জীবন দিশা
জীবন দিশা
হসপিটালের বেডে বসে রুশ, ভীষন কান্না পাচ্ছে ওর। এমনটা হওয়ার থেকে বোধহয় মরে গেলেই ভালো হতো! বৃষ্টিটা এলো বলে রক্ষা নয়তো সৌজন্য বিনিময় করতে আসা হিতাকাঙ্খীদের সহানুভূতির চাপে পিষে যাচ্ছিল সে।
দুম করে একটা বাজ পড়লো কোথাও...
“এদিকে এসো জ্যেঠু ।”
বাজের শব্দের পাশাপাশি কেবিনের ভেতর অপরিচিত গলার আওয়াজে চমকে উঠলো রুশ। তাকিয়ে দেখলো আদুল গায়ে ধুতি পরিহিত এক দোহারা চেহারার লোক এসে বসেছেন ওর পাশের বেডটায়, কিন্তু তার সঙ্গীকে দেখে বিষম খেল ও। এ কেমন পোশাক! মাথায় হ্যাট, গায়ে এমন অদ্ভুত শার্ট আর পায়ে গামবুট! আচ্ছা এরকম পোশাক সে কোথায় যেন দেখেছে না!
“তোমাকে বলেছিলাম না জ্যেঠু অপু বাচ্চা ছেলে সে অতগুলো ফুচকা খেলো খাক কিন্তু তুমি এই বুড়ো বয়েসে ষাটটা ফুচকা কেন খেতে গেলে?”
“ষাট নয় পঞ্চাশ।”
“ওই একই হলো।”
“আহা অমন বড় বড় সাইজ, বেশ করে লঙ্কা দিয়ে মাখা পুর আর অমন চমৎকার তেঁতুল জল পেলে লোভ সামলানো যায় নাকি?আহ! এখনো জিভে জল আসছে।”
“থাক আর জিভে জল আনতে হবে না তোমায়!”
“আরে খোকা, তোমার কি অসুখ করেছে?”
এতক্ষণে বয়স্ক লোকটির নজর পড়েছে রুশের দিকে। 'খোকা' সম্বোধনটা মোটেও পছন্দ হলো না রুশের, সে এখন যথেষ্ট বড়। সব ঠিকঠাক চললে এখন সে বসে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতো কিন্তু…
ক্ষীণ গলায় রুশ উত্তর দিলো, “লিভারে সিস্ট।”
“আহারে এইটুকু বয়েসে এমন ভয়ানক রোগ! তা খোকা, তোমার কি মন খারাপ?”
“না তো।”
“আহা বলোই না, তোমাকে দেখেই বুঝেছি মন খারাপ।”
“নাথিং, এমনি বোর লাগছে।”
“উঁহু কিছু একটা ব্যাপার নিশ্চয় আছে, চটপট বলে ফেল দিকি।”
“কিছু না।”
এবার সেই অদ্ভুত পোশাক পরা ছেলেটা বললো, “আরে বলোই না, ভাগ নিলে মন খারাপ কমে যায় বুঝলে?”
“কি শুনবেন? আমার লাইফটা স্পয়েল হয়ে যাওয়ার গল্প?” আচমকাই উত্তেজিত হয়ে উঠলো রুশ।
“আচ্ছা বলো, তাই শুনি।”
“অদ্ভুত লোক তো আপনি!”
“হেঁ হেঁ! তা একটু অদ্ভুত আছি বটে আমরা। যাইহোক এবার চটপট বলে ফেলো তোমার মন খারাপ কেন?”
“উফফ না বললে ছাড়বেন না দেখছি!”
“একদম ঠিক।”
“শুনুন তাহলে, আমার সব ফ্রেন্ডরা এখন বসে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে আর আমি… সবাই এগিয়ে কত এগিয়ে গেলো। সবাই কদিন পরে ইলেভেনে পড়বে আর আমি…! আমার লাইফটাই শেষ হয়ে গেল। ক্যান ইউ ইমাজিন?”
রুশের কথা শেষ হওয়া মাত্রই লোকটা আর ছেলেটা দুজনেই ওর দিকে এমন দৃষ্টি নিয়ে তাকালো যেন ও হিব্রু ভাষায় কথা বলছে।
“বলছি ভাই পরের বছর কি আর মাধ্যমিক হবে না?”
