খোখো
খোখো
না। একে তাকে ধরে, গেম টিচারের কাছে হাজার অনুনয়-বিনয় করেও স্কুলের ক্রিকেট টিমে জায়গা হল না ক্লাস সিক্সের পড়ুয়া তিমিরের। হবেই বা কী করে! ক্রিকেট হচ্ছে রাজসিক খেলা। ও খেলা রাজাদেরই মানায়। তার মতো কোচবিহারের দিনহাটা ব্লকের পোকরাবাড়ির এঁদো–গণ্ডগ্রামের দিন আনা দিন খাওয়া, চাষ করতে গিয়ে ঋণে জর্জরিত অতি সামান্য ভাষচাষির ছেলেকে কি ওই খেলা মানায়! যতই সে ভাল খেলুক। ছুটে আসা এক-একটা আগুনের গোলাকে মেরে যতই তালগাছের উপর দিয়ে গ্রামের সীমানার ও পারে পাঠাক, চিলের চেয়েও ক্ষিপ্র গতিতে উড়ে গিয়ে বাতাসের কবল থেকে ছোঁ মেরে লুফে নিক এক-একটা বল, ব্যাটে কোনও রকমে বল ছুঁইয়েই চিতাবাঘের মতো দৌড়ে এক রানের জায়গায় নিয়ে নিক তিন রান, তবু কোনও স্কুল টিমে চান্স পাওয়ার জন্য শুধু এগুলোই যথেষ্ট নয়, বিশেষ করে গ্রামের দিকে। সেখানে শুধু খেলায় কেন, যে কোনও ব্যাপারেই কেবল সুযোগ নয়, যোগ্যতা অনুযায়ী ন্যায্যটুকু পাওয়ার পিছনেও একটা অন্য খেলা চলে। চলে অন্য হিসেব। পঞ্চায়েত প্রধানের রেকমেন্ডেশন লাগে। লাগে স্কুল পরিচালন কমিটির সঙ্গে বাবা-কাকাদের দহরম-মহরম সম্পর্ক। থাকতে হয় মাথার উপরে বড় কোনও মানুষের হাত।
তা হলে কী হবে! বলতেই, গেম টিচার বললেন, তুই একটা কাজ কর। তুই বরং খো খো-র টিমে চলে আয়। ওখানে এখনও বেশ কয়েকটা ভ্যাকেন্সি আছে। দেরি করলে কিন্তু ওটাও হাতছাড়া হয়ে যাবে।
শেষ পর্যন্ত খো খো! হ্যাঁ, ছোটবেলা থেকে গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে সে খো খো খেলেছে ঠিকই, কিন্তু তা বলে... ক্রিকেট থেকে একেবারে খো খো!
ওর বাবা বলেন, যে কাজই করবি, সেটা যদি জুতো সেলাইও হয়, সেটাও মন দিয়ে করবি। দেখবি, একদিন না একদিন ঠিক তার কদর পাবি।
ওকে নাক সিঁটকোতে দেখে গেম টিচার বললেন, শোন, যদি খেলতে পারিস... কোনও খেলাই ছোট নয়। এক সময় তো ফুটবলই একচ্ছত্র রাজত্ব করত এই দেশে। ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের খেলা হলে, শুধু কমেন্ট্রি শোনার জন্যই বিক্রি হয়ে যেত লক্ষ লক্ষ পকেট-ট্রানজিস্টর। সেই খেলা খেলতে জোশ লাগত। দম লাগত। মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হত। সেই পরিশ্রম করার ক্ষমতা সবার থাকত না। তাই ফুটবল ছেড়ে অনেকেই অন্য খেলায় চলে যেত।
কে বলতে পারে, সুনীল গাভাসকার, সচিন তেন্ডুলকর, এমনকী আমাদের সৌরভ গাঙ্গুলিও যে চৌখস ফুটবলারদের মতো অমন অমানুষিক পরিশ্রম করতে পারবেন না বলেই ক্রিকেট খেলায় আসেননি! যে দিন তাঁদের ক্রিকেট খেলায় নাম লেখাতে হয়েছিল, তখনও তো ওটা সে ভাবে জাতে ওঠেনি। হয়তো তাঁরাও সে দিন তোর মতোই এই রকমই হতাশ হয়েছিলেন।
অথচ দেখ, তাঁরা তাঁদের ক্রিকেটে সব কিছু নিংড়ে উজার করে দিয়েছিলেন দেখেই আজকে শুধু তাঁরা নিজেরাই সফল হননি, সেই খেলাটাকেও তুলে এনেছেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। কে বলতে পারে, একদিন হয়তো তোর হাত ধরেই এই খো খো খেলা এত বিপুল সাড়া ফেলবে যে, ক্রিকেটের এই রমরমাকেও ছাপিয়ে যাবে। কী করবি বল?
গত বছর ওর ক্লাসের এক সহপাঠী অনুপ খো খো টিমে নাম লিখিয়েছিল। এত খেলা থাকতে ও কেন খো খো খেলতে গেল, সেটা জিজ্ঞেস করতেই ও বলেছিল, দ্যাখ, ক্রিকেট খেলতে গেলে যা খরচা হয়, তা চালানো তো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। একটা কিটসের দাম কত জানিস? ওগুলো হচ্ছে বড়লোকদের খেলা। অথচ খো খো খেলতে গেলে কোনও ইনস্ট্রুমেন্ট তো নয়ই, প্রায় কিছুই লাগে না। দু’দিকের দুটো খুঁটি আর খোপ কাটার জন্য একটু চুন লাগে। চুন না পেলে ছাই দিয়েও কাজ চালানো যায়। সেটাও জোগাড় না হলে কোদল দিয়ে কেটেও লাইন বানিয়ে নেওয়া যায়। এ ছাড়া যেগুলো লাগে, তা আমাদের প্রায় সবারই আছে। আর সেটা হল— অফুরন্ত দম, গতি, কৌশল, শক্তি, ক্ষমতা, তৎপরতা, ক্ষিপ্রতা আর ভারসাম্য বজায় রাখা। ব্যস। এগুলি হলেই হল। আর যাদের এগুলি নেই, তাদের এগুলি রপ্ত করা আমাদের মতো প্রত্যেক দিন রোদে পুড়ে জলে ভিজে মাঠেঘাটে কাজ করা ছেলেদের পক্ষে মোটেই অসম্ভব নয়।
ওর আর এক বন্ধু হরিশ বলেছিল, সারা ভারতবর্ষ জুড়ে এই মুহূর্তে কত লক্ষ লক্ষ ছেলে ক্রিকেট খেলছে জানিস? পাড়ায় পাড়ায়, অলিতে গলিতে কত ক্রিকেট কোচিং সেন্টার গজিয়ে উঠেছে জানিস? সেখানে কোন ফ্যামিলির ছেলেরা খেলে জানিস? আমরা সেখানে পাত্তাই পাব না। প্রতিদিন সেখানে ভিড় বাড়ছে। এই মুহূর্তে যদি কুড়ি লক্ষ ছেলেও খেলে, তার মধ্যে থেকে চান্স পাবে ক’জন, বল? খুব বেশি হলে কুড়ি জন। তার মানে দলে জায়গা পেতে গেলে আমাকে কত জনের সঙ্গে লড়তে হবে, বল? উনিশ লক্ষ নিরানব্বই হাজার নশো নিরানব্বই জন ছেলের সঙ্গে। তাই না? সেই তুলনায় খো খো-র জায়গা তো অনেক ছোট। ভিড় অনেক কম। আর তা ছাড়া এটা হচ্ছে আমাদের দেশীয় খেলা। আমরা আমাদের দেশের খেলা ছেড়ে কেন বিদেশের খেলা খেলতে যাব বল তো?
মনের মধ্যে খুঁতখুঁত করলেও ওই কথাগুলো মনে পড়তেই তিমির আর মুখে কিছু বলল না। শুধু মাথা কাত করল। সেটা দেখে গেম টিচার বললেন, তা হলে কাল সকালে মাঠে চলে আসবি। ক’দিন প্যাক্টিস করাব। কারণ, সামনের সপ্তাহে কলকাতা থেকে বলরাম হালদার আসবেন। তিনি শুধু খো খো-র প্রশিক্ষকই নন, রাজ্য খো খো সংস্থার যুগ্ম সম্পাদকও।
এমনিতেই খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে ও। ক’দিন ধরে আরও ভোরে উঠছে। উঠেই, কাঁচালঙ্কা নুন দিয়ে পান্তাভাত খেয়েই স্কুলের সামনের মাঠে চলে যাচ্ছে। গেম টিচারের দেখিয়ে দেওয়া কিছু ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ অন্তত আধ ঘণ্টা ধরে করছে। এ মাথা থেকে ও মাথা দৌড়োচ্ছে। তার পর মাঠে নেমে এত দিন যে ভাবে গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে যখন যে ক’জন এসেছে, সে ভাবে দল ভাগ করে, কখনও সখনও এক আধজন বেশি হয়ে গেলে, যে দল দুর্বল, সেই দলে তাকে দিয়ে দিয়েছে। তাতে কোনও দলে গুনতিতে বেশি ছেলে হলেও কেউ কোনও প্রতিবাদ করেনি। বরং খুশি হয়েই খেলেছে।
কিন্তু এখন আর সে ভাবে খেলছে না। খো খো কোর্ট তৈরি হয়েছে একেবারে নিয়ম মেনে। চোদ্দো মিটার প্রস্থ। তেইশ মিটার দৈর্ঘ্য। সেই দৈর্ঘের দুই প্রান্তে দুটি খুঁটি পোঁতা হয়েছে। প্রস্থের ঠিক মাঝখানে। মানে খুঁটির এ দিকে সাত মিটার আর ও দিকে সাত মিটার। এই দুই খুঁটির মাঝ বরাবর যে রেখা তাকে আটটা সমান ভাবে ভাগ করে রেখা টানা হয়েছে প্রস্থের দুই সীমানা পর্যন্ত।
গেম টিচার বললেন, তোমরা আগে যে ভাবে খো খো খেলেছ, সেটা ভুলে যাও। মনে রাখবে এটা একটা দলগত খেলা। খেলা হয় দুটো দলে। এক দল চেজ করে অন্য দল ডিফেন্স। প্রতি দলে বারো জন করে খেলোয়াড় থাকলেও মাঠে নামে কিন্তু ন’জন করে। বাকি তিন জন রিজার্ভে থাকে। যদি কোনও খেলোয়াড়কে মাঠ থেকে বেরিয়ে যেতে হয়, তা হলে তার পরিবর্তে যাতে ওখান থেকে তার পরিবর্ত খেলোয়াড় হিসেবে কেউ নামতে পারে।
যারা চেজ করে, সেই দলের ন’জনের আট জন দুই খুঁটির মাঝ বরাবর রেখার মধ্যে সম দূরত্বের যে আটটি রেখা ভেদ করে, সেই আটটি সংযোগ স্থলে গিয়ে বসে। পরস্পর বিপরীতমুখী হয়ে। আর নবম জন দু’প্রান্তের যে কোনও একটি খুঁটির কাছ থেকে চেজিং শুরু করে। চেজ মানে দৌড়ে গিয়ে ডিফেন্ডারকে ছোঁয়া। ছুঁলেই আউট। এই চেজারের মুখ যে দিকে থাকে তাকে সে দিকেই ছুটতে হয়। সে পিছন ফিরতে পারে না। উল্টো দিকে ছুটতে গেলে সামনের খুঁটির ও পাশ থেকে ঘুরে আসতে হয়। এমনকী যে আট জন চেজার দুই খুঁটির মাঝ বরাবর খানিক দূর দূর বিপরীতমুখী হয়ে বসে থাকে, তাদের মাঝখান দিয়েও গলে যেতে পারে না।
আর যারা ডিফেন্স করে তাদেরও ন’জন খেলোয়াড় কিন্তু একসঙ্গে মাঠে নামে না। সেই ন’জনকে দক্ষতা আর যোগ্যতা অনুযায়ী তিন জন করে তিনটে উপদলে ভাগ করা হয়। প্রথমে একটি উপদল নামে। সেই উপদলের তিন জনই ম’র হয়ে গেলে মাঠের বাইরে অপেক্ষা করা পরের উপদলটি নামে। তারাও ম’র হয়ে গেলে শেষ উপদল। এবং নির্ধারিত সময়ের আগেই যদি তিনটি উপদলই ম’র হয়ে যায়, তা হলে প্রথম উপদলটি ফের মাঠে নামে।
এবং চেজারদের যতই বিধিনিষেধ থাকুক না কেন, ডিফেন্ডাররা কিন্তু যে দিকে খুশি যেতে পারে। আগে-পিছেই শুধু নয়, দুই খুঁটির মাঝখানে যে আট জন চেজার বসে থাকে, তাদের যে কোনও ফাঁক থেকে যত বার খুশি যাতায়াত করতে পারে। অর্থাৎ তাদের কাছে পুরো কোর্টটাই ফ্রি জোন। তবে হ্যাঁ, চক দিয়ে কোর্টের যে সীমানা কাটা আছে, তার বাইরে যেতে পারে না। অন্তত একটা পা কোর্টের মধ্যে রাখতেই হয়।
খেলার আগে প্রতিদিনই টস হয়েছে। যারা টস জিতেছে তারা কখনও নিয়েছে চেজিং। কখনও ডিফেন্স।
না। ন’মিনিট করে নয়। ওটা বড়দের জন্য। তাদের বয়েস যেহেতু আন্ডার টুয়েলভ, তাই সাত মিনিট করে এক-একটি পর্ব। প্রতি পর্বের পর তিন মিনিট করে বিরতি। মোট চারটি পর্ব। দুটি পর্ব মিলিয়ে একটি পর্যায়। তবে পর্যায়ের শেষে আর তিন মিনিট নয়, তখন ছ’মিনিটের বিরতি। অর্থাৎ সাত প্লাস তিন প্লাস সাত প্লাস ছয় প্লাস সাত প্লাস তিন প্লাস সাত মিলিয়ে মোট চল্লিশ মিনিট করে খেলেছে ওরা।
প্রতিটি পর্বের পর পালাবদল হয়েছে। আগের পর্বে যারা চেজিং করেছে তারা পরের পর্বে ডিফেন্স করতে নেমেছে। আর ডিফেন্সরা নেমেছে চেজিং করতে। চেজিং করার সময় বিপক্ষ দলের যত জনকে ছুঁয়ে ম’র করছে, তত পয়েন্ট পেয়েছে তারা। দুই পর্যায়ের সংগ্রহ করা পয়েন্টের ব্যবধানেই নির্ধারিত হয়েছে জয়-পরাজয়।
বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে চেজার আক্রমণ শুরু করেছে। যখন কোনও চেজার কোনও ডিফেন্ডারকে নাগালে পায়নি, তখন দুই খুঁটির মাঝ বরাবর বসে থাকা চেজারের পিঠে হাত দিয়ে তাকে স্পর্শ করে ‘খো’ বলেছে। ‘খো’ পাওয়ার পর সেই চেজার সঙ্গে সঙ্গে একজন সক্রিয় চেজার হয়ে উঠেছে। আর যে তাকে ‘খো’ দিয়েছে, সে তার জায়গায় বসে পড়েছে।
কেউ ছোঁয়ার আগেই ‘খো’ বললে, আবার ‘খো’ বলে স্পর্শ না করলেও বিধিভঙ্গ হয়েছে। সে ক্ষেত্রে গেম টিচার তাকে হলুদ কার্ড দেখিয়ে ওয়ার্নিং দিয়েছেন। আর তার চেয়েও গুরুতর বা একই বিধি বারবার ভাঙলে লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বার করে দিয়েছেন। শুধু তাইই নয়, তাকে আর সে দিন ওই খেলায় অংশই নিতে দেননি। তার পরিবর্তে কোর্টের বাইরে অপেক্ষা করতে থাকা তিন জন খেলোয়াড়দের মধ্যে থেকে সেই দলকে পরিবর্ত খেলোয়াড় হিসেবে নামানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
গেম টিচার সারা মাঠ দৌড়ে দৌড়ে একাই দু’জন আম্পায়ার, একজন রেফারি, একজন টাইম কিপার এবং একজন স্কোরার, অর্থাৎ একাই পাঁচ জনের কাজ করে গেছেন।
এই ক’দিন প্যাক্টিস করেই নতুন নতুন অনেক নিয়ম কানুন আর এই খেলার খুঁটিনাটি বেশ কিছু তথ্য জেনে নিয়েছে তিমির। তাই ভেবেছিল, গত কাল রাতে কলকাতা থেকে আসা বলরামবাবু যখন বেলার দিকে সবাইকে নিয়ে বসবেন, তখন ও আর সেখানে যাবে না। বরং বাবার হাতে হাতে চাষের কাজ করার জন্য মাঠে চলে যাবে। কিন্তু গেম টিচার যখন বললেন, তোমাদের সবাইকেই আসতে হবে। কারণ, পারফর্ম্যান্স দেখে কালই উনি স্কুল টিম তৈরি করে দেবেন। যে আসবে না বা যে শেষ পর্যন্ত থাকবে না, সে যত ভালই খেলুক না কেন, তাকে তিনি স্কুল টিমে রাখবেন না।
তখন ও সিদ্ধান্ত বদল করল।
ওরা একটু আগেই পৌঁছে গিয়েছিল স্কুলে। স্কুল মানে তিনটে মাটির ঘর। তার একটার দেওয়াল আবার হেলে পড়েছে। যে কোনও দিন ভেঙে পড়তে পারে। দুটো টিনের আর দুটো পাকা ঘর। তারই একটায় থাকার ব্যবস্থা হয়েছে বলরামবাবুর। শোওয়ার জন্য নীচে পুরু করে পেতে দেওয়া হয়েছে বিছালি। তার উপরে চাদর। তাতেই উনি ঘুমিয়েছিলেন। তাঁর
নাকি এ সব অভ্যাস আছে। আজ বিকেলের মধ্যেই স্কুল টিম তৈরি করে কাল সকালেই ফিরে যাবেন। তাই অন্য যে পাকা ঘর আছে, না। এখনও প্লাস্টার হয়নি সেটা। ইটের ফাঁক-ফোকর থেকে শুকিয়ে যাওয়া সিমেন্ট-বালির চাঙর উঁকি মারছে। সেই ঘরেই এসে জড়ো হয়েছে ওরা।
গেম টিচার ওদের আগেই বলে দিয়েছিলেন, কারও যদি কোনও কিছু জানার থাকে, মন খুলে তার কাছ থেকে জেনে নিয়ো। উনি খুব ভাল মানুষ।
খানিক বাদেই গেম টিচারের সঙ্গে যে বেঁটেখাটো গোলগাল চেহারার লোকটা ঘরে ঢুকলেন, তাঁকে দেখেই ওরা বুঝতে পারল, ইনিই সেই লোক। উনি ঘরে ঢুকে কোনও ভনিতা না করেই বললেন, তোমাদের একটা কথা বলি। তোমরা খো খো খেলতে এসেছ। খুব ভাল কথা। কিন্তু যেটা খেলতে এসেছে, সেই খেলার ইতিহাস কি তোমরা জানো? জানলে হাত তোলো।
না। একজনও হাত তুলল না।
সারা ঘরে উনি একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, তা হলে আমি তোমাদের সেই ইতিহাসটা আগে বলি। বলেই, বললেন, যদিও কবাডি, মালখাম্বা, দাড়িয়াবান্দা, আটিয়া পাটিয়া, শিড়গিজ-এর মতো এই খো খো-টাও আমাদের দেশের আদি খেলা। কিন্তু এই খেলা উনিশশো চোদ্দো সালে সরকারি ভাবে প্রথম শুরু হয় মহারাষ্ট্রের ডেকান জিমখানা ক্লাবে। উনিশশো চব্বিশ সালে গুজরাতেরই বিজয়হিন্দ জিমখানা ক্লাবে এই খেলার প্রাথমিক নিয়মকানুন তৈরি হয়। এবং ওই রাজ্যেরই ড. বাইনরুলকার ও কেজি অ্যালায়েন এগিয়ে আসেন এর প্রচার ও প্রসারে। উনিশশো পঁয়ষট্টি সালে ভারতীয় এবং উনিশশো সাতাশি সালে এশিয়ান খো খো ফেডারেশন গঠিত হওয়ার পর থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এটা ছড়িয়ে পড়ে।
এখন তো ভুটান, জাপান, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, এমনকী মায়ানমারেও এই খেলা হচ্ছে। এই খেলায় সব চেয়ে সুবিধে হল, এতে খেলোয়াড় খাটো হলে ডিফেন্সের সময় যেমন ভড়কি দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সুবিধে পায়, তেমনি লম্বা হলেও চেজিংয়ের সময় বড় বড় পা ফেলে ছুটে গিয়ে লম্বা লম্বা হাত দিয়ে অনেক দূর থেকেই বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়কে ছুঁয়ে ম’র করে দিতে পারে। তাই আমরা দু’ধরনের খেলোয়াড়কেই দু’রকম ভাবে তালিম দিই।
তবে একটা কথা, এটা যেহেতু গ্রাম, ইনডোরে ম্যাট্রেসের উপরে ম্যাটের জুতো পরে খেলা হচ্ছে না, এমনকী কেম্বিসের জুতো পরেও না। তোমরা খালি পায়ে খেলছ, তাই খো খো খেলার জন্য যেখানে কোর্ট কাটা হবে, সেই মাঠটা আগে ভাল করে দেখে নিও। যাতে সেখানে কোনও ইটের টুকরো বা ভাঁড় ভাঙা মাথা তুলে না থাকে। কাচের টুকরো পড়ে না থাকে। পুজো বা বিয়ে-অন্নপ্রাশনের প্যান্ডেল যে মাঠে হয়, সে মাঠে হলে ভাল করে দেখে নিতে হবে, যাতে পেরেক পড়ে না থাকে এবং গর্তও যেন না থাকে। এতে ইনজুরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। গর্তে পা পড়ে অ্যাঙ্কেল সরে যেতে পারে। বেকায়দায় পড়ে মালাইচাকি ঘুরে যেতে পারে। উঠে থাকা ইটের কোনায় লেগে পায়ের নখ উঠে যেতে পারে। তাই মাঠ পরিষ্কার থাকলেও খেলার সময় হাতের কাছে একটা ফার্স্ট এইড বক্স সব সময় রাখা উচিত। অন্তত একটু ডেটল আর তুলো। নিদেনপক্ষে কয়েকটা ব্যান্ড এইড।
এর সঙ্গে সঙ্গে এটাও জেনে রাখো, আমরা কিন্তু এত দিন সে রকম ভাবে কোনও সুযোগ সুবিধে পাইনি। না-রাজ্য সরকার, না-কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে। স্পনসরও জোটেনি। জুটবেই বা কী করে? মিডিয়ারা তো অন্য খেলা নিয়ে ব্যস্ত। খো খো-র দিকে তাকাবার ফুরসতই নেই তাদের। আর আমাদের দেশ? আমেরিকা যেমন বাসকেটবলকে, জাপান যেমন জুডোকে, সুইৎজারল্যান্ড যেমন চকবলকে, চিন যেমন মার্শাল আর্টকে প্রমোট করে, আমাদের দেশ কিন্তু তাদের এই দেশীয় খেলার জন্য একটা পয়সাও খরচা করতে চায় না। একেবারে অস্পৃশ্য করে রেখে দিয়েছিল। এখন অবশ্য অতটা খারাপ অবস্থা নয়। তবু...
এই তো কিছু দিন আগে পঁয়তিরিশতম জাতীয় গেমসে ফুটবল দলকে যেখানে বিমানে করে কেরলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেখানে আমাদের যেতে হয়েছে স্লিপার কোচে। অথচ ওই গেমসে ওরা নয়, দলীয় খেলায় একমাত্র পদক ছিনিয়ে এনেছে এই খো খো-ই। না। শুধু পুরুষরাই নয়, মহিলারাও।
আর এই জন্য এখন এই সরকারের ক্রীড়া বিভাগ, ক্রীড়া পর্ষদ, এবং সাইয়ের মাধ্যমে রাজ্য এবং জাতীয় স্তরেও আমরা কেবল প্রশিক্ষণই নয়, নানা রকম সাহায্য ও সহযোগিতাও পাচ্ছি।
এর মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলার খেতাব ‘অর্জুন পুরস্কার’ ছিনিয়ে নিয়েছে খো খো-র মোট বারো জন। দ্রোণাচার্য প্রশিক্ষকের খেতাবও হাতে চলে এসেছে একজনের।
আর এর জন্যই টনক নড়েছে বহু সংস্থারও। তাই ফুটবলার, ক্রিকেটারদের মতো খো খো খেলোয়াড়দেরও চাকরি হচ্ছে পুলিশে, ইনকাম ট্যাক্সে, ব্যাঙ্কে, এমনকী রেলেও। আমি কথা দিচ্ছি, তোমরা শুধু মনপ্রাণ সঁপে খেলে যাও। তোমাদের দায়িত্ব আমার।
ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে যাবার আগে উনি বলেছিলেন, তবে তোমরা কারা কারা শেষ পর্যন্ত এই স্কুল টিমে থাকবে, তা তোমাদের দৌড়, টার্নিং, ব্যলেন্স এবং খেলার কৌশল দেখার পরেই আমি ঠিক করব। তোমরা তিনটে নাগাদ চলে এসো। ঠিক আছে?
প্রত্যেকেই ঘাড় কাত করেছিল।
যাবার আগে গেম টিচারের হাতে উনি তুলে দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ খো খো অ্যাসোসিয়েশন থেকে দু’হাজার দশ সালে প্রকাশিত তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শ্রীদীপঙ্কর বাগচীর লেখা ‘খো খো খেলার নিয়মাবলী’। তার সঙ্গে দিয়েছিলেন জেরক্স করা একটা পাতা। ওই বই প্রকাশের পরে দু’হাজার তেরো সালে যে নিয়মকানুনগুলি অদল বদল হয়েছে তার সংশোধনী।
স্কুল টিমে কে কে চান্স পাবে আজই তার তালিকা তৈরি হয়ে যাবে। তাই তিনটের আগেই সবাই মাঠে এসে গেছে। এসেছেন বলরামবাবুও। তখন খুঁটি পোঁতা হয়ে গেছে। চকের গুড়ো দিয়ে খোপ কাটা হচ্ছে। যে খোপ কাটছে, তার হাতে কাগজের ঠোঙায় চকের পরিমাণ দেখে উনি বললেন, অত খোপ কাটতে হবে না। সেন্টার লাইনেও কম হলে চলবে। চুনটা আউট লাইনে বেশি করে দাও। যাতে চেজারের কাছ থেকে পালাবার সময় কোর্টের আউট লাইনটা ডিফেন্ডারদের নজরে পড়ে।
কিন্তু খেলা শুরু হতে না-হলেও উনি খেলা থামিয়ে দিলেন। তার পর চেজারের উদ্দেশে বললেন, এ কী, শুধু ছুটছ কেন? ডিফেন্ডারের গতি খেয়াল করো। ও কোন দিকে যাচ্ছে। কোন দিকে যেতে পারে। বুঝেছ? ডিফেন্ডার সব সময় চাইবে, তুমি যেই তাড়া করবে টুক করে দুই খুঁটির মাঝ বরাবর বসা চেজারদের মাঝখান থেকে গলে ও দিকে চলে যাবার। কারণ, তুমি তো ওখান থেকে গলে গিয়ে ওকে ছুঁতে পারবে না। ও দিকে যেতে গেলে তোমাকে ওই খুঁটির ও পাশ থেকে ঘুরে তার পর যেতে হবে। তখন তুমি কী করবে? খেয়াল করবে ডিফেন্ডার যেখানে আছে, তার সব চেয়ে কাছে ও দিকে মুখ করে কোন চেজার বসে আছে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে খো দেবে। তা হলে সে উঠেই তাকে ছুঁতে পারবে।
সেই চেজার বলেছিল, তাতে কী হবে? ও তো আবার সেন্টার লাইন টপকে এ পাশে চলে আসবে।
বলরামবাবু বলেছিলেন, সে তো আসবেই। ও তো চাইবেই নিজেরে রক্ষা করতে।
—তা হলে?
—যেই ও এ দিকে আসবে সঙ্গে সঙ্গে ও দিকে ছুটতে থাকা চেজার এ দিকে মুখ করে বসা চেজারকে খো দেবে। এবং এটা যে যত সুইপ করতে পারবে, জানবে সে তত চৌখস হয়ে উঠছে।
—তা হলে খুঁটির ও পার থেকে ঘুরে গিয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করব না?
—কেন করবে না? সেটা বুঝে করতে হবে। এটাই তো খেলা। আর তোমাদের বলছি, বলেই, ডিফেন্ডারদের উদ্দেশে বলেছিলেন, চেজারদের গতিবিধির দিকে খেয়াল রাখো। ওদের কাছ থেকে নিজেদের এমন দূরত্বে রাখো যাতে সহজে আউট না হও। এবং চেজাররা যাতে তোমাদের গতিবিধি আন্দাজ করতে না পারে, সে দিকে নজর দাও। দরকার হলে টুক করে সেন্টার লাইন ক্রস করে ও পারে চলে যাও। তবে খেয়াল রাখবে সেন্টার লাইন থেকে কখনওই এত দূরে সরে যাবে না যাতে তাড়া খেয়ে আত্মরক্ষা করতে গিয়ে কোর্টের বাইরে চলে যাও।
আর আপনাকে বলছি, বলে, গেম টিচারকে বলেছিলেন, খুঁটি দুটোতে এত গাঁট কেন? একদম মসৃণ করে নেবেন। কারণ, চেজাররা যখন দৌড়ে গিয়ে ওটা ধরে বাঁক নেয়, তখন ওই গাঁটে লেগে হাতের তালু ইনজুরি হতে পারে। আর এমন ভাবে পোলটা পুঁতবেন, যাতে মাটির উপরে একশো কুড়ি সেন্টিমিটার দাঁড়িয়ে থাকে। এটাই নিয়ম। তাতে লম্বা হলেও কোনও খেলোয়াড়ের কোনও অসুবিধে হবে না।
ফের খেলা শুরু হল। খানিকক্ষণ পরেই উনি আবার খেলা থামিয়ে দিলেন। চেজারকে বললেন, নিজের গতি কন্টোল রাখার চেষ্টা করো। ডিফেন্ডার ঝট করে সেন্টার লাইনের ও পারে চলে গেল, আর তুমি নিজের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে অতটা চলে গেলে! অতটা গিয়ে তুমি যাকে খো দিলে, সে যখন উঠে দাঁড়াল, সেই সময়ের মধ্যে ও কতটা দূরত্ব তৈরি করে নিল বলো তো? তোমার যা গতি ছিল, তুমি তো ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতে। বুদ্ধি আর হিসেব করে হাত বাড়িয়ে যদি নিজেকে ওর দিকে ছুড়ে দিতে ও তা হলে ঠিকই আউট হয়ে যেত। সেটা করলে না। সব সময় লক্ষ রাখো, লক্ষ।
তোমাকে কী করতে হবে? ছুঁতে হবে। ছোঁয়া মানে তুমি ছোঁও বা তোমার দলের যে আট জন দুই খুঁটির মাঝ বরাবর বসে আছে, তাদের কেউ ছুঁক। ব্যাপারটা একই। ফুটবল খেলার সময় যেমন বল বেশিক্ষণ পায়ে ধরে রাখতে নেই, তাতে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় এসে বল কেড়ে নিতে পারে, এখানেও তেমনি। পাস করো পাস। যে সামনে আছে, তাতে খো দিয়ে পাঠিয়ে দাও ডিফেন্ডারকে ছোঁয়ার জন্য। আর যে সব চেজার বসে আছ, তারা একদম রেডি থাকো। যাতে খো পাওয়ার মাত্রই ঝাঁপিয়ে পড়তে পারো, বুঝেছ?
তোমাকে আর একটা কথা বলি। বলেই, তিমিরকে বললেন, তুমি ওই পোলটাকে ধরে বাঁক নেওয়ার সময় নিজের ভারসাম্যটাকে ধরে রাখতে পারলে না কেন? শরীরটা ও দিকে অতটা ঝুঁকিয়ে দিলে যে আর একটু হলেই পোলটা ভেঙে যেত। তা হলে কী হত জানো? তোমরা যে এই পর্বে এর মধ্যে পাঁচ জনকে ম’র করেছ, সেটা বিফলে যেত। কারণ, পোল ভেঙে যাওয়ার জন্য এই পর্বটা বাতিল হয়ে যেত। নাও, শুরু করো...
আবার বাঁশি বেজে উঠল।
তিতির পোলের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। এ বার সে চেজ করার জন্য এগোবে। ও এখন অনূর্ধ্ব বারোয় খেলছে। এর পর অনূর্ধ্ব চোদ্দোয় যাবে। তার পর অনূর্ধ্ব উনিশে। স্কুল লেবেল ঠিক মতো খেলতে পারলেই এখান থেকেই সোজা জেলার টিমে। জেলা থেকে রাজ্য। রাজ্য থেকে জাতীয় টিমে।
ও দেখতে পাচ্ছে ও জাতীয় দলে খেলছে। সামনেই কোর্টের মধ্যে তিন জন ডিফেন্ডার। কে কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ভাল করে দেখে নিচ্ছে। একজনকে টার্গেট করেও ফেলেছে। নিজে না পারলেও তার যে আট জন সঙ্গী সেন্টার লাইনে পর পর বসে আছে, তাদের কাউকে না কাউকে ও ঠিক খো দিয়ে দেবে তাকে আউট করার জন্য।
খুঁটির কাছে দাঁড়িয়ে শেষ বারের মতো দেখে নিচ্ছে ডিফেন্ডাররা কে কোথায়। হঠাৎ কান বিদীর্ণ করা একটা চিৎকার ভেসে এল বহু দূর থেকে। ওর চোখ চলে গেল সে দিকে। দেখল, ওর ছোট ভাই ওর নাম ধরে চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছে। ও ভাবে একটা ছেলেকে দৌড়তে দৌড়তে আসতে দেখে বলরামবাবুও থমকে গেলেন। গেম টিচারও বাঁশি বাজাতে ভুলে গেলেন। তিমিরও দাঁড়িয়ে রইল।
ছেলেটা সামনে এসে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, দাদা, এক্ষুনি বাড়ি চল। বাবাকে সাপে কেটেছে।
সেটা শুনে তিমির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির দিকে ছুট লাগাল।
গেম টিচার চেঁচিয়ে উঠলেন, কীরে, কোথায় যাচ্ছিস? দাঁড়া দাঁড়া দাঁড়া। এ ভাবে চলে গেলে যে তোর নাম স্কুল টিমে আর রাখা যাবে না। ফিরে আয় ফিরে আয়। কিন্তু ফেরা তো দূরের কথা, ও পিছন ফিরেও একবার তাকাল না। সোজা ছুটতে লাগল বাড়ির দিকে।