Siddhartha Singha

Classics

2  

Siddhartha Singha

Classics

ইটালি

ইটালি

9 mins
672


স্কুলের টিফিনে হজমি আর আমচুর খেতে খেতে সুবীর বলল, রবিবার আমরা ইটালি যাচ্ছি। তুই যাবি?

চমকে উঠল বাবুই।--- ইটালি?

--- হ্যাঁ, তোর মাকে বল না, যদি ছাড়ে...

সুবীর আর বাবুই ছোটবেলা থেকেই খুব ভাল বন্ধু। একজন টিফিন নিয়ে এলে অন্য জনকে না দিয়ে কখনও খায় না। তেমনি কোনও কারণে একজন স্কুল কামাই করলে, অন্য জন বাড়ি বয়ে গিয়ে দেখিয়ে দিয়ে আসে, স্কুলে সে দিন কী পড়ানো হয়েছে। ওদের এই বন্ধুত্বের কথা যেমন স্কুলের সবাই জানে, তেমনি জানে ওদের দু'জনের বাবা-মাও। তাই ওদের ঘিরে দু'পরিবারের মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্কও তৈরি হয়ে গিয়েছে। সম্পর্কটা এতটাই গভীর যে, বাইরের কেউ দেখলে বলবে না ওরা বন্ধু, ভাববে দুই ভাই। বাবুইয়ের ঢাকুরিয়ার মামাবাড়িতে গিয়ে সুবীর যে কত দিন থেকে এসেছে হিসেব নেই। আবার পুজোর ছুটিছাটায় সুবীরদের আত্মীয়দের বাড়ি গিয়েও থেকে এসেছে বাবুই। তবু বলল, ইটালি! সে তো বহু দূর। অনেক খরচ।

--- সে তোকে ভাবতে হবে না। আমার বাবা দিয়ে দেবে। তুই যাবি কি না বল।

সুবীররা বড়লোক। মাঝে মাঝে ইটালি যায়। সেখানে ওর মাসির বাড়ি। ফিরে এসে কত গল্প করে। বাবুই কত বার ভেবেছে, আহা, তারও যদি এ রকম একটা মাসি থাকত!

বাবুই আর সুবীর ক্লাস সিক্সে পড়ে। ওদের স্কুলের আরও অনেক বন্ধুবান্ধবদের মতো ওরাও ডাকটিকেট জমায়। একই টিকিট দুটো বা তিনটে হয়ে গেলে, ওটা দিয়ে, যেটা ওর কাছে নেই সেটা এক্সচেঞ্জ করে নেয়। মালয়েশিয়া যেমন ওর প্রিয় দেশ, তেমনই প্রিয় ইটালি। সেই ইটালিতে ওর বন্ধু ওকে নিয়ে যেতে চাইছে, ভাবা যায়! মাকে তো রাজি করাতেই হবে। বাবাকেও। এমন সুযোগ কি বারবার আসে!

বাবুই বাড়ি গিয়ে ওর মাকে বলল। ওর মা বলল, ইটালি? সে তো প্লেনে করে যেতে হয়। তোকে ওরা নিয়ে যাবে বলেছে? 

--- হ্যাঁ মা, সুবীর বলেছে ওর বাবাই সব খরচখরচা করে নিয়ে যাবে।

--- তাই নাকি? দাঁড়া দাঁড়া, তোর বাবা আসুক।

বাবুই মনে মনে মা কালীকে ডাকছে, বাবা যেন কোনও আপত্তি না করে। প্রথম চোটেই যেন রাজি হয়ে যায়। বাবা যদি রাজি হয়ে যায়, আমি তোমাকে পুরো পাঁচ টাকা দিয়ে পুজো দেব মা।

বাবা আসার পরে ওর মা যে ওর বাবাকে কী বলেছে, বাবুই জানে না। ওর বাবা শুধু বলল, রবিবার? সে তো এখনও অনেক দেরি। আমি সুবীরের বাবার সঙ্গে কথা বলবখ'ন।

সুবীররা থাকে একই এলাকায়। ওদের বাড়ি থেকে হাঁটা পথে মাত্র দশ-বারো মিনিটের রাস্তা।

বাবুইয়ের রাতে ঘুম নেই। বাবা কখন সুবীরদের বাড়ি যাবে। সকালে উঠে এক কাপ চা খেয়েই তো বাবা বাজারে ছোটে। সেখান থেকে এসেই রান্নাঘরে ব্যাগটাকে কোনও রকমে ফেলে দিয়েই কলতলায় ঢুকে যায়। কোনও রকমে কাকস্নান সেরে গরম ভাত ফু ফু করে ঠান্ডা করে আর মুখে পোরে।

তার পরেই সোজা হাঁটা। ফিরতে ফিরতে সেই সন্ধে। এসেই লাইব্রেরিতে চলে যায়। কলেজে পড়ার সময় বাবারা ক'বন্ধু মিলে নাকি ওটা গড়ে তুলেছিল। তখনও ঘরে ঘরে সে ভাবে টিভি আসেনি। বাবা ছিল বইয়ের পোকা। এক সময় নাকি একসঙ্গে পাঁচটা লাইব্রেরির সদস্য ছিল। দিনে দু'-তিনটে করে বই শেষ করে ফেলত। এখনও সে অভ্যাস যায়নি। রোজই নিত্য-নতুন বই নিয়ে আসে। এত পড়ে যে কী লাভ হয়, কে জানে! বাবা যাবে কখন!

প্রথম দিন কেটে গেল। দ্বিতীয় দিনও কেটে গেল। রবিবার আসতে মাঝে আর মাত্র একটা দিন। কিছু কেনাকাটি করতে হবে না? বিদেশ-বিভুঁই বলে কথা!

বাবা তখন বই পড়ছে। বাবুল গিয়ে বলল, বাবা, তুমি সুবীরদের বাড়ি যাবে না?

বাবা বলল, না।

মুখ ভার হয়ে গেল বাবুইয়ের। এত বড় একটা সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে! জীবনে কখনও প্লেনে চড়েনি ও। ভেবেছিল, যাক্, এত দিনে তা হলে ওর একটা স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। সেখানে কিনা ওর বাবা জল ঢেলে দিল!

বাবুই মনে মনে মা কালী কে স্মরণ করল। লোকনাথ বাবাকে ডাকল। মা দুর্গাকে বলল, আমি তোমাদের পাঁচ টাকা নয়, পুরো এগারো টাকা করে আলাদা আলাদা পুজো দেব, বাবার মনটা একটু ঘুরিয়ে দাও। সুবীরদের বাড়ি পাঠিয়ে দাও। বাবা গিয়ে জেঠুর সঙ্গে একটু কথা বলে আসুক। বাবার তো কোনও পয়সা লাগছে না। সুবীর তো বলেছে, ওর বাবাই যাতায়াতের সব খরচখরচা করে আমাকে নিয়ে যাবে। তা হলে আমাকে পাঠাতে অসুবিধে কোথায়? 

বাবুইয়ের মা চা দিয়ে গেল ওর বাবাকে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে ওর বাবা বলল, আজ সকালেই সুবীরের বাবার সঙ্গে আমার বাজারে দেখা হয়েছিল। কথা হয়েছে। রবিবার খুব সকালে ওরা যাচ্ছে। ওকে আটটার মধ্যে রেডি থাকতে বলেছে।

বাবুই তো একদম থ'। এত বড় একটা খবর বাবা তাকে না জানিয়েই বসে আছে! আজ তো শুক্রবার, কাল শনি! তার পরেই সোজা ইটালি!

ওদের স্কুল এগারোটা থেকে। বাবুই সে দিন ঢুকে গেল সাড়ে দশটার মধ্যে। সুবীরকে ওর এক্ষুনি চাই।

ক্লাস শুরু হয়ে গেছে বহুক্ষণ। স্যার ওদের গ্রামার বোঝাচ্ছেন। কিন্তু বাবুইয়ের সে দিকে হুঁশ নেই। একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে সুবীরকে। --- কাল ঠিক কখন আমাকে নিতে আসবে বল তো?

--- বাবা তো বলল, আটটা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা তোদের বাড়ি যাব। সেখান থেকে তোকে নিয়ে আমরা রওনা দেব।

বাবুই জানে প্লেনে করে যেতে হয়, তবু বলল, আমরা কীসে করে যাব?

--- কেন? বাসে।

--- বাস! তার পর নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলল, বাস, না এয়ার বাস! অবশ্য এ রকমই হয়। সে বার পুজোর ছুটিতে বাবুইরা শিলিগুড়ি যাচ্ছিল। তখন টু কি থ্রি-তে পড়ে। বাবা-মায়ের কাছে ও শুনেছিল, ওরা রকেটে করে যাবে। শুনে সে কী আনন্দ ওর! রকেটে! যে রকেটকে ও এত দিন শুধু আকাশেই দেখেছে ধুয়োর রেখা ছেড়ে চলে যেতে, সেই রকেটে! ওরা যখন রকেটে করে সাদা তুলো-তুলো মেঘ ভেদ করে শূন্যে মিলিয়ে যাবে, ও যেমন আকাশে রকেট দেখলে হাঁ করে উপরে তাকিয়ে থাকে, তেমনি ওদের রকেটটাকে দেখেও নিশ্চয়ই আরও অনেকে হাঁ করে দেখবে! আর ভাবতে পারছিল না ও। প্লেনে তো অনেকেই চড়ে, কিন্তু রকেটে!

পর দিন রাতে যখন বাবা-মায়ের সঙ্গে ও ধর্মতলা পৌঁছল, ও একেবারে অবাক। রকেট কোথায়! এখানে তো শুধু বাস, বাস আর বাস।

মাকে সে কথা বলতেই লটবহর সামলাতে সামলাতে গলদঘর্ম হয়ে ওর মা বলেছিল, ওই তো রকেট, দেখতে পাচ্ছিস না?

মা যেটাকে দেখাল, সেটাকে দেখে ওর মন ভেঙে গেল। রকেট কোথায়! ওটা তো একটা বাস! একটু ভাল, এই যা। সামনে লেখা--- রকেট।

তবে কি ওরা যে প্লেনে করে যায়, তাকে ওরা বাস বলে! নাকি এয়ার বাসকে সংক্ষেপে বলে--- বাস। যেমন অ্যারোপ্লেনকে কেউ আর অ্যারোপ্লেন বলে না, বলে--- প্লেন। অটোরিকশাকে--- অটো। টেলিভিশনকে--- টিভি, সেই রকম? হ্যাঁ, হয়তো তাই-ই হবে! 

তার পরেই বুবাই জিজ্ঞেস করল, কতক্ষণ লাগবে রে?

সুবীর বলল, ঘন্টা দুয়েক।

বাবুই শুনেছিল, আগরতলা যেতেই প্লেনে লেগে যায় প্রায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট। আর ইটালি যেতে মাত্র দু' ঘন্টা! ও বুঝেছি, বেশি সময় বললে আমি যদি যেতে রাজি না হই, সে জন্য বুঝি ও দু'ঘণ্টা বলছে! তাই না! হতে পারে! আবার এমনও হতে পারে, এই প্লেনের স্পিড অন্য প্লেনের চেয়ে অনেক বেশি! তাই দশ ঘণ্টার রাস্তা অনায়াসেই দু'ঘণ্টায় যাওয়া যায়! যাই হোক, দেখা যাবে, আর তো মাত্র কয়েক ঘন্টা।

--- আচ্ছা, কী কী সঙ্গে নেব বল তো? বাবুই জিজ্ঞেস করতেই সুবীর বলল, কী আর নিবি? দুটো জামা আর দুটো প্যান্ট, ব্যস। আর কিছু নিতে হবে না। পেস্ট-টেস্ট তো আমরাই নিয়ে যাচ্ছি। দাঁত মাজার ব্রাশটা কিন্তু মনে করে নিয়ে নিস।

--- আর কিছু না! বাবুই মনে মনে হিসেব করল, তা হলে ওরা নিশ্চয়ই প্রচুর জিনিসপত্র নিচ্ছে। তাই ওকে কম জিনিস নিতে বলছে। না হলে, গামছা নেওয়ার কথা কেউ বলবে না, এটা কখনও হতে পারে!

বাবুইয়ের বাবার এক বন্ধু ক'দিন আগে প্লেনে করে গৌহাটি গিয়েছিল। ফিরে এসে গল্প করেছিল। তাতেই ও জেনেছিল, প্লেনে নাকি কাউকে কুড়ি কিলোর বেশি জিনিস নিতে দেয় না। যদি কারও বেশি হয়ে যায়, তা হলে তার জন্য আলাদা চার্জ দিতে হয়। এমনিতেই এতগুলো টাকা ভাড়া দিয়ে তাকে নিয়ে যাচ্ছে, তার উপর আবার একস্ট্রা খরচ! কিন্তু সেটা আর কত টাকা! তার বাবাকে বললে কি তার বাবা সেটা দিত না! ঠিক আছে, সুবীর যখন বলছে, তাই সই। দুটো জামা আর দুটো প্যান্টই নেব। 

শনিবার রাতেই সব গোছগাছ করে দিল বাবুইয়ের মা। সকালে রওনা। বিছানায় শুয়ে শুয়ে বাবুই ভাবতে লাগল, প্লেনে ওঠার পর কী ভাবে বেল্ট বাঁধতে হয়, এয়ারহোস্টেসরা নিশ্চয়ই তাকে দেখিয়ে দেবে। ওঠার সময় কেমন লাগে? আর নামার সময়? আচ্ছা, জানালার পাশে বসলে কি মেঘগুলোকে খুব কাছ থেকে দেখতে পাব? জানালা দিয়ে হাত বের করার উপায় থাকলে ছুঁতে পারতাম, না? আচ্ছা, নীচের বাড়িঘরগুলোকে কী রকম লাগে? খুব ছোট ছোট, না? পিঁপড়ের মতো? আমি জানালার পাশে বসব।

আচ্ছা, এয়ারপোর্ট অবধি আমরা কীসে যাব? বাসে? না উবেরে? নাকি ওলায়? ড্রাইভারের পাশে কিন্তু আমি আর সুবীর বসব। ও যদি জানালার দিকে বসতে চাই, তো বসবে! সামনে তাকালে তো সবই দেখা যাবে! অবশ্য ওর বাবা যদি সামনে বসতে চায়! আমরা তো ছোট, আমরা যদি সামনের সিটে বসার জন্য বায়না করি, উনি ওই সিটটা আমাদের ছেড়ে দেবেন না!

এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুম এসে গিয়েছিল টের পায়নি। সকালে বাবা ডাকতেই লাফ দিয়ে উঠল বাবুই। তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে নিল। একদম রেডি।

আটটা বেজে গেল। সওয়া আটটা। সাড়ে আটটা। বাবুইয়ের আর সময় কাটছে না। ছটফট করছে। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে দেখছে। কখনও এক লাফে দরজার কাছে গিয়ে দেখছে, ওদের আসছে কি না...

হঠাৎ দেখে সুবীর আসছে। পিছনে ওর বাবা আর মা। মায়ের কাঁধে একটা ঝোলানো ব্যাগ। আর বাবার হাতে একটা মাঝারি মাপের ট্রাভেল ব্যাগ। তিন জন লোকের মাত্র ওই দুটো ব্যাগ! এটা জানলে তো ও আরও দু'-একটা ভাল ভাল জামা-প্যান্ট নিয়ে নিতে পারত, না কি?

রাস্তার মোড় পর্যন্ত বাবুইকে এগিয়ে দিতে এল বাবুইয়ের মা। বারবার করে বলে দিল, একদম দুষ্টুমি করবি না। সব সময় সুবীরের সঙ্গে সঙ্গে থাকবি। জেঠু-জেঠিমা যা বলবেন, সব শুনবি, কেমন?

মায়ের কথা তখন আর ওর কানে ঢুকছে না। ও আশপাশে তাকাচ্ছে। ওলা কোথায়! উবের কোথায়! নিদেনপক্ষে একটা লড়ঝড়ে ট্যাক্সি! না, ও সব কিছু নয়, বেশ কিছুটা হেঁটে এসে ওরা দাঁড়াল আলিপুর স্টেট ব্যাঙ্কের মোড়ে। একটু এগোলেই মোমিনপুর। এখান দিয়ে প্রচুর বাস যায়।

তা হলে কি বাসে করেই এয়ারপোর্ট যাব! যা ইচ্ছে। ওরা যে ভাবে নিয়ে যাবে, আমাকে তো সে ভাবেই যেতে হবে, না কি? অবশ্য এর আগেও ও অনেককে বলতে শুনেছে, বাইপাস দিয়ে ট্যাক্সি করে যাওয়ার কোনও মানেই হয় না। শুধু শুধু টাকার শ্রাদ্ধ।

রাসবিহারী মোড় থেকে ট্যাক্সি করে এয়ারপোর্টে যেতে কত টাকা লাগে জানো? আর যে প্রাইভেট কারগুলো সার্টেলে যায়, তাতে উঠলে তো যে যেমন পারে, পাঞ্চাশ-একশো-দুটো, এমনকী লোক বুঝে তারও বেশি চেয়ে বসে। সিটিসি বা অন্য যে কোনও এসি বাসে উঠলে ওই দশ-বিশ টাকার এ দিক-ও দিক। অথচ সময় লাগে প্রায় একই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা বাস এসে দাঁড়াল। এস ডি টোয়েন্টি টু। লাক্সারি বাস। তাতে উঠে পড়ল ওরা। রবিবারের বাজার। বাসটা একদম ফাঁকা। হাতে গোনা মাত্র গুটিকতক লোক। একটা সিটে বসল সুবীরের বাবা-মা আর তাদের পিছনের সিটে সুবীর আর বাবুই।

দু'জনে বসেই আগড়ুম বাগড়ুম নানা গল্প জুড়ে দিল। কিন্তু ভুল করেও বাবুই ইটালির কথা তুলল না। সুবীর দু'-একবার বলতে গিয়েছিল, বাবুই অন্য প্রসঙ্গ তুলে সেটাকে ধামাচাপা দিয়ে দিয়েছে, কখনওবা জানালার দিকে মুখ করে রাস্তার সাইনবোর্ড দেখতে দেখতে বলেছে, দ্যাখ দ্যাখ, জায়গাটার নাম কী সুন্দর--- রসপুঞ্জ। কখনও আবার বাস খালি করে প্রায় সবাইকে হুড়মুড় করে নেমে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করেছে, এখানেই শেষ নাকি রে, সব লোক নেমে যাচ্ছে?

তার জবাবে সুবীর বলেছেন, আরে না না, এটা তো বড়কাছারি। খুব জাগ্রত। চৈত্র মাসের সংক্রান্তির সময় এখানে বিশাল মেলা হয়। টানা তিন দিন ধরে চলে। যা ভিড় হয় না! ভাবতে পারবি না। লক্ষ লক্ষ লোক হয়। সারা রাত ধরে শিবের মাথায় জল ঢালে। এখান থেকে জয়রামপুর তো একটুখানি। সেখানে তো আরও বড় মেলা হয়। যারা এখানে আসে, তারা আবার ওখানেও যায়। এক ঢিলে দুই পাখি মারে। আমরা কত বার এসেছি...

সুবীরের কথা তখন আর ওর কানে ঢুকছে না। শুধু দু'চোখ ভরে দেখে নিচ্ছে হুসহাস করে বেরিয়ে যাওয়া সার সার টবে চারাগাছের সারি। যেন একের পর এক বাগান।

বাবুই জিজ্ঞেস করল, এখানে সব বাড়িতেই বাগান বাগান রে?

বাবুইয়ের প্রশ্ন শুনে হো হো করে হেসে উঠল সুবীর। বলল, না রে, বাগান নয়। ওগুলো সব নার্সারি। এখান থেকেই তো সব গাছ বড় বড় জায়গায় সাপ্লাই হয়...

কথায় কথায় যে কতক্ষণ কেটে গেছে ওরা জানে না। সুবীরের বাবা ওদের ডাকতেই ঝটপট করে উঠে বসল ওরা। বাস থামতেই চার জন পর পর নামল। কিন্তু এ কী! এ তো ধু ধু মাঠ। চার দিকে ফাঁকা ফাঁকা। মাঝখান দিয়ে শুধু বেরিয়ে গেছে পিচের এই রাস্তাটা। মাঝেমধ্যে ছুটে যাচ্ছে অটো, ট্রেকার, ম্যাজিক। হুসহাস করে চলে যাচ্ছে মোটরবাইক আর ম্যাটাডর। কিন্তু এখান থেকে এয়ারপোর্টটা আর কত দূর! মনের মধ্যে প্রশ্নটা উঁকি মারলেও বাবুই কাউকেই কিছু বলল না। ওদের সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা পেরিয়ে ও পারে গিয়ে একটা ভ্যানপিকশায় উঠে পড়ল। সুবীরের বাবা চালকের উদ্দেশ্যে বলল, ইতালি যাব, ইটালি। 

ইটালি! ভ্যানরিকশায় করে ইটালি!

সুবীরের সঙ্গে বাবুই সে বার সত্যি সত্যিই ইটালি গিয়েছিল। তবে ইটালি বলতে আমরা যে ইটালি বুঝি, সে ইটালি নয়। ওই ইটালি যেতে পাসপোর্ট লাগে। আর এই ইটালি হল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার একটা গ্রাম। ইট আর টালির জন্য এক সময় খুব নামডাক ছিল। তার থেকেই নাম হয়েছিল ইট-টালির গ্রাম। পরে মুখে মুখে অপভ্রংশ হয়ে--- ইটালি গ্রাম। কিন্তু এখন তো গ্রাম বলে আর কিছু নেই, তাই 'গ্রাম'টা উঠে গিয়ে ওই জায়গাটার নাম এখন শুধুই--- ইটালি।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics