জোছনা বিলাস
জোছনা বিলাস
কমলাকান্তের কালো ঠোঁটে
আজকাল বড্ড চুম্বনের সাধ,
মেয়েটি ছেলেবেলায় হাতে লক্ষীপটের সাথে
নিয়ে গেয়েছিলো লাল মাটির পুতুল,
মাঠের রোদ দুপুরে একদিন
মন্দিরের দূর্গার মতো
কাজল কালো চোখ টেনে টেনে
কমলাকান্তের দিকে তাকিয়ে বলেছিলো,
" তুই আমার সখা হবি?
আমি তোর জন্য জুঁই ফুলের মালা গেঁথে দেবো,
তুই সে মালা তোর বাঁশীতে পড়াবি ! "
কমলাকান্তের সখীর সাধটা ঠিক সেদিন থেকেই চোখে ভেসে ভেসে বেড়াতো !
মেয়েদের বয়স বাড়লে যেমন গতর বাড়ে,ছেলেদেরও তেমনি ! মাত্র বারো বছর বয়সে কমলাকান্তের বুকের ছাতি গাঁয়ের জোয়ানদের থেকেও চওড়া ছিলো ! দিঘীর ঘাটে স্নান করতে করতে অনেক দিন কমলাকান্ত ঘাটের কোনে জড়ো হওয়া বৌ- বেটিদের কেমন কেমন চাহনি লক্ষ করতো ! মুখে লাজ, চোখে আহবান, যেন জোয়ারে ভাসতে আকুল কলমি !
সেদিন মাঠের ক্ষেতি দিতে দিতে যখন পেটের টান পড়ছিলো,পেছন থেকে লক্ষির ডাক শুনে ভেজা মুখ পেছন নিতেই কমলাকান্তের সর্বনাশের শুরু ! ভরা মুখে কাজল কালো চোখের মেয়েটা কি অদ্ভুত নারী হয়ে উঠেছে ! ঠিক গাঁয়ের বৌ-ঝিয়েদের মতো নয়,কেমন যেন অন্যরকম ! বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারেনি সেদিন কমলাকান্ত ! লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিয়েছিলো পরক্ষনেই ! অথচ লক্ষী কি অবলীলায় হাসতে হাসতে বলে গেলো,"
এবার সখা তোমার বাঁশী শুনেই তবে শ্বশুরবাড়ী ভিড়বো "!
একপাল ছেলেমেয়ে নিয়ে লক্ষির ভরা সংসার ! সোয়ামির বাজারে বড় আরতি ! সুখ যেন উপচে পড়ছে নারীর আলতা পায়ে ! দেখে মাঝে মাঝে কমলাকান্তের হাসি পায় ঠোঁটে ! কার বাঁশী কে সাজায় ? যখন দুপুরের গাঁয়ে চুপকথাদের ভীড় পড়তো, তখন লক্ষী চুপ করে এসে মাঠা পেড়িয়ে কমলাকান্তের পাশে এসে পা ছড়িয়ে বসতো ! জামার ঝুলিতে পাঁকা পেয়ারা লংকা- নুন দিয়ে মেখে লুকিয়ে লুকিয়ে কমলাকান্তের জন্য নিয়ে আসতো ! আর কমলাকান্তও যেন জানতো,লক্ষির সবকিছুতেই ওর অধিকার ! তাই হা করে মুখ বাড়িয়ে দিতো এলোচুলের পাগলিটার হাতের দিকে ! লক্ষিও মায়া করে মুখে তুলে দিতো আর চোখে মুখে কপট রাগ নিয়ে বলতো," ইস,ভাব দেখো না রাখালরাজার,যেন তার বৌয়ের হাতে গরম ভাত গিলছে, বলি আমি যখন সোয়ামীর ঘরে চলে যাবো তখন তোমায় এই ভাব কোন মেয়ে করবে শুনি?বাপ বলেছে আমার নাকি রাজপুত্রের মতো একখান বর হবে , ঘোড়ায় চড়ে সে আমাকে বিয়ে করতে আসবে ! তখন এই রাখালরাজার খুব সাধ মিটবে,হুম "!
সাধ,সাধ তো মিটেই গেছিল কমলাকান্তের, যখন লক্ষি ইঞ্জিনের গাড়ী চড়ে শ্বশুরবাড়ী গেলো,তখন কমলাকান্ত রাস্তার মানুষের ভীড়ে মিশে অচেনা হয়ে লক্ষির নারায়ণ যোগ দেখছিলো ! বুকের ভেতর তখনও কষ্টটা নড়েচড়ে বসেনি,বসলো কিছুদিন পর,
যখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতো,তখন মনে হতো আজ বুঝি আকাশে সুরুজ ওঠেনি ! মেয়েটাকে দেখার বড্ড সাধ হতো,মনে হতো এক ছুটে গিয়ে লক্ষির নারায়ণকে গিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়ে মেয়েটার হাত ধরে নিয়ে আসি ! মাসের পূর্ণিমাগুলোতে দিঘীর জল ঘেঁষে ছোট্র নৌকো করে দুজনে লুকিয়ে লুকিয়ে মাঝ জলে গিয়ে বসে থাকতো !
মেয়েটা ফ্যালফ্যাল করে আকাশের দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে কমলাকান্তের গায়ে হাত দিয়ে বলতো,
" আচ্ছা, আকাশটা কেন এতো সুন্দর করে সাজন দেয় বলো দেখি, আমার যে কেমন নেশা নেশা লাগে ! রাখাল তুমি আমারে সারাজীবন এই জোছনা দেখাতে আনবা তো?"
কোন উত্তর না দিয়ে কমলাকান্ত কেবল মুগ্ধ হয়ে তখন মেয়েটার মুখের চাঁদের আলোর ছায়া দেখতো ! আর মনে মনে ভাবতো," ইস,দিঘীটা যদি আমার হতো,তবে পাগলিটারে আমি এই দিঘীটা দিয়ে দিতাম,আর বিনিময়ে সারাজীবন শুধু এই জোছনায় ভাসা বদনখানি দেখতাম !
কতো আগুন এই রাতে পুড়ে পুড়ে ছাই হতো প্রেমের কাছে,আর লক্ষি- কমলাকান্ত নেশায় বুঁদ হয়ে গাঁয়ের রুপ দেখতো ! তখনও কমলাকান্ত জানতো খেলার সাথি মানে সারাজীবনের সাথী ! এখন কমলাকান্ত গতরের চাইতে মনে অনেক বড় হয়েছে , বোঝে চাইলেও কিছু সুখ সমাজে বড্ড নিষেধ হয়ে মনেই মরে !
সাহস হয়না, রাতের আঁধারে নারায়ণের লক্ষিকে নিয়ে মাঝ দিঘীর জলে জোছনা দেখতে,তবে ইচ্ছেটা তো হয় খুব !
কিন্তু লক্ষি আজ বিকেলেও খবর প
াঠিয়েছে,রাত দুটোয় দিঘীর পশ্চিম পাড়ে পলাশ গাছের নিচে সে আসবেই আসবে ! আজ টকটকে চাঁদ গাঁয়ে মাথার উপর এই মায়া সংসারের রুপ মেখেছে নিজের গতরে ! আজ না হলে কমলাকান্তেরও যে বড় আফসোস থেকে যাবে ! পোড়া ঠোঁটের চুমুর সাধ যে করেই হোক লক্ষিকে বলতেই হবে ! পুরুষেরও লজ্জা থাকে,বিশেষ করে যে নারীকে ভালোবাসে তার কাছে বেশী ! তাই হাজার চাইলেও যেন চোখের কথা ঠোঁটে নামে না ! সারাবেলা কাজ করে করে কমলাকান্ত বড্ড ক্লান্ত ছিলো আজ,বিকেল থেকে সন্ধ্যা অব্দি তাই দিঘীর জলে ডুব মেরে ছিলো বুনোহাঁসের মতো ! তারপর ঘরে ফিরে বাঁশীটারে খুব যতন মুছে নিজের কোমরের ভাঁজে গুঁজে নিয়েছে ! চারিদিকে ছমছমে জোছনায় ভেসে যাচ্ছে সব আঁধার আলোর বানে ! কমলাকান্ত ঘর খুলে বাইরে এসে বুক ভরে দম নিয়ে নিলো ! দম নিতে নিতে হঠাৎ হেসে উঠলো কমলান্তের ভেঁজা ঠোঁট ! আগে মেয়েটার সাথে একসাথে এভাবে দম নিয়ে দিঘীর মেহেদী হয়ে ফুঁটে থাকা পদ্মের গন্ধ নিতো ! আহ,রুপের ও যে কি দারুণ গন্ধ থাকে,সেটা কে বুঝবে?
তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে কমলাকান্ত ঝিরঝির বাতাসেও যেন ঘেমে যাচ্ছে ! পাগলিটা সত্যিই আসবে তো? মনের ভেতর সুখে তিয়াসা আর শরীরের আলোর খিদে নিয়ে কমলাকান্ত পলাশ গাছের নিচে এসে দাঁড়ালো ! চারদিকে আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে সব ! কমলাকান্তের যেন কেমন নেশা নেশা লাগছিলো ! মনে প্রেমের খিদে নিয়ে অপেক্ষা করতে যে পুরুষের বড় ভালো লাগে গো,বড় ভালো লাগে ! পাশের দিঘীর জলে টলমটল করছে চাঁদের ছায়া,মনে হচ্ছে চাঁদটাও আজ কমলাকান্তের মতো দিঘীর জলে স্নান করতে নেমে খেলার ছলে গা ভাসিয়ে রেখেছে ! কতো শতো ভাবনা চোখের কোনে পাল্লা দিয়ে সুখী হতে চাইছে আজ ! আজ তবে সেই রাত হোক,যে রাত বড় যতনের রাত গো,বড় যতনের ! অপেক্ষারা যখন কমলাকান্তের বুকে সময় ঘড়ি দেখিয়ে দিলো,তখন কমলাকান্ত বাঁশী ধরলো ঠোঁটে ! কি দারুণ এক সুরে সুর গিয়ে আছড়ে পড়লো মাটিতে লেপা চাঁদনীর গায় !
একসময় বাঁশী বাজাতে বাজাতে কমলাকান্ত পাগলের মতো হয়ে উঠলো ! বুকের পাঁজরের সব নোনা জল যেন আছড়ে পড়লো বাঁশের বাঁশীতে ! হঠাৎ মনে হলো মাটির আসনের পাশে কেও বসে কমলাকান্তের কাঁধে মাথা রাখলো আলতো করে ! লক্ষি অনেকক্ষণ ধরে এসে চুপ করে দিঘীর জলে চোখ রেখে চাদের ছায়া দেখতে দেখতে বাঁশীওয়ালার মনের সুর শুনছিলো কান পেতে ! যখন চোখের কোনে ঝাপসা সুখের স্রোত আছড়ে পড়তে চাইছিলো,তখন আর তর সইলো না কমলাকান্তের পাগলির, গাঁয়ের সবচাইতে পাগল ছেলেটির বুকে মাথা রেখে কাঁদতে চাইছিলো দুচোখ শুধু ! কমলাকান্ত বাঁধা দিতে চেয়েও দিতে পারলো না ! কিছু কান্না মানুষের জীবনে আশির্বাদ হয়ে আসে ! আজ কমলাকান্ত তার পাগলির জন্য সেই সুখ বয়ে নিয়ে এলো বাঁশীর সুরে ! একসময় বুকের শ্বাসে টান লাগলো, তবুও কি অদ্ভুত কারনে বাঁশী থামলো না ! এ যেন মায়াবতী এক রাতের বাসর ! বুকে নিয়ে সুখে কান্না শক্ত হয়ে শুধু ভালোবাসার সুর তুলে গেলো দমের খেলায় ! চারিদিকে আলোয় আলোয় যখন বিধাতা হাসে, তখনই এমন প্রেমের জন্ম হয় ! একসময় কমলাকান্তের কানের কাছে ভেঁজা ঠোঁট নিয়ে লক্ষি ভাঙা গলায় রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে বললো,
" সখা তুমি বড় নিঠুর গো,তুমি বড় নিঠুর ! দিঘী জলে আমার সুখ দেখলা,দুঃখ দেখলা না ! মরণের চাইতেও মরণ দিয়া আমারে করলা পরবাসিনী !
কেমনে পারো তুমি,আমারে ছাড়া বাঁচতে,কেমনে???"
কমলাকান্ত চুপ করে আলোয় মাখা তার পাগলির মুখ দিকে তাকিয়ে থাকে শুধু ! কিছু বলতে গেলে হয়তো অধিকার থাকতে হয়,মেয়েটার জন্য কমলাকান্তের আজ সেই অধিকারটা কিনতে খুব ইচ্ছে করছে ! কিছু পূন্য হলে হয়তো লক্ষির নারায়ণ হয়ে জন্ম নেয়া যাবে পরের জন্মে,তাই কমলাকান্ত কিছু না বলে আবার বাঁশীর ঠোঁটে ঠোঁট রাখে ! মেয়েটা আজ অদ্ভুত হয়ে জোছনা না দেখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো তার রাখালরাজার মুখে ! যে পুরুষ মনে সুর পুষতে জানে,নারী কেবল তার জন্যই জোছনায় সাজতে পারে ! দুটো আরশি মনের মানুষের চোখের জলে ভেসে যায় ঈশ্বরের প্রিয় ধরিত্রী জোছনা রাতের বিলাসকানন ! প্রেয়সীর চোখে চোখ রেখে আজও রাখালরাজার নষ্ট পুরুষ হওয়া হয়ে ওঠে না ! শরীর যে বড় ঠুনকো মনের শামিয়ানায় !