Sourav Nath

Tragedy Inspirational

4.2  

Sourav Nath

Tragedy Inspirational

হরিরামের স্বপ্ন

হরিরামের স্বপ্ন

11 mins
474



   পুকুরের চার পাশের পার ভেঙ্গে একেবারে পগারের কানায় কানায় হয়ে গেছে। আর কয়েক বছর পর হয়ত পগারের সঙ্গে মিশে যাবে। কিন্তু এত-বড় পুকুরের পার বাঁধানো তো চাট্টিখানি কথা নয়। তার জন্য টাকা খরচ করতে হয় বিস্তর। এত টাকার জোগাড় করা কি এ বয়সে আর সম্ভব? কয়েকটা আম কাঁঠালের গাছের শেকড় পাড়টাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখার চেষ্টা করে চলেছে সেই বহু বছর ধরে। কিন্তু আর বোধ হয় তা সম্ভব নয়। কয়েকটা নারকেল গাছ তো আপ্রাণ চেষ্টা করে জলের মধ্যে একেবারে শুয়ে পড়েছে। তবু শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত শেকড় দিয়ে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছে বহু কষ্টে। কি আশ্চর্য লাগে এই মূক জড় পদার্থের ন্যায় গাছ গুলোর চেষ্টা দেখে। বছরের পর বছর ধরে নিঃশব্দে গাছগুলো যেন বেঁচে থাকার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ হরিরাম ভট্টাচার্য যেন অতি সহজেই হাল ছেড়ে কিংকর্তব্য বিমুঢ় হয়ে পুকুরের পাড়ে ঠাকুরদার বাঁধানো ভগ্নপ্রায় ঘাটের সিঁড়ির চাতালে বসে আছেন জীবনের শেষ মূহুর্তের অপেক্ষায়। বয়স যে খুব একটা বেশি হয়েছে এমনটা একেবারেই নয়। কত আর হবে? এই পঞ্চান্ন কি ছাপ্পান্ন বোধ হয়। তবুও তাঁকে দেখলে মনে হয় যেন সত্তরের দোরগোড়ায় তাঁর বয়স হবে হয়ত। আপন জন বলতে এ দুনিয়ায় তাঁর কেউই প্রায় নেই। আছে এক ভাইপো। দাদা শখ করে নাম রেখেছিল বিদেশ। সে এখন বোধ হয় আমেরিকা না ইংল্যান্ডে থাকে। ওসব দেশ বিদেশের ভারি ভারি নাম হরিরামের মুখস্থ থাকে না। তার কাছে আমেরিকা কি আর ইংল্যান্ডই বা কি - সবই এক। হরিরাম বাবু শুনেছেন ছেলেটা নাকি আজকাল লেখালেখি করে আর আর্ট ফিল্ম তৈরি করে। হরিরাম বাবু এও শুনেছেন বিদেশে নাকি তার খুব নাম ডাক। বহুবছর হল তার কোন খবর নেই। সেই দাদা মারা যাবার সময় ভাইপো একবার এসেছিল শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে। সে প্রায় বছর দশেক হয়ে গেল। তার পর থেকে আর কোন খবর নেই। এত বড় পৈতৃক সম্পত্তির একমাত্র ওয়ারিশ সে। সে ব্যাপারে তার কোন মাথাব্যথাই নেই। দাদা মারা যাবার পর বছর খানেক চিঠিপত্র লিখত। তারপর বোধ হয় কাজের চাপ বেড়ে যাবার কারণেই সে সব বন্ধ হয়ে গেল। এখন আপন বলতে হরিরাম বাবুর বহু বছরের পুরাতন ভৃত্য মহাদেব আছে। মহাদেবের বাবা রাম সিং ছিল হরিরাম ভট্টাচার্যের বাবার দেহ রক্ষী। এদের রক্তে বোধ হয় প্রভুভক্তি আছে। সেই কারণেই মহাদেব এখনও পর্যন্ত হরিরাম ভট্টাচার্যের সহচর হিসেবে রয়ে গেছে। মহাদেবকে মাইনে দেবার মত সামর্থ্য হরিরাম ভট্টাচার্যের নেই। তবুও মহাদেব এখনও হরিরামকে অকৃত্রিম ভক্তি করে। হরিরামের রান্না করা, কাপড় কাচা বাজার করা সমস্ত কাজই মহাদেব করে। ছেলেবেলায় হরিরাম মহাদেবের সঙ্গে খেলাধুলা করে বড় হয়েছে। তাই দুজনে বন্ধুর মতই মেশে। তা সত্ত্বেও মহাদেবের ভাব ভঙ্গি এবং আচার ব্যবহারে প্রভু ভক্তির ছাপ স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। 

   প্রথম স্ত্রী বিয়ের তিন মাসের মধ্যে কলেরায় মারা যাবার পর হরিরাম দ্বিতীয় বার বিয়ে করলেন। কিন্তু সে সংসারও তাঁর বেশিদিন টিকল না। দ্বিতীয় পক্ষের বৌ সাতমাসের গর্ভাবস্থায় চৌকাঠে হোঁচট লেগে সেই যে পড়ল আর উঠল না। তার পর হরিরাম আর বিয়ে করলেন না। সংসার যে তাঁর কপালে নেই সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত হলেন। সংসার যখন নেই, তখন আর কাজ কর্মে কি লাভ। বাপ ঠাকুরদার জমানো যা আছে, তাই দিয়েই তাঁর একলার জীবন দিব্য কেটে যাবে। আর সঙ্গী বলতে মহাদেব তো রইল সঙ্গে। একলা মানুষের জীবনে আর কতটুকুই বা প্রয়োজন। হরিরামের মৃত্যুর পর এই বিষয় সম্পত্তির কি হবে সে কথা তিনি ভাবেন না। অন্ধের কি বা দিন কি বা রাত। সংসার সম্পর্কে তিনি অন্ধ। শুধু চোখ দুটো খোলা আছে বলে বোধ হয় তিনি বেঁচে আছেন। যেদিন সে দুটো একেবারে বুজবে, তখন না হয় বিষয় সম্পত্তির ব্যাপার যার বোঝার কথা সে নিজেই বুঝে নেবে।

    সকাল থেকেই ঝির ঝির করে বৃষ্টি পরছিল। পুকুরের পার, বাগানের গাছ, মাটি ভেজা ভেজা হয়ে রয়েছে এখনও। সন্ধ্যের সময় মশাদের উৎপাত বেড়ে যায়। হরিরাম আর শান্তিতে বসতে পারেন না। ঘাট ছেড়ে বাড়ির সদর দরজার দিকে পা বাড়ালেন। সেকালের মস্ত বড় বাড়ি। চারিদিকে ইয়া মোটা ইটের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। জায়গায় জায়গায় আগাছা জন্মেছে। একটি দরজা গেছে রাস্তার দিকে আর অপরটি বাগানের দিকে। হরিরাম বাগানের দিকের সদর দরজা দিয়ে উঠোনে ঢুকে দেখলেন তখনও পর্যন্ত সন্ধ্যের বাতি জ্বলেনি। 

   গ্রামে ইলেকট্রিক এসে পৌঁছালেও হরিরাম কানেকশন নেননি। সেকালের হ্যারিকেন আর লন্ঠনের আলোতেই হরিরাম বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এখনকার মডার্ন ফ্যাশনের কোন কিছুই যেন তাঁর ভাল লাগে না। সকালে শিশির ভেজা ঘাসের উপর তন্দ্রাচ্ছন্ন মাটির বুক চিরে উঠে আসা শীতল স্পর্শের মধ্যে পা রাখলে হরিরামের প্রাণটা যেন জুরিয়ে জায়। কচি ডালের উপর দোল খেতে খেতে যখন দোয়েল পাখি শিস দিয়ে ওঠে, হরিরামের মুখে তাঁর অজান্তেই যেন হাসির রেখা ফুটে ওঠে। চোখের উপর হাতটাকে আড়াল করে গাছের ডালে ডালে তিনি দোয়েল পাখিটাকে খুঁজে বেড়ান। কত বছর যে হল তিনি ঘর ছেড়ে বাইরে বের হন নি তার কোন হিসেব নেই। বাপ ঠাকুরদার পুরাতন বাড়ি আর পুকুরের পারে বিরাট বাগান - এই তাঁর দুনিয়া। বাইরের জগতের কোন খবরই তিনি রাখেন না। ওসব খবর রেখে লাভই বা কি? কে নেতা হল, কে বা মন্ত্রী হল, কার বিয়ে হল, কার বা শ্রাদ্ধ হল - এসব খবরে হরিরামের কিছুই আসে জায় না। দু বেলা দু মুঠো খাওয়া আর নিজের মত করে বাঁচা - এই নিয়ে হরিরাম বেশ সুখেই আছেন।  

   কিন্তু মহাদেব যে কেন এখনও পর্যন্ত সাঁঝের বাতি জ্বালেনি কে জানে। হরিরাম মহাদেবকে হাঁক দিয়ে ডাকলেন, 'মহাদেব, সন্ধ্যে তো হয়ে গেল, এখনও বাতি জ্বালিসনি কেন?' মহাদেব হ্যারিকেনের সলতেতে আগুন দিতে দিতে বলল, 'এই যে বাবু, জ্বালছি। একটু দেরি হয়ে গেল।' হরিরাম ঘরের চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিলেন। সন্ধ্যে বেলাকার অন্ধকারের গা ছমছমে পরিবেশ তাঁর বড় ভালো লাগে। সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত বিভিন্ন অনুভূতি হরিরামের মনের মধ্যে কাজ করে। কিন্তু হরিরামের মুখ দেখে সে সব কথা বোঝার উপায় নেই। তিনি মনে মনেই এক একটা মুহূর্তকে এক এক রকম ভাবে অনুভব করেন। এক কথায় বলতে গেলে তিনি যেন এই সমস্ত অনুভূতির মধ্যেই বেঁচে থাকেন।

   বেতের আরাম কেদারার উপর শরীরটাকে ছড়িয়ে দিয়ে হরিরাম মহাদেবকে বললেন, 'জানিস মহাদেব, কাল রাতে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি। সারাদিন শুধু ভাবছি স্বপ্নটার অর্থ কি।' মহাদেব বেশ আগ্রহ ভরেই চেয়ারের নিচে মেঝেতে উবু হয়ে বসে হরিরামের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। মহাদেবের চোখটা হ্যারিকেনের লাল আলোয় নিশাচর প্রাণীর মত জ্বল জ্বল করছে। হরিরাম সেই জ্বলজ্বলে চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'স্বপ্নে দেখলাম একটি মেয়েকে। বয়স খুব একটা বেশি হবে না। বছর দশেক হবে হয়তো। কেমন দেবী দুর্গার মত মুখ খানা। টানা টানা চোখ। হাতে সাদা রঙের কাশ ফুল। পরনে লাল তাঁতের শাড়ী আর কপালে সিঁদুরের লাল টিপ। আমার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে ডাকছে আর হাসছে।' বলতে বলতে হরিরাম চুপ করে গেলেন। মহাদেবের আগ্রহ ভরা জ্বলজ্বলে চোখ যেন আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঘটনার শেষটুকু জানার জন্য তার মন বড় উতলা হয়ে উঠল। সে সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল, 'তারপর?' হরিরাম হটাত আরাম কেদারা ছেড়ে উঠে পড়লেন। তারপর ঘরের মধ্যেই পায়চারি করতে করতে বললেন, 'তারপর হটাত ঘুম ভেঙ্গে গেল। আর ঘুম এলো না।'

   হরিরাম লক্ষ করলেন, মাঝপথে স্বপ্ন ভঙ্গের কথা শুনে মহাদেবের চোখের চকচকে ভাবটা যেন কেমন হারিয়ে গেল। মহাদেব নিঃশব্দে উঠে পড়ে রাত্রের রান্নার জোগাড় করতে গেল। হরিরামের মাথার মধ্যে স্বপ্নের আসল অর্থ যে কি, সেই ভাবনাই কেবল ঘুরপাক খেতে লাগল। মহাদেব হরিরামের মনের ভাব বোধ হয় বুঝতে পারল। আঁচের উনুনে কয়লা দিতে দিতে মহাদেব বলল, 'আশ্বিন মাসের ভোর বেলায় আপনি দেবী দুর্গার স্বপ্ন দেখেছেন। সেটা কি কম কথা? এমন সৌভাগ্য আর কজনের হয়?' মহাদেবের কথায় হরিরামের যেন চমক ভাঙল। তিনি মহাদেবের কথা বেশ একটু মনোযোগ সহকারেই শোনবার চেষ্টা করলেন। মহাদেব বলল, 'আপনি বরং এ বছর দেবী দুর্গার পুজো করুন। মায়ের হয়ত তাই ইচ্ছে।' হরিরামের বাবা যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন বেশ জাঁকজমক সহকারেই বারিতে দেবী দুর্গার পূজা হত। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর সব বন্ধ হয়ে গেল। তবে এত বছর পরে কি মা আবার পূজা নিতে চান? হরিরামের মন মানল না কিছুতেই। 



   পরের দিন সকালে হরিরাম একটু বেশ দেরি করেই বিছানা ছেড়ে উঠলেন। সারা রাত তিনি কিছুতেই আর ঘুমোতে পারলেন না। অনেক চেষ্টা করলেন স্বপ্নটা আবার দেখতে। কিন্তু কিছুতেই আর পারলেন না। ঘর ছেড়ে হরিরাম বাইরে বারান্দায় এসে দেখলেন, বৃষ্টি তখনও ধরেনি। ঝির ঝির করে ঝরেই চলেছে। হরিরাম মহাদেবকে ডেকে বললেন, 'মহাদেব, একবার যা তো, চক্রবর্তী মশাইকে একবার চট করে ডেকে নিয়ে আয়।' মহাদেব যেন একটু অপ্রস্তুতে পরে গেল। সবে মাত্র সকালের প্রাতরাশের আয়োজন করছিল। এমন অবস্থায় হটাত প্রভুর এমন একটা আদেশ সে একেবারেই আশা করেনি। চক্রবর্তী মশাইয়ের বাড়ি তো আর এখানে নয়। সে প্রায় এক মাইল হবে। যেতে আসতে তো সেই দুপুর হয়ে যাবে। তবুও সে বুকে বল নিয়ে হরিরামকে একবার প্রশ্ন করল, 'এখনই যেতে হবে?' হরিরাম একটু বিরক্তির সুরেই বললেন, 'হ্যাঁ, এখনই যেতে হবে। আর দেরি করা যাবে না।' হরিরামের কথার উপর মহাদেব আর কোন কথা বলতে পারল না। অগত্যা সে ছাতা হাতে তখনই চক্রবর্তী মশাইয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। 

  প্রায় দুপুর তিনটে নাগাদ চক্রবর্তী মশাইকে সঙ্গে নিয়ে মহাদেব যখন ফিরল, তখন সে দেখল যে হরিরাম তখনও বারান্দায় পায়চারী করছেন। সকাল থেকে নাওয়া খাওয়া কিছুই হয়নি তাঁর। চক্রবর্তী মশাইকে দেখে হরিরামের যেন ধরে প্রাণ এলো। চক্রবর্তী মশাই হরিরামকে বললেন, 'কি হে হরিরাম, এত জরুরী তলব কি ব্যাপারে?' হরিরাম আর দেরি না করে তখনই সবিস্তারে তাঁর স্বপ্নের কথা বললেন। হরিরামের স্বপ্নের কথা শুনে চক্রবর্তী মশাইয়ের কপালে বেশ কয়েকটা ভাঁজ পড়ল। কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যে যেন আশ্চর্য রকমের নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে লাগল। প্রতিদিনের মত গাছের কোন একটা ডাল থেকে দোয়েল পাখি শিষ দিয়ে গান গেয়ে উঠল। কিন্তু হরিরাম সে ডাকের প্রতি কোনও ভ্রুক্ষেপও করলেন না। অন্যান্য দিন হলে তিনি এতক্ষণে দোয়েল পাখিটাকে গাছের ডালে ডালে খোঁজার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। আজ যেন হরিরামকে নিতান্তই অন্যরকম দেখাল। 

   কিছুক্ষণ পরে চক্রবর্তী মশাই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বললেন, 'বহুদিন হল ঘরে কোন পূজা অর্চনা হয় না। মায়ের ইচ্ছে এবার ধূম ধাম করে পূজা অর্চনা হোক। পূজোর তো আর বেশি বাকি নেই। মা যখন নিজে স্বপ্ন দিয়েছেন, তখন তার তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তুমি যদি আদেশ কর, তবে নাহয় আমি তড়িঘড়ি করে একটু চেষ্টা চরিত্র করে দেখতে পারি কতটা কি করা জায়। তবে দিন যখন আর বেশি বাকি নেই, তখন আর খামোকা সময় নষ্ট না করাই ভাল।' চক্রবর্তী মশায়ের কথায় মহাদেবের মুখেও হাসির রেখা ফুটে উঠল। চক্রবর্তী মশাই বোধ হয় মহাদেবের মনের কথা বলে ফেলেছেন। কতদিন হল এ বাড়িতে কোন আমোদ আহ্লাদ হয় না। সেই এক ঘেয়ে জীবন। এবার হয়তো মা নিত্যদিনের রুটিনে একটু রদ বদল করার জন্যই হরিরামকে স্বপ্ন দিয়েছেন।চক্রবর্তী মশাইয়ের পরামর্শে হরিরামের কপালেও ভাঁজ পড়ল। মায়ের পূজো নিতে ইচ্ছে হয়েছে, সে না হয় ভাল কথা। কিন্তু দুর্গা পূজো তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। এ বয়সে এত ধকল নেওয়া কি সম্ভব? কিন্তু মায়ের আদেশ, তাকে কি অবমাননা করা চলে? হরিরাম মহাদেবের চোখের দিকে তাকালেন। মহাদেব হরিরামের ক্ষণিকের চাহনিতে বুঝল তাঁর মনিবের মনের কথা। সে আর কাল বিলম্ব না করে বলল, 'দাদাবাবুকে একটা খবর দিলে হয় না?' মহাদেবের কথা হরিরামের মনে ধরল। সে কথা তো তিনি একেবারে ভুলেই গেছেন। তৎক্ষণাৎ তিনি মহাদেবকে বিদেশকে খবর দেবার জন্য বললেন আর পূজোর জোগারজাতির জন্য তিনি চক্রবর্তী মশাইকে সমস্ত দায়িত্ব দিলেন।  

   কিন্তু বিদেশ বাবু যে দেশ বিদেশের কোথায় আছে সে কথা হরিরামের জানা নেই। পুরাতন বাক্স প্যাটরা খুঁজে বিদেশের পাঠানো চিঠির খাম উলটে পালটে যে ঠিকানাটা হরিরাম খুঁজে পেলেন, সেখানেই একটা আর্জেন্ট টেলিগ্রাম করে ফেললেন। ফলের আশা তিনি মা দুর্গার হাতেই ছেড়ে দিলেন। যিনি স্বপ্নাদেশ দিয়েছেন, চিঠি পৌঁছোবার দায়িত্বও তাঁর, হরিরাম তো নিমিত্ত মাত্র। বাপ ঠাকুরদার পুরাতন ভিটেতে আবার আনন্দের বন্যা বইবে, আলোর রোশনাই ছুটবে, সকলে মিলে হৈ হৈ করবে, সুগন্ধি খাবারের আমেজ ঘরের গুমোট বাতাসকে আন্দোলিত করবে - এসব কথা ভেবে হরিরামের বুকের ভিতরটা শির শির করতে লাগল। হরিরামের মনে হয় কয়েক বছর পৃথিবী হয়তো ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে থেমে গিয়েছিল। এখন আবার মা দুর্গার আহ্বানে সে বোধ হয় বন বন করে আবার ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে। বন বন করে পৃথিবী ঘুরছে আর হুস হুস করে দিনের পর দিন যেন গতিময় হয়ে কেটে চলেছে।

   বাগানের জঙ্গল সাফ করে মায়ের বেদী তৈরি হল, লাল হলুদ কাপড়ের প্যান্ডেল আর গোলাপি চাঁদোয়ার তলায় মায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হল। মা দুর্গা তার সংসার নিয়ে হরিরামের বাগানে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে রইল। ঢাকের চড়বড়ে বোলের হুঙ্কার হরিরামের বুকের ভেতর পর্যন্ত আন্দোলিত করে তুলল। সদর দরজা হাট করে গ্রামের লোকের জন্য খুলে দেওয়া হল। কচি - কাঁচা, বুড়ো, জোয়ান সকলেই হরিরামের বাগানে মায়ের পুজো দেখতে ভিড় লাগালো। চারদিন ধরে মায়ের পুজো, আর চারদিন ধরেই সকলের জন্য তিন বেলা ঢালাও ভোজের আয়োজন। এই বয়সে এত ধকল সয় না। চক্রবর্তী মশাই ষণ্ডা গোছের কয়েকজনকে ধরে সমস্ত ব্যবস্থা জাতে নির্বিঘ্নে পরিচালিত হয় তার ব্যবস্থা করেছেন, তাই রক্ষে। হরিরাম লক্ষ্য করলেন, মহাদেবটাও বেশ বুড়ো হয়েছে। আগের মত তার আর হাত চলেনা। হরিরাম নিজেই মহাদেবের সঙ্গে কাজের তত্ত্বাবধানে যোগ দিলেন। তবে ভাইপোটা যদি এই সময় কাছে থাকত তবে বোধ হয় ষোল কলা একেবারে পূর্ণ হত। তার কাছে এখনও পর্যন্ত চিঠি পৌঁছেছে কি? চিঠি পেলে সে বোধ হয় নিশ্চয়ই আসত। দেখা যাক, সবই যখন মায়ের ইচ্ছেতে হচ্ছে, তখন বাকিটুকুও তাঁরই মর্জির উপর ছেড়ে দেওয়াই ভাল। আজ তো সবে সপ্তমী, আরও তিন দিন তো সময় আছে। আর চিঠি যদি পেয়েও থাকে, আমেরিকা কি ইংল্যান্ড তো আর এখানে নয়, যে ছেলেটা ঝট করে সেখান থেকে চলে আসবে। সামান্য চক্রবর্তী মশাইয়ের বাড়ি হয়ে আসতেই দুপুর গড়িয়ে যায়, আমেরিকা কি ইংল্যান্ড থেকে আসতে না জানি কত সময়ই না লাগবে। ছেলেটাকে যদি আরও একটু আগে চিঠি পাঠানো যেত, তাহলে হয়তো সে ঠিক সময় মত আসলেও আসতে পারত। খামোকা তাকে দোষ দিয়ে তো আর লাভ নেই। 



   হরিরামের জীবনের স্তব্ধ হয়ে যাওয়া মুহূর্তগুলো এমন ভাবে তর তর করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো যেন তার জীবনের মরা স্রোতের নৌকোর তলার জলে আচমকা বানের জোয়ার ডেকেছে। কিছুতেই যেন তার জীবনের ঘুণ ধরা নৌকোর কাঠ সেই জোয়ান, তরতাজা, উন্মাদ গতি সহ্য করতে পারছেনা। মাঝে মাঝে মড়মড় করে নৌকোর পাটাতনে ফাট ধরবার মত করে তার বুকের ভেতরটা মোচড় খেতে লাগল। এত বছরের অলস হৃতপিন্ডে এত ধকল সয় না। তবুও হরিরাম মনে জোর নিয়ে জোর কদমে কাজে হাত লাগালেন। আর তো মাত্র তিন দিন। তার পরে তো আবার সেই মরচে পড়া একঘেয়ে জীবন। হরিরামের মনে হয়, এই তিনদিন যেন কখনও না কাটে। এই মুহূর্তেই যদি পৃথিবীর গতি স্তব্ধ হয় গিয়ে সব কিছু পাথরের মত থেমে যায়, তাহলে হরিরামের মত সুখী হয়ত আর কেউই হবে না। জীবনের ফটো ফ্রেমে হরিরাম এই মুহূর্তকে ধরে রাখতে চান। 

   হরিরামের মনে পড়ল তাঁর ছেলেবেলাকার কথা। এই বাগানেই দুর্গা পুজো হত। হরিরামের বাবা মালকোঁচা মেরে ধুতি পড়ে সকলের খাওয়া দাওয়া, পুজোর তোড় জোড় তত্ত্বাবধান করতেন আর তাঁর মা লাল পেড়ে আগুন ছোপা শাড়ি পড়ে কপালে সিঁদুরের ইয়া বড় টিপ পড়ে মায়ের পুজোর পরিচালনা করতেন। হরিরাম যেন নিজেকে সেই ছোট্ট অবস্থায় দেখতে পেলেন। তাঁর হাতে ক্যাপ ফাটানো বন্দুক আর তা থেকে গল গল করে সাদা বারুদের ধোঁয়া উড়ছে। গাছে সেই দোয়েল পাখিটা ডেকে ডেকে বেড়াচ্ছে। হরিরাম পাতার আড়ালে তাকে বন্দুক হাতে খুঁজছেন। 

   হরিরামের কোঁচ পড়া মুখের উপর হাসির রেখা তার মুখটা আরও বেশি করে কুঞ্চিত করে তুলতে চাইল। কয়েকটা ভাঙা দাঁতের ফাঁক দিয়ে তার বাঁধ ভাঙা হাসি যেন বন্যার স্রোতের মত ধেয়ে আসতে লাগল। তবুও কিছুতেই যেন তার আনন্দের বন্যাধারা থামতে চাইল না। যেন অফুরন্ত আবেগ তার সমস্ত শরীরকে শিহরিত করতে লাগল। আনন্দধারা যেন বমির মত তার বুক থেকে সমস্ত খোলনলচে সমেত উঠে আসতে চাইল। হরিরাম মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকলেন আর হাসতে থাকলেন। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি সেই স্বপ্নে দেখা ছোট্ট মেয়েটির মুখ কল্পনা করলেন। কি আশ্চর্য! এ যে অবিকল সেই মেয়ের মুখ। হরিরাম স্পষ্ট দেখলেন, মায়ের মৃণ্ময়ী মূর্তি যেন সজীব হয়ে উঠছে, মা যেন জীবন্ত হয়ে তাঁর দিকে হাতে কাশ ফুল নিয়ে এগিয়ে আসছেন। একি স্বপ্ন, নাকি বাস্তব! হরিরাম খিল খিল করে হাসতে থাকলেন। ধীরে ধীরে তাঁর সেই হাসি অট্টহাস্যে পরিণত হল। সকলেই হরিরামের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। হরিরামের চোখে মায়ের জীবন্ত মূর্তি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না। মেয়ে রূপী মা দরজার চৌকাঠের সামনে পর্যন্ত এসে থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। শুধু হাত নেড়ে হরিরামকে ইশারার ভঙ্গিতে ডাকলেন। হরিরাম, বুঝলেন মায়ের ডাক এসেছে, এ ডাকে সারা না দেয় এমন কার সাধ্য! হরিরাম মায়ের মুখপানে তাকিয়ে অট্টহাস্য করতে করতে 'মা' শব্দ উচ্চারণ করতে করতে মায়ের আদেশে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। চৌকাঠে তার দুর্বল বৃদ্ধ পায়ে ঠোক্কর লাগল। হরিরাম শরীরের ভারের সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পারলেন না। হুড়ুমুরিয়ে পড়লেন মায়ের আলতা রাঙ্গা চরণ যুগলের সামনে। হরিরামের বুক হতে উৎসারিত রক্তের ধারায় মায়ের চরণযুগল যেন আরও রাঙ্গা হয়ে উঠল। বাগানের ঘাসে ঘাসে, গাছের শেকড়ের ভিতর পর্যন্ত সে ধারা বোধ হয় গিয়ে পৌঁছে সমস্ত কিছুকে আলতা রাঙ্গা করে তুলল। সদর দরজা পার করে বিদেশ থেকে বিদেশ ফিরল তার দেশের মাটিতে। কিন্তু হরিরাম আর উঠলেন না। 

   গাছের ডালের গোপন কোণ থেকে দোয়েল পাখিটা কয়েকবার ডেকে উঠল। আজ আর তাকে কেউ খুঁজতেও গেল না। দোয়েলটা বুঝি এতদিনে বুঝে গেছে যে, হরিরাম তাকে রোজ খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু আজ আর তাকে কেউ খুঁজছেনা দেখে সে তার গোপন আস্তানা ছেড়ে হরিরামের মাথার সামনে এসে বসল। আজ দোয়েল হরিরামের কাছে নিজে থেকে ধরা দিতে চাইলেও হরিরাম কিন্তু আজ দোয়েলকে কিছুতেই ধরা দিলেন না। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy