STORYMIRROR

Shyamasree (শ্যামশ্রী)

Inspirational

4  

Shyamasree (শ্যামশ্রী)

Inspirational

মানুষ ও পরিযায়ী

মানুষ ও পরিযায়ী

5 mins
562

মহাশ্বেতা সকালে উঠে পুবের জানালাটা খুলতেই দেখলো এক ঝাঁক পাখি উড়ে চলে গেল কোন সুদূরে, মহাশ্বেতা সেই দিকে তাকিয়ে থেকে বলল " মা ওই বুঝি শেষ পাখিগুলোও চলে গেল? কোথায় গেল গো?"


শ্বেতাদের বাড়ি রায়গঞ্জ কুলিক পক্ষী নিবাস সংলগ্ন পাড়াটিতে। এটি বিখ্যাত পরিয়ায়ী পাখিদের জন্য।

উমা দেবী মেয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন "কোথায় আর নিজের বাড়ি, শীতের সময় আসে সেই সুদূর সাইবেরিয়া থেকে। গরম এসে গেলে ফিরে যায় নিজের বাড়িতে।"

শ্বেতা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো "মা সবাই বাড়ি ফেরে, আমার দাদা ফিরবে কবে?"

উমাদেবী স্বামীর সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে চুপ করে গেলেন, শম্ভু বাবু মেয়ের কথায় খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে স্ত্রীর দিকে অব্যক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।

আজ বছর ৬ হলো তাদের একমাত্র ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ব্যাঙ্গালোরে চাকুরীরত। বাবা সাধারণ পোস্ট মাষ্টার ছিলেন, খুব কষ্ট করেই ছেলেকে পড়িয়েছেন, প্রথম প্রথম ছেলে ফোন করলেও, বিগত ৪ বছর থেকে কোনো যোগাযোগ রাখেনি। প্রথম প্রথম উমাদেবী নিজেই ফোন করতেন, কিন্তু মহেন্দ্র ব্যস্ততার অজুহাত দিয়ে ফোন কেটে দিতো। তারপর এমন দাঁড়ালো ফোন করলেও ফোন ধরতোনা, উমাদেবী বুকে পাথর চেপে ছেলেকে ফোন করাই ছেড়ে দিলেন। আর শম্ভুবাবু তার সাথে ছেলে কেবলমাত্র অর্থের প্রয়োজনে ফোন করত, সেই প্রয়োজন গিয়েছে, ফোন করা, খোঁজ নেওয়া সেদিন থেকেই ঘুচেছে। তিনি খবরের কাগজে মুখ গুঁজে ছিলেন বটে কিন্তু চিন্তা পৌঁছে গিয়েছিল অতীতে। শ্বেতা আর মহিন বেশ ছোট বড়, দ্রব্যমূল্যের বাজারে একটা সন্তানকে মানুষ করবে বলেই ঠিক করছিলো তারা। তাছাড়া ছেলে সবাই চায়, বংশধর, সেটা পেয়ে গিয়েছিল, আর কি চাই? কিন্তু শ্বেতা হঠাৎ করে চলে আসে ওদের জীবনে। তখন মহিন বেশ বড়, সে বড় মনোঃখুন্ন হয়েছিল। শম্ভুবাবুও খুশি হননি সেসময়, একটা অতিরিক্ত খরচা মনে হয়েছিল। তবে বর্তমান প্রজন্মের মতো নির্ম্মম হতে পারেনি দেখে শ্বেতা এই ধরার মুখ দেখেছিল। আগে যাই মনে হোক, এখন আশীর্বাদ মনে হয় শ্বেতাকে। ওর মুখের দিকে তাকিয়েই ওদের স্বামী-স্ত্রীর বেঁচে থাকা। মেয়েটা কত ছোট থেকে টিউশন পড়িয়ে নিজের লেখাপড়া চালাচ্ছে। লেখাপড়ায় বেশ ভালো, কিন্তু শম্ভুবাবু মেয়ের জন্য কিছুই করতে পারেনি কোনো দিনও। কিন্তু মেয়েই যেন তার মা হয়ে উঠেছে, ওরজন্যই চাকরি শেষে ঘরে ফিরতে ইচ্ছে হতো, এখন ওরজন্যই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচে থাকার রসদ পাচ্ছে তারা।


______


"হ্যালো কে?" ফোনটা ধরে বললো শ্বেতা।

" বোন আমি দাদা বলছি।" শ্বেতা স্তব্ধ হয়ে যায়, প্রায় ৪ বছর পরে দাদার গলা শুনে ওর কি প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত বুঝতে পারলো না, কারণ দাদা থাকতেও প্রতিটি ভাইফোঁটা একাই কেটেছে ওর।নিজের কথা বাদ দিলেও বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে বুক ফেঁটে যায় ওর, মুখে কিছু বলেনা তারা। কিন্তু ছেলের জন্য যে কষ্ট পায় তা সে বোঝে।

" কি রে শ্বেতা শুনতে পারছিস?"

" হ্যাঁ.. হ্যাঁ বলো দাদা"

" বলছি যে কেমন আছিস? "

শ্বেতার মনে হলো কড়া কিছু বলে দেয়, কিন্তু পারলো না, কারণ শিক্ষা বাঁধ সাধলো।

" হ্যাঁ আছি, তা তুমি আছো কেমন? "

" আছি, বলছি বাবা আছে?"

শ্বেতা অবাক হলো হঠাৎ দাদা বাবার খোঁজ করছে দেখে।

সে অবাক হলেও ফোন দিলো মাকে, কারণ বাবা ছিলেন না বাড়িতে।


-------


আরে এদিকটা দেখ, না না ওই দিকের ফুলটা ঠিক করে লাগা। আজকে ওদের ছোট কোম্পানিটার গৃহপ্রবেশ। তাই সবাই ব্যস্ত।

মহেন্দ্র আজ মাস তিনেক হল বাড়ি ফিরেছে, হঠাৎ করে কম্পানী থেকে ছাটাই হতে হয় ওকে, প্রায় চারবছরের সম্পর্ক ভেঙ্গে যায় চাকরী চলে যাওয়ার পরে থেকে। কোম্পানির সাথে প্রায় বছর ছয়েকের সম্পর্ক আর রেশমীর সাথে বছর চারেকের সম্পর্ক এক ঝটকায় মিথ্যা হয়ে যায়। বাঁচার আশা ছেড়েই দিয়েছিলো সে। দুই দিন নেশা করে পড়েছিল। তারপর সপ্তাহ খানেক থেকে কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পরে বুঝতে পারলো এই মহামারীতে নতুন চাকরি পাওয়ার আশা নেই, আর ব্যঙ্গালোরের মতো জায়গার খরচ চালানোর ক্ষমতা তার আর নেই । লিভ ইন এ থাকার জন্য এতো বড় ফ্ল্যাটটা নিয়েছিল, রেশমী চলে গেল সব সম্পর্ক চুকিয়ে। এখন এটাকে পোষা হাতি পোষা মনে হচ্ছিলো, তাছাড়া থাকতে পারছিলো ঘরটাতে রেশমীর সাথে কাটানো স্মৃতি ফিরে ফিরে আসছিল। শেষে সব দিক ভেবে নিজের শেষ ঠিকানা বাড়িতে ফোন করে সব সংকোচকে দূরে রেখে। ভেবেছিলো কি এমন হবে? মুখ ফিরিয়ে নেবে তো, মুখ ফিরিয়ে নিলে নেবে ফিরিয়ে, সেও তো বাইরে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে আপনজনেদের ভুলেছিল।

কিন্তু না মুখ ফিরিয়ে নেয়নি, মা-বাবা, নিজের পরিবার বুঝি মুখ ফেরাতে জানেনা। তাই তাদের পাঠানো টাকায় সে ফিরতে পেরেছিলো। বাড়িতে এসে নিজেকে যেন চিনতে পেরেছে একটু একটু করে। কাটিয়ে আসা কয়েকটি বছরকে কৃত্রিম জীবন মনে হচ্ছিলো। মায়ের চুরির শব্দে ঘুম ভাঙ্গা, বাবাকে বাজারের থলি হাতে ফিরতে দেখে উঁকি মারা কি আনছে তা দেখতে, বোনের সাথে খুনসুটি। সব কিছুর মাঝে নিজেকে ফিরে পেতে শুরু করে মহেন্দ্র। মিস্টার মাহিন্দ্র থেকে আবার মা-বাবার মহিন হয়ে উঠার যে কি সুখ তা আজ সে বুঝতে পেরেছে। এখানে সবটা নিঃস্বার্থ, কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য কেউ ভালো ব্যবহার করে না, তাই বুঝি একজন মা নিজের শেষ সম্বল হাতের চুড়ি দুটো বিক্রি করে দিতে পারে সন্তানকে ফিরে আসার জন্য, যে সন্তান আজ পর্যন্ত কোনো কর্তব্যই করেনি।এই কয়েক মাসে যা অনুভব করেছে, তা তার সমগ্র জীবনে করেনি মহিন। তার জন্য লুকিয়ে আনা বোনের নিজের ভাগের একটা ছোট মিষ্টিতেও অনেকটা সুখ লুকিয়ে আছে,যা বড় বড় দোকানের মিষ্টি খেয়েও স্বাদ পায়নি মহিন। কারণ এতে রয়েছে নির্ভেজাল ভালোবাসা। তাই আবারও নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে করছে পরিবারের সবাইকে জড়িয়ে। তাই কোম্পানিতে আঁটকে থাকা টাকাগুলো পাওয়ার সাথে সাথেই এই ছোট কোম্পানিটা খুলে বসেছে এতোদিনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাবে সে। বুদ্ধিটা অবশ্য তার ছোট বোনটার, " দাদা এতোদিন অন্যের জন্য খাটলি, এখন না হয় নিজের জন্য খাট.." এই কথাটা মহিনকে নতুন পথ দেখিয়েছে।


---------


আজ ভাইফোঁটা, কাল থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছে শ্বেতা, কত বছর পরে দাদাকে ফোঁটা দেবে সে।স্নান সেরে শাড়ি পড়েছে সে, দাদার দেওয়া প্রথম পুজোর শাড়ি। দাদার নতুন ব্যবসা, খুব ভালো না হলেও চলছে। তবে শ্বেতা জানে দাদা পারবে। দাদা ওকে সব টিউশানি ছাড়িয়ে দিয়েছে, খালি দুইজনকে পড়ায় সামনে ওদের মাধ্যমিক তাই। আর বাড়ির পাশে তাই।শ্বেতা নিজের জন্য যে এতো খুশী তা নয়, ওর আনন্দের বিষয় মা-বাবা এই কয়েকমাস বেশ ভালো আছে।

আজ জানালা খুলতেই শুনতে পেলো পাখির কলকাকলি। শ্বেতা খুশী হয়ে বললো " মা দেখো পাখি আসতে শুরু করেছে। "

মেয়ের এই কথায় সামান্য হাসলেন উমা দেবী।

শ্বেতা মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বললো " মা পাখিরা কেবল গৃহে ফেরে না, মানুষও ফেরে..."


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational