খুড়োর কল
খুড়োর কল
"নিখিলবঙ্গ নির্বাচনী বাতেলা শিক্ষণ কার্যালয় বা সংক্ষেপে নিনিবাশিকা।" ভজামামা বললো।
"নিনিবাশিকা! সে আবার কী? খায় না মাথায় দেয়?" আমাদের সমস্বর জিজ্ঞাসা।
"শোন তবে।" ভজমামা শুরু করলো।
যারা ভজামামার কথা জানেন, তারা এও জানেন যে আমাদের ঠেকটা হলো রেলপুকুরের মাঠে। তা গত দু'তিনমাস ধরেই সেখানে ভজামামা অ্যাবসেন্ট। যখনই দেখতে পাই, দেখি খুব ব্যস্তসমস্ত হয়ে কোথায় কোথায় যেন যাচ্ছে। চিরাচরিত পায়জামা আর ঢোলা পাঞ্জাবির বদলে শার্টপ্যান্ট পরছে। এর মধ্যেই লোকসভা ভোটের দামামা বেজে গেলো আমাদের নিস্তরঙ্গ মফস্বল শহরে। রাজনৈতিক নেতাদের চাপান উতোর আর তরজায় দুটো মাস ভালোই কাটলো। এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায় দ্যাখ। আর প্রতিশ্রুতির তো বন্যা বয়ে গেলো আমাদের শহরে। আগে তো দুটো দল প্রতিশ্রুতি দিতো, এবারে আবার চারটে দল। একা রামে রক্ষা নেই, বালী, সুগ্রীব, হনুমান সবাই এসে তান্ডব নৃত্য চালালো কিছুদিন আমাদের এখানে। কেউ এই শহরকে লন্ডন বানিয়ে দেয় তো, কেউ বানিয়ে দেয় প্যারিস। কেউ সব বেকারকে চাকরি দিয়ে দিচ্ছে তো কেউ বিনামূল্যে গাড়ি দেবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। মোদ্দা কথা, কেউ কম যায়না।
যাক, সকল রাতই একসময় ভোর হয়। সব ঝড় থেমেই রোদ ওঠে। সেইরকমই আমাদের এই ছোট্ট শহরেও একদিন ভোট হয়ে গেলো। ভোটের পর রেজাল্ট আসতে বেশ কিছুদিন বাকি। এই মাঝের দিনগুলোতে আমরা রেলপুকুরের মাঠে যথারীতি আড্ডা মারছি, হঠাৎই দেখি ভজামামা এসে হাজির আমাদের মাঝে, মুখে একগাল হাসি। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, "কি গো ভজামামা, এতদিন কোথায় ছিলে? একদম নো পাত্তা, নো কিচ্ছু?" তার উত্তরে ভজামামা শুধু বললো, "নিনিবাশিকা।"
"বুঝলি, এবারে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পরেই হঠাৎই আমার মাথায় একটা আইডিয়া খেলে গেলো। এই যে প্রতিটা ভোটেই প্রার্থীরা দরাজ হাতে একটার পর একটা প্রতিশ্রু
তি বিলিয়ে যায়, সেগুলো খুব কাঁচা ধরণের প্রতিশ্রুতি হয়। যে শোনে, বা যাকে দেওয়া হচ্ছে সেই প্রতিশ্রুতি, সে সহজেই বুঝে যায় যে এগুলো শুধুই ফাঁকা প্রতিশ্রুতি, এর কোন সারবত্তা নেই। যদি এরকম কোন কোচিং সেন্টার থাকতো, যেখানে প্রার্থীকে হাতে ধরে শিখিয়ে দেওয়া যেতো কী ধরণের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, কখন কী বলতে হবে, যাতে আম ভোটারের মনে হয়, মানে সে যেন কনভিন্সড হয় যে, হ্যাঁ এই প্রতিশ্রুতিটা পূরণ হবে, তাহলে ভালো হয়না? সাধারণ মানুষকে অসম্ভব প্রতিশ্রুতির হাত থেকে রেহাই দেওয়া যায়। জনগণেরও উপকার, আমারও উপকার, টু পাইস কামাই হয়।
যেমন ভাবা, তেমন কাজ! কয়েকদিনের মধ্যেই ভেনাস মোড়ে একটা ঘর ভাড়া করে খুলে ফেললাম 'নিখিলবঙ্গ নির্বাচন বাতেলা শিক্ষণ কার্যালয়, বা সংক্ষেপে নিনিবাশিকা।
চারটে শিফটে ক্লাস করেছি এ'কদিন। সকাল, দুপুর, বিকেল আর রাত। চারটে মেজর পার্টির জন্য চারটে শিফট। যত্ন করে তাদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া শিখিয়েছি। আজেবাজে হাবিজাবি নয়, শুনলে মনে হবে, হ্যাঁ, এইটা পূর্ণ করবে প্রার্থী। কখন কী বলবে, কী পোষাক পরবে, কী খাবে জনসমক্ষে, কেমনভাবে চলবে, গ্রুপ ডিসকাশন, সব শিখিয়েছি হাতে ধরে। যাকে বলে কমপ্লিট গ্রুমিং। দেখছিস না, এবারে আমাদের শহরে কী সুন্দর প্রচার করেছে প্রার্থীরা। ওই একই থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড় বক্তব্য নয়। জলের নদী বইয়ে দেবো, রাস্তা তৈরি করে দেবো, এইসব নয়, কত নতুন নতুন অভিনব প্রতিশ্রুতি দিলো প্রার্থীরা। কত খুড়োর কল ঝোলালো আমজনতার সামনে, আর তারাও ওই খুড়োর কল দেখে প্রার্থীদের পিছন পিছন দৌড়ালো! সব আমার হাতযশ, বুঝলি?"
আমরা হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে, ভজামামা বললো, "গ্রো আপ, বয়েজ। এখন পলিটিক্সও শো বিজনেস।" বলেই টাবলুর মাথায় চটাস করে একটা চাঁটি মেরে লম্বা লম্বা পা ফেলে কোথায় হাওয়া হয়ে গেলো কে জানে!
(সমাপ্ত)