কৃতিকার চোখে শরৎ
কৃতিকার চোখে শরৎ
ঘুম থেকে ওঠার পর কৃতিকা দরজা খুলে বারান্দায় দাঁড়ায়। চারিদিকের অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে সে মুগ্ধ হয়ে যায়। এক অপূর্ব রং রূপ এর খেলা চলছে প্রকৃতির মধ্যে। শহরে দেখেছে সে শরতের শোভা কিন্তু আজ এই গ্রামবাংলায় শরতের রং এর ভাণ্ডার যেন উপচে পড়েছে।
কৃতিকার একটু ভোরে ওঠার অভ্যাস।কৃতিকা ও শাওন দুজনেই কলেজে পড়ে। তারা শান্তি নিকেতনে ক দিনের জন্য ছুটি কাটাতে এসেছে। ছোটখাটো একটি ছিমছাম বাংলো, বাংলোটি অবশ্য কৃতিকার বন্ধু শাওনের। বন্ধু শাওনের জোরাজুরিতেই আসা। কৃতিকা ভাবল এসে সে ঠিকই করেছে। রবীন্দ্রনাথের এই শান্তিনিকেতনে তার আসার বহুদিনের ইচ্ছা ছিল, ওর মনে হলো কোন এক স্বর্গরাজ্যে এসে উপস্থিত হয়েছে। প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে তার হঠাৎ শাওন এর কথা মনে হলো-------
'উফ, মেয়েটা এখনো ঘুমাচ্ছে। এত সুন্দর সকালটা কিছুই উপভোগ করছে না। বাইরে বেড়াতে এসে কেউ এত ঘুমায়।' ভেতরে গিয়ে কৃতিকা ডাকতে লাগল,
' এই শাওন ওঠ না। দেখ কি সুন্দর শরতের সকাল।
অদ্ভুত থীর নীলিমা বিরাজ করছে আকাশ জুড়ে। দেখবি চল না।'
' কি দেখব? তুই দেখ না, আমাকে ঘুমাতে দে। এমনিতে পড়ার চাপে ঘুম হয় না।'
' কুম্ভকর্ণ একটা। তুই ঘুমা যত পারিস, আমি বেরোচ্ছি। এইভাবে তোর সাথে থাকলে আমি তো কিছুই উপভোগ করতে পারবোনা।'
রেডি হয়ে কৃতিকা বের হয়ে গেল। বেরোতেই কিছুটা দূরে যেতে একটা মোটামুটি চায়ের দোকান দেখতে পেল, সেখানে চা আর ডিম পাউরুটি অর্ডার দিয়ে চারিদিকে শোভা নিরীক্ষণ করতে লাগলো। মনে মনে বলতে লাগল কি অপূর্ব! যতদূর দেখা যায় ধান জমি, সেখানে শুভ্র কাশ ফুল মাথা দোলাচ্ছে,কি যে অসম্ভব সুন্দর, প্রকৃতি যেন ঢেলে সেজেছে। কৃতিকার মনে হল বর্ষার অত্যাচারের পর শরতের আকাশ নতুন রূপে সাজে তার প্রশান্ত মাধুর্য নিয়ে। বর্ষণ ধৌত মেঘমুক্ত আকাশের সুনীল রূপ, আলোছায়ার লুকোচুরি, শিউলি ফুলের মন উদাস করা সুগন্ধ, নদীর কূলে কাশ ফুলের সৌন্দর্য সব মিলিয়ে নিসর্গ শোভা প্রকৃতি যেন রং তুলি দিয়ে তার ছবি এঁকেছে। শরতের সাদা মেঘ নিয়ে আসে আনন্দের সম্ভার, কৃতিকার মন হঠাৎ করে কাব্যিক হয়ে যায়----- তার মনে পড়ে যায় বৈষ্ণব সাহিত্যের কথা, সেখানে শরতের মনমুগ্ধকর সৌন্দর্য, বিরহের রূপ মানুষের মনকে নাড়া দেয়। বৈষ্ণব পদাবলীর অন্যতম কবি বিদ্যাপতি যেভাবে বিরহিনী রাধার চিত্র অঙ্কন করেছেন তা অনবদ্য-----
কৃতিকা নিজেই বলতে থাকে,
' এ সখী হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।'
কৃতিকাও যেন বিরহিণী রাধার দুঃখে মুহ্যমান। যাইহোক সম্বিত ফিরে পেয়ে দাম মিটিয়ে, একরাশ ভালোলাগা বুকে নিয়ে কৃতিকা বাংলোতে ফিরল।
' থ্যাংক গড তুই উঠেছিস?'
'হে হে। এ তুই কোথায় চলে গিয়েছিলিস।'
' তা কি করব। কুম্ভকর্ণের সাথে থাকলে কি আর এই নিসর্গ শোভা দর্শন করতে পারতাম। শোন আমরা কি এখানে ঘুমাতে এসেছি, সারাদিন ঘুরব, ফিরবো, বেরোবো। চারিদিকে যে আগমনী সুর বাজছে, মনের ভেতরে শুনতে পাস না।'
' ঘুমাতে দিবিনা বলছিস(হেসে), কলকাতাতেও ঘুমাতে পারিনা, আর এখানেও------'
' ওই তুই এতো কুঁড়ে কেন?'
' ঠিক আছে মাই সুইট ফ্রেন্ড, ডোন্ট অ্যাংরি, চল খেয়ে নি কিছু। '
' আমিতো খেয়ে এলাম বাইরে থেকে'
' যা আমায় ছাড়া!'
' কি করবো খিদে পেয়ে গেছিল, ঠিক আছে চল তোর সাথে অল্প কিছু খেয়ে নেব।
দুজনে কিছু একটা খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়ল, শান্তিনিকেতনের নানান জায়গা দেখতে। তারা একটা গাড়ি বুক করে রেখেছিল, এখানে শাওনের অনেকবার আসা, তাই শাওনি কৃতিকার গাইড।
' চল তোকে আজকে কয়েকটা জায়গা ঘুরিয়ে আনবো।'
গাড়িতে যেতে যেতে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে পড়ে কৃতিকা। রায়পুরের লাল মাটির পথ দিয়ে যখন গাড়িটা যেতে থাকে এক অপূর্ব অনুভূতি হয় কৃতিকার। মনে হয় সমস্ত লাল রং দিয়ে এখানকার রাস্তাঘাট আবির খেলেছে।
' শাওন বলে এই জায়গাটা নাকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এত ভাল লেগে গিয়েছিল রায় জমিদারদের কাছ থেকে জমিতি কিনে নেন, তারপর একটি আশ্রম তৈরি করেন, বাড়িটির নাম দেন শান্তিনিকেতন।'
এরপর একে একে তারা ব্রহ্মবিদ্যালয় দেখতে যায়, যেটা পড়ে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় হয়। এরপর শান্তিনিকেতন ভবন, উপাসনা মন্দির, ছাতিমতলা দর্শন করে তারা আবার বাংলাতে ফিরে যায়। অনাবিল আনন্দ বুকে নিয়ে কৃতিকার মনটা উদাস হয়ে যায়। বাংলোটার সামনে এক মস্ত বড় শিউলি গাছ, কত ফুল চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, এক মুঠো ফুল হাতে নিয়ে তার আঘ্রানে বিভোর হয়ে যায়। নাচতে থাকে পাগলের মত----
' কিরে তোর হলো কি? পাগল হয়ে গেলি নাকি।'
' হ্যাঁ শাওন পাগল হয়ে গেছি---- এখানকার শরতের সৌন্দর্যে, এখানকার লাল মাটির গন্ধে আমি পাগল, হঠাৎ করে তার বৈরাগী মন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করে দিল-----
' আজি শরততপনে প্রভাতস্বপনে কি জানি পরান
কী যে চায়।
ওই শেফালির শাখে কি বলিয়া ডাকে বিহগ বিহগী
কী যে গায় গো।।
আজি মধুর বাতাসে হৃদয় উদাসে, রহেনা আবাসে
মন হায়
কোন কুসুমের আশে কোন ফুল বাসে
সুনীল আকাশে মন ধায় গো।'
' ওরে শাওন
আজকে আমার বাউল মন থাকছে না ওই রুদ্ধদ্বারে
মন ছুটেছে শুভ্র কাশে শিউলি ফুলের হাওয়ার মাঝে।
সুনীল আকাশের থীর নীলিমায়, রং ঢেলেছে শিল্পী শরৎ
আজকে আমি হব বিহগী, লাগাবো আমি নীলের কাজল।'
'ওরে বাবা দারুন কৃতিকা। তুই দেখছি এখানে এসে কবি হয়ে গেলি? আবৃত্তি তুই করতিস জানি, তার পাশাপাশি স্বরচিত কবিতা লিখে ফেললি। দারুন।
' নারে শাওন ওই আর কি। এখানে এসে এমনি এমনি হয়ে গেল।'
' আচ্ছা শোন কাল তোকে দারুন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি। সারপ্রাইজ'
' ওকে, আজকে চল গল্প করে খেয়েদেয়ে বাকি সময়টা কাটাই।'
' যথা আজ্ঞা। এইভাবে গল্প করতে করতে ওর বাকি দিনটা বেশ ভালোভাবে কেটে গেল।'
পরদিন সকালে শাওনি কৃতিকাকে ডাকল। উঠে পর বেরোবো।'
' আরিব্বাস কি ব্যাপার শাওন আজ তুই আগে উঠে পড়েছিস।'
' হ্যাঁ চল চল।'
দুজনের রেডি হয়ে জলখাবারের পর্ব সমাধা করে গাড়িতে উঠে বসলো। যেখানে গিয়ে নামল সেই জায়গাটা পরিদর্শন করে কৃতিকার আনন্দের শেষ নেই।
' আরে এত সোনাঝুরি। তাই না, কত দিনের ইচ্ছা এখানে আসব।'
' তাইতো তোকে নিয়ে এলাম। চল, এখন সাঁওতালি নৃত্য দেখবো।
কৃতিকা লক্ষ্য করলো কি সুন্দর একই তালে তারা একে অপরের কোমর জড়িয়ে ধরে নাচছে, দেখে তারও খুব নাচার ইচ্ছা হল।
' চল চল শাওন আমরাও তালে পা মেলাই।'
এক অনাবিল আনন্দে ভাসতে ভাসতে তারাও পা মেলাতে শুরু করল। নানা রকম ভাবে কখনো মাথায় ঘট বসিয়ে, কখনো ঢোল গলায় পড়ে তারা নাচতে লাগলো। এইভাবে কত সময় কেটে গেল তারা নিজেরাও জানেনা।
'কৃতিকা জানিস এখানে সুন্দর হস্তশিল্পের মেলা বসে। কত জিনিস পাওয়া যায়। দেখবি চল, শান্তিনিকেতনে গয়নাও খুব বিখ্যাত।'
ওরা দুজনে ওখান থেকে টুকিটাকি জিনিস কিনে, আরো কিছুক্ষন এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে গেল।
পরদিন সকালে কৃতিকার ঘুম ভাঙলো বাউল গানে, সঙ্গে সঙ্গে বারান্দায় বেরিয়ে এসে শুনতে লাগল। কিছু দূরে লাল মাটির পথ দিয়ে বাউল আপন মনে সুর বেঁধে গান গেয়ে চলেছে। এই স্নিগ্ধ সকালে বাউলের গান শুনে মনটা উদাস হয়ে গেল।
' কিরে কখন উঠলি?'