“হবে না কেন! কিন্তু…”
“তাহলে এতে এতো ভেঙে পড়ার কি আছে! খারাপ ভালো নিয়েই তো জীবন। আমরা এক জীবনেই কতগুলো জীবন বে
ঁচে থাকি জানো? এই যে তুমি এখন অসুস্থ, এর পরে যখন সুস্থ হয়ে এই হসপিটালের কামরা থেকে বাইরে বেরোবে তখন আবার একটা নতুন জীবন শুরু হবে তোমার। আগের থেকে মানসিক ভাবে অনেক বেশি দৃঢ়, অনেক বেশি সাহসী। যে বন্ধুরা ক্লাসে এগিয়ে যাচ্ছে তাদের যেতে দাও। কিন্তু কখনও এটা ভেবে দেখেছো কি যে লড়াইটা এখন তুমি লড়ছো তা তোমাকে অনেক আগেই ওদের থেকে অনেক এগিয়ে দিয়েছে একজন মানুষ হিসেবে!”
“কিভাবে?”
“তুমি কি জানো জীবনটা আসলে একটা লড়াই। মূলত আমাদের জীবনের লড়াই শুরু হয় একটু বড় হওয়ার পর, কিন্তু অনেকের লড়াই ছোটো বয়েসেই শুরু হয়ে যায়, যেমন তোমার। এবার তুমি যখন বড় হবে তখন দেখবে তোমার মানসিক দৃঢ়তা অন্যদের তুলনায় এতো বেশি হবে যে যখন অন্যরা অল্প আঘাতে ভেঙে পড়বে, কোনো বড় আঘাতও তোমাকে আর বিচলিত করতে পারবে না। সব বাধা বিপত্তির মধ্যেও তুমি রাজার মত দাঁড়িয়ে থাকবে। তাই বলছি এখনই এভাবে ভেঙে পোড়ো না খোকা। জীবনে প্রত্যেকটা ঘটনাই আমাদের কিছু না শিক্ষা দেওয়ার জন্য ঘটে।”
“ভাই বলছি আগে সুস্থ হও দিয়ে পরের বছর ঠিক পরীক্ষা দেবে।”
“সব কিছু এতো ইজি নয়।”
“হুম, ঠিক ঠিক। আচ্ছা জানলার বাইরে ওই বৃষ্টি ফোঁটাগুলোকে দেখতে পাচ্ছ?”
“হ্যাঁ, না দেখার কি আছে?”
“দেখছো কেমন করে ওরা ঢোকার চেষ্টা করছে কিন্তু কাঁচের জন্য পারছেনা ঢুকতে, ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।”
“কোথায়! ওই তো জানালার তলা চুঁইয়ে ঢুকছে, মেঝেটায় জল জমে গেছে। নার্সকে বললাম খানিক আগে...”
“তাই? তাহলে তো এই ছোট্ট বৃষ্টি ফোঁটাগুলো অবধি লড়াই করে যাচ্ছে অনবরত, সফলও হচ্ছে; আর মানুষ হয়ে তুমি পারবে না?”
“মানে?”
“মানেটা তুমি নিজেই বোঝো, আর না বুঝতে পারলে তোমার পাশে থাকা বইটা আবার পড়ে নিও, খুব মন দিয়ে।”
অজান্তেই নিজের পাশে তাকালো রুশ, কালই বাবা দিয়ে গেছেন ওর প্রিয় বইটা, 'বিভূতিভূষণ রচনাসমগ্র'।
“আচ্ছা খোকা, আমরা চলি তাহলে!”
“চলি মানে? কোথায় যাবেন?”
“যাবো তোমার মতোই অন্য কারুর কাছে, যার দরকার আমাদের।”
ওদের মুখে ফুটে উঠলো এক রহস্যময় হাসি। রুশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“মানে! কে আপনারা?”
“আমার নাম শংকর আর উনি হাজারি জ্যেঠু, হাজারি ঠাকুর। নাম শুনেছ নাকি?”
ছেলেটার ঠোঁটে আবার সেই রহস্যময় হাসি। রুশ আরও অবাক হওয়ার আগেই কড়কড় শব্দে বাজ পড়লো সামনেই কোথাও। চমকে উঠে ক্ষণিকের জন্য জানলার দিকে তাকালো সে, তার পরমুহূর্তেই এদিকে ফিরে দেখলো গোটা রুমটা ফাঁকা, কেউ কোত্থাও নেই। কয়েক সেকেন্ড হতভম্ব হয়ে শূন্য ঘরটার দিকে তাকিয়ে থেকে বিভূতিভূষণ সমগ্রটা হাতে তুলে নিলো রুশ। তারপর পরম যত্নে পাতাগুলো ওল্টাতে থাকলো, ওর মুখে ফুটে উঠলো এক প্রশান্তির হাসি, বহুদিন বাদে। এখনও অনেক পথ চলা যে বাকি….
(শেষ)