাইনা?" কিছুদিনের দেবারতির ব্যাবহারে অতিষ্ট হয়ে শেষ পর্যন্ত ওকে জিজ্ঞেস করে সৌম্য কিন্তু দেবারতি কিছুই উত্তর দিতে পারেনা সৌম্য নানা কথা বলে ওকে কারণ জিজ্ঞেস করে আর সহ্য করতে পারে না দেবারতি চেঁচিয়ে ওঠে হটাৎ
-"কেউ কিছু বলেনি আমায় শুনেছ? আমি ইচ্ছা করে করছি কারণ আমি তোমার সাথে আর থাকতে চাই না বুঝতে পেরেছো তুমি!! থাকতে চাই না আমি তোমার সাথে ডিভোর্স চাই আমি।" দেবারতির কথায় সৌম্য অবাকের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
-"এই...মজা করছো তুমি আমার সাথে তাইনা!! এসব কথা কেন দেবা? আচ্ছা কেউ কিছু নিশ্চই বলেছে তোমায় তাইনা!!" সৌম্য অধৈর্য্য হয়ে বলে ওঠে।
-"আমি কোনো মজা করছি না আর না কেউ আমায় কিছু বলেছে।" (দেবারতি)
-"তাহলে কিসের জন্য তুমি এসব কথা বলছো বিয়ের তিন বছর পরে?" সৌম্য রাগে চিৎকার করে উঠলো। ওর চিৎকার শুনে নিচে থেকে সৌম্যের মা কাঁকন দেবী উপরে ছুটে এলেন।
-"কারণ আমি কোনোদিনও মা হতে পারবো না শুনেছ!! আমি অক্ষম তোমাকে বাবা হওয়ার সুখ দিতে পারবো না তুমি আমায় মুক্তি দাও এই সম্পর্ক থেকে।" কান্নার মাঝে চিৎকার করে বলে দেবারতি। ওর স্বীকারত্যি শুনে সৌম্য স্তব্ধ হয়ে যায়।
-"কি!! তুমি এসব কি বলছো?" অবাক হয়ে যায় সৌম্য।
-"হ্যাঁ আমি ঠিক বলেছি আমি টেস্ট করিয়েছিলাম এতদিন পরেও আমাদের মধ্যে কোনো সন্তানসুখ আসেনি তাই তাতেই প্রমাণ হয়েছে আমি কোনোদিনও মা হতে পারবো না!! তুমি শুনতে পেয়েছ আমি কোনোদিনও মা হতে পারবো না সৌম্য!!" দেবারতির গলা বুজে আসে কান্নায়। সৌম্যর খুব খারাপ লাগে দেবারতির এই অবস্থায় ঠিক তখনই দরজার বাইরে থেকে কানে আসে কাঁকন দেবীর কটুক্তি।
-"মাগো মা!! এই মেয়ে আর কি কি সত্যি নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে গো!! আমি আগেই বলেছিলাম এই মেয়ে অলক্ষ্মী । একটা বাঁজা মেয়েকে শেষ পর্যন্ত তুই বাড়ির বউ করে আনলি সমু!!" কাঁকন দেবীর কথায় দেবারতি কষ্টে অপমানে জর্জরিত হয়।
-"ব্যাস মা অনেক কিছু বলে ফেলেছ থামো তুমি। আর দেবা তোমাকে বলছি তুমি এই সামান্য কারণটার জন্য আমায় ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবছো আমার ভালোবাসাটা একবারও তোমার চোখে পড়লো না।" দেবারতির কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো সৌম্য।
-"তোর কি মাথাটা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে সমু এতো বড় একটা কারণকে সামান্য বলছিস তুই? এই মেয়ে তো কলঙ্ক বাঁজা মেয়ে কোথাকার। তুই ওকে বিদায় কর তাড়াতাড়ি আমি তোকে আবার ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে দেবো। এই অলক্ষ্মী মেয়েকে তাড়া বাড়ি থেকে।" কাঁকন দেবীর কথায় সৌম্য প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়।
-"আমি তোমাকে অনেক আগে চুপ করতে বলেছিলাম মা। তুমি আমার একটা কথাও শুনছো না কেন আমাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করছো? নিজের ছেলের সুখ কি তোমার সহ্য হয়না? আর কি তখন থেকে ওকে বাঁজা আর কলঙ্ক বলে যাচ্ছ? কে বলেছে জন্ম না দিলে মা হওয়া যায় না? আর জন্ম দিলেই সে মা হয়ে যায়? তুমি নিজের উদাহরণ দেখো না এই যে তুমি...তুমি আদৌ একজন ভালো মা হতে পেরেছো? নিজের ছেলে কিসে ভালো থাকবে সেই চিন্তাই নেই তোমার!! আরে দেবা ও তোমাকে মা বলে ডাকে কখনো তুমি ওর ওই ডাকটার সম্মান রাখতে পেরেছো? নাহ্...পারোনি!! আরে যদি জন্ম দিলেই মা হওয়া যেত না তাহলে চারিদিকে এতো ভ্রূণ হত্যার খবর পাওয়া যেত না। একটু খোঁজ নিয়ে দেখ দুদিন ছাড়া খবরের পাতায় বেরোচ্ছে সদ্যোজাত শিশু পাওয়া গেছে ডাস্টবিনে অথবা ভাগাড়ে। যদি জন্ম দিলেই মা হওয়া যেত তাহলে এইসব খবর হেডলাইন হতো না। মা হওয়ার জন্য এটা কখনোই জরুরী নয় তাকে জন্ম দিতেই হবে। মা হওয়ার জন্য মন থেকে মাতৃত্ব অর্জন করতে হয় , সন্তানকে নিজের সবটা দিয়ে আগলে রাখার মনোভাব , তাকে নিজের ভালোবাসার সমস্ত টুকু ভান্ডার নিঃশেষ করে ভালো রাখার প্রতিজ্ঞা এই সমস্ত কিছু মিলিয়েই পূর্ণ হয় মাতৃত্ব। তাই কখনোই তুমি এটা বলতে পারো না যে ও জন্ম দেয়নি বলে কখনো মা হতে পারবে না।" সৌম্যর এই কথাগুলো মন্ত্র মুগ্ধের মত শুনছিল দেবারতি। কাঁকন দেবীর বলার মত কিছুই বাকি রাখেনি সৌম্য তাই উনি কোনো শব্দ না বলেই ওখান থেকে প্রস্থান করলেন। দেবারতি কিছু বলতে গেলে ওকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সৌম্য চলে গেল ঘর থেকে। বাকি দিনগুলো দেবারতি সৌম্যের কাছ থেকে শুধু উপেক্ষা পেয়েছে আর খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে আগের দিনগুলোতে ওর উপেক্ষায় সৌম্য ঠিক কতটা কষ্ট পেয়েছিল। কাঁকন দেবী সেদিনের পর থেকে আর কিছুই বলেনি দেবারতিকে।
আজকে দেবারতির জন্মদিন অন্য বছর গুলোতে সৌম্য ওকে নিয়ে সারাদিন মেতে থাকতো কিন্তু সেই মানুষটা আজ প্রায় দুসপ্তাহ ওর সাথে ঠিক করে কথা পর্যন্ত বলছে না কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে বারবার ওর ভেতরটা বারবার কষ্টে রক্তাক্ত হচ্ছে।
-"রেডি হও আমরা বেরোব।" সৌম্য হটাৎ এসে বলে।
-"কোথায় যাবো আমরা?" (দেবারতি)
-"প্রশ্ন করতে বলিনি। রেডি হও বেরোব আমরা।" সৌম্য গম্ভীর মুখে বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আবার হতাশ হয় দেবারতি মানুষটা ওকে জন্মদিনের একটা শুভেচ্ছা জানানো পর্যন্ত না। রেডি হয়ে নিচে নামতে দেখলো সৌম্য ওর জন্য গাড়িতে অপেক্ষা করছে। গাড়িতে উঠে বসতে গাড়ি চালানো শুরু করলো সৌম্য। রাস্তায় একবারও সৌম্য ফিরে তাকালো না দেবারতির দিকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো দেবারতির ভেতর থেকে।
গাড়িটা বেশ খানিকক্ষণ পরে এসে থামলো একটা জায়গায়। দেবারতি অবাক হয়ে গেল জায়গাটার নাম দেখে। ওদের গাড়িটা এসে থেমেছে চাইল্ড কেয়ার হোমে। দেবারতি কিছুটা উপলব্ধি করে বড়বড় চোখে তাকালো সৌম্যের দিকে সৌম্য ওর দিকে তাকিয়ে অর্থপূর্ণ হাসলো। ব্যাস আর সময় নেয়নি দেবারতি মুহূর্তের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে সৌম্যের বুকে। দেবারতি বুঝতে পারে সেদিনের সৌম্যের কথার অন্তর্নিহিত অর্থ। যে জন্ম দিলেই মা হওয়া যায়না মা হওয়ার জন্য আগে প্রয়োজন একটা কোমল মাতৃ হৃদয়ের যে নিজের সন্তানকে নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রাখবে ভালোবাসবে।
ভেতরে গিয়ে ওরা সমস্ত নিয়ম মেনে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে এলো একটা ছোট্ট মিষ্টি দুবছরের পুতুলকে।
-"আজ তোমার জন্য আমি মাতৃত্বের স্বাদ পেলাম সৌম্য। তুমি হয়তো আমার আগের জন্মের কোনো পুণ্যের ফল। আর এই যে মিষ্টি সোনা তুই তো এখন আমার সবকিছু রে....তোর জন্যই তো আজ আমার এই মাতৃত্বের সুখ তোকে পেয়েই তো আমার মাতৃত্ব স্বার্থক হলো।" ছোট্ট সোনাটার কপালে মমতাময়ী মায়ের মত স্নেহের চুম্বন এঁকে দেয় দেবারতি।
-"ও শুধু তোমার সন্তান নয় ও তো আমারও সন্তান... ও আমাদের সন্তান...আমাদের দেবাংশী। সৌম্যর কথায় মৃদু হেসে ওর কাঁধে মাথা রাখে দেবারতি আর সৌম্য ওকে নিজের দুহাতে আগলে নেয় আর কোলে থাকা ছোট্ট পুচকিটা ডাগর চোখে তখন নিজের বাবা মাকে দেখতে ব্যাস্ত হয়ে যায়।