' এই কিছুক্ষণ আগে, বাউল গান শুনছিলাম। হ্যাঁরে আমরা এই চার দিনের জন্য কেন এলাম। কালই চলে যেতে হবে, পুজো তাতে খুব থাকতে ইচ্ছে করছে এখানে।'
' কি করব বল, অতদিনের জন্য কী আসা যায়। আচ্ছা মন খারাপ করিস না, আবার যখন আসব পুজোর সময় আসবো। যাকগে শোন কিছুদিন পরেই তো পুজো, তোকে চল দেখাই কোথায় পূজো হয়, কিরকম মূর্তি তৈরি হয়, অবশ্য এখন এত তাড়াতাড়ি মূর্তি তৈরি হয়নি। চল যাওয়া যাক দেখি কি হয়েছে।'
ওরা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বেরিয়ে গেল।
' কৃতিকা আজ আমরা আবার সোনাঝুরি যাব'
' আচ্ছা তাই নাকি আমিতো সোনাঝুরির প্রেমে পড়ে গেছি।'
এইভাবে তারা গল্প করতে করতে শরতকালের প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে তারা পৌঁছালো সোনাঝুরি তে।
' চল নামতে হবে এখানে। এখানেই হয় সোনাঝুরি গ্রামে হিরালিনী দুর্গোৎসব। জানিস তো বেশ কিছু বছর ধরে আদিবাসীরাই এই পুজো করে আসছে। দেখ প্যান্ডেল বাধা শুরু হয়ে গেছে। এখানকার মূর্তি একেক সময় একেক রকম হয়---- কখনো লোহার, আবার কখনো বেতের, কখনো কাঠের, এখানে সুন্দর মেলা বসে, বাউল গান হয়, সাঁওতালি নৃত্য হয়, এক অদ্ভুত সুন্দর লাগে এখান কার দূর্গা পুজা। শহরে আদব-কায়দা থেকে অনেক বেশি সহজ, সরল, গ্রাম্য। খুব ভালো লাগে রে।'
' ইস কেন যে পুজোর সময় এলাম না।'
' দেখ মন খারাপ করিস না। চল তো এদিক ওদিক ঘুরি একটু। আজ কিন্তু আমরা বাংলোতে লাঞ্চ করব না। চল তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব দারুন খাবার।'
তারা পৌঁছালো একটা সুন্দর পরিবেশে। পথের দুদিকে সারি সারি গাছ, সেখানেই হোটেলটি। নাম বনলক্ষী।
' কি সুন্দর জায়গাটা রে শাওন।'
তারপর তারা খাবার অর্ডার দিয়ে দিল। খাওয়া পর্ব সমাধা হলে শাওন বলল
' কেমন খেলি বল?'
' অসাধারণ'
' চল তাড়াতাড়ি উঠে পরি, কাল তো আবার ভোর ভোর রওনা দিতে হবে।'
যথারীতি পরদিন ভোর বেলা ওরা রেডী হয়ে, খাবার খেয়ে, নিচে নামলো। কৃতিকা দেখল শিউলি গাছের চারদিকে অসংখ্য ফুল ছড়িয়ে আছে। পরম আদরে এক মুঠো শিউলি ফুল তুলে কৃতিকা বলল------
' শুভ্র তুমি স্নিগ্ধ তুমি নামটি তোমার শিউলি,
কমলা রংয়ের বোঁটার ওপর মুচকি হাসো এমনি।
দেবীর তুমি প্রিয় ফুল ঠাঁই পেয়েছো চরণে,
তুলতুলে পাপড়িগুলি সদ্যোজাত শিশু।
কুড়িয়ে নেয় শিশুর দল শরতের এই শিউলিকে
যত্ন করে অর্ঘ্য দেয় দেবীর পাদপদ্মে।।