Silvia Ghosh

Romance

2  

Silvia Ghosh

Romance

হৃদয়ের ঘরে ভাড়াটে চাই

হৃদয়ের ঘরে ভাড়াটে চাই

7 mins
1.3K


ফাল্গুন মাসটা শেষ হতে চলল তাও কেমন গাটা শিরশির করে চলেছে। ক'দিনের বৃষ্টিতে গাছের কচি পাতাগুলো কেমন যেন ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে গেছে , চকচক করছে ন্যাড়া, শীর্ণ গাছের ডালগুলো। এই মেঘলা দিনে পাড়ার মোড়ে খালের উপর কালভার্টের রকে বসে আড্ডা দিচ্ছে বাচ্চু, ফড়িং, গুণ্ডা, পটা, নেরু, টুটুল। বুলেট টার উপরে বসে রয়েছে পটা আর কালভার্টের উপর বসা বাকী ক'জনা। আজের আলোচনার বিষয় বস্তু পটার প্রেম। প্রেম বিষয়টা পটার কাছে বাঁয়ে হাত কা খেলের মতোন। এই বিষয়েে লোকাল আর পাঁচটা ছেলের থেকে তার অভিজ্ঞতা , ধ্যান ধারণা যে অনেক বেশি তা ক্রমশ প্রকাশ্যে আসতে চলেছে। পটা জীবনে প্রেম কে অন্য রকম একটা মর্যাদা দিয়েছে। একটি সফল প্রেম জীবনে চলার পথকে সুগম করে তোলে। অথচ সেই প্রেমেই বার বার বাঁধা আসে পটার। সে কতবার ভেবেছে যে প্রথমেই প্রেমিকা কে সব খুলে বলবে, কেন, কতটা কিভাবে তাকে ভালোবাসে এই সব আর কি। কিন্তু হায় প্রতিটি প্রেমের শুরুতেই শেষের লক্ষণ ফুটে ওঠে তার। তাকে তার বন্ধুরা আড়ালে লেঙ্গী পটা বলেই ডাকে।


পটার বয়স এই সবে আঠারো পেরিয়ে উনিশে পড়েছে। এই অল্প বয়সে সে প্রেম সম্পর্কে যে সকল অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তাতে করে এ পাড়ায় প্রথম প্রেমে পড়লে কেউ তার ধারে কাছে ঘেঁষে না। কারণ এমন সব টোটকা আর অসুখ কমার মহৌষধী তিনি বাতলাতে থাকেন যার ফলে হবু হবু প্রেম এক নিমেষে উধাও হয়ে যায়। কিন্তু এমনই কপাল কিভাবে যেন সবার আগে খবর পৌঁছে যায় পটার কাছে। তারপর থেকেই পটা সেই বন্ধুর পিছনে ছিনে জোঁকের মতোন লেগে থাকে, উপদেশ দিতে। সে কি করবে, না করবে এই প্রেমে সবটাই। যেমন ধরা যাক টুটুল প্রেমে পড়েছে ক্লাস নাইনে। টুটুলের গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে কেমন করে সময় কাটাবে বা কি ধরণের প্রেম পত্র লিখবে এ বিষয়ে লেশন দিতেই দু দিন যেতে না যেতেই গার্ল ফ্রেন্ড হাওয়া। তারপর পাড়ার রকে আবিষ্কার হলো টুটুল যে বয়ানে চিঠি লিখেছিলো তাতে ডিয়ার বা প্রিয়তমা না বলে শ্রীচরণেষু বলা হয়েছিল। যদিও গার্ল ফ্রেন্ডটি টুটুলের চেয়ে বছর তিনেকের বড় ছিলো। যাই হোক এতো গেলো টুটুলের কথা।


পটা সেই এইট থেকে পাড়ার খেঁদি, পেঁচী, মিঠু, শালিনীদের পিছনে কতবার লাইন দিয়েছে এবং প্রতিক্ষেত্রে লেঙ্গী খেয়েছে। ঐ সরস্বতী পুজো কিম্বা ভ্যালেন্টাইনস ডে এই দুটো দিনের জন্যেই পটার বাইকটা কাজে লেগেছে এ পর্যন্ত। বাকী সময় বাইকটা ভাড়া খাটে বাচ্চু, ফড়িং, নেরু, টুটুলদের জন্য। এমনও হয়েছে পাড়ার শালিনী পটার বাইকে চেপে ভ্যালেন্টাইনস ডে তে পটার দেওয়া একটা কোয়ালিটি আইসক্রিম খেতে খেতে ওর স্কুলের বি.এফ আদি মানে আদিত্যের সাথে সিনেমা দেখতে চলে গেছে মাল্টিপ্লেক্সে । পটা ভ্যাবলার মতো গোলাপটা বুক পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে আবার রওনা হয়েছে মিঠুর উদ্দেশ্যে। পটার যে কেন বারে বারে লেঙ্গী খায় তার কারণ অবশ্য রকের আর সবাই খুঁজে বের করেছে। পটার ঐ লাল শার্ট আর চাপা নীল রঙের প্যান্ট(যা কিনা প্রেমে পড়লেই পরতে হয়), তেলতেলে চুলের হঠাৎ করে ব্যাকব্রাশ করা আর সিগারেট খেয়ে বড় হবার লক্ষ্মণ গুলোই দায়ী। পটা অবশ্য যার পর নাই


এসব কারণ গুলোকে নস্যাৎ করে বলেছে ও তোরা বুঝবি না। প্রেমে পড়লে মেয়েরা এমন ছেলেদেরই ভালোবাসে। ফড়িং অনেক বুঝিয়েও পটা কে এই ধ্যান ধারণার থেকে বাইরে বের করতে পারেনি। উল্টে পটাকে বলতে শুনেছে 'দিল কখনও খালি থাকে না রে।


আজ ও আমার সাথে নেই তো কি হয়েছে অন্য কেউ তো আসতেই পারে থাকতেই পারে।'




এরপর থেকে আর কেউ পটাকে নিয়ে বেশী ঘাঁটায় না। বরং ওর আড়ালে আবডালে ওর মুরগী হওয়া নিয়ে অনেক রকম হাসি তামাশা হতে থাকে। ও আরেকটি কথা তো বলাই হলনা পটা প্রচণ্ড উত্তেজিত হলে তোতলা হয়ে যায়। এটাও যে লেঙ্গী খাওয়ার বিশেষ কারণ সে কথা কে বলবে তাকে অতএব...




বেশ কিছুদিন যাবৎ কালভার্টে চর্চা চলছে দোলাদের বাড়ির নতুন অতিথি দোলার জলপাইগুঁড়ি থেকে আসা পিসতুতো দিদি নীড়ের সম্পর্কে। দোলাদের বাড়িটা পটাদের বাড়ির রাস্তার উল্টো ফুটে। মানে দোলাদের দোতলার পড়ার ঘর আর রাস্তার ধারে পটার স্টাডি রুম মুখোমুখি। ফলে হয়েছে কি, পাড়ার ছেলে পিলেরা পটা সম্পর্কে এখন জানতে বড্ড আগ্রহী। এদিকে সবে সবে কলেজে চত্বরে পা দিয়েছেন মহা পুরুষ পটা। সেখানে নিত্য নতুন বান্ধবী হচ্ছে ঠিকই কিন্তু প্রেমিকা জোটেনি তার। আজকাল মাঝে মাঝেই সে আপন মনে বলে ওঠে 'সব শালা সুবিধাবাদী।' এদিকে দোলাদের বাড়িতে নতুন অতিথিটি বেশ অন্যরকম সে কথাটা কানে এসেছে। বাচ্চু সেদিন মেসেজ করে ছিল ঃ সময় করে একবার কালভার্টে আসিস নতুন খবর আছে।


আজ শনিবার ক্লাস কম কলেজে তায় মেঘলা ওয়েদার মোড়ে যেতেই মন চাইলো পটার। সেখানে গিয়ে তাজ্জব বনে গেলো সে। নীড় নামক একটি মেয়ে তাদের টিমে যোগদান করেছে যে কি না ফড়িং এর গার্ল ফ্রেন্ড ! রাস্তার এপার ওপারে বাড়ি তাদের অথচ দুটো গোলি পেরিয়ে ফড়িং এর কী রকম সাহস নীড় কে তুলে নিয়েছে ! ভাবতে ভাবতে পটার একটু দুঃখ হলেও সকলের সামনে হেসে হেসে বলল 'হাই নীড় আমি প্যাভেল চৌধুরী।' কথা বলার স্টাইলটা পুরো বদলে দিয়েছে পটা? রকের সবাই একে অন্যের দিকে চোখাচোখি করতে লাগলো। পটার নাম যে প্যাভেল সেটা এতকাল বেমালুম ভুলে গেছিল সকলে।


নীড় বেশ ডাকা বুকো মেয়ে। একটা কোকের বোতল এক হাতে ধরে অন্য হাতটা বের করে দিয়ে বলল ' হাই আমি নীড় , দোলার পিসতুতো দিদি।' ফড়িং যেন একটু অস্বস্তিতে পড়েছে বলে মনে হলো পটার। পটা জিজ্ঞাসা করলো 'কি করছো তুমি? '


---ফিজিক্স অনার্স ফার্স্ট ইয়ার্স।




ফড়িং বলল 'চল চল নীড় তোকে ছেড়ে আসি সন্ধে লেগে গেছে।'


পটা দেখলো নতুন টোটকা টা কাজে লেগেছে। ফড়িং এবার আবার উচ্চমাধ্যমিকের ব্যাক পেপারগুলো দিয়ে উঠেছে। কলেজের সীমানায় যেতে সময় লাগবে।


নীড় যেন একটু রেগেই গেলো ফড়িং এর কথায়। তাড়াতাড়ি বলতে গেলো দাঁড়া তো সবে তো সন্ধ্যা হয়েছে এখনই কি যাবো ! কিন্তু ভীষণ উত্তেজনায় সব কিছু কেমন যেন হিক্কা উঠে জড়িয়ে পেঁচিয়ে গেলো। যাই হোক সকলে জল খাইয়ে ধাতস্থ করাতে নীড় খানিক হেসে বাড়ি গেলো। এর পর থেকে নীড় পড়তে বসলেই জানালার পর্দাটা উঁচু করে পটাও একটা কমার্সের বই মুখে তুলে নিয়ে পড়ার টেবিলের সামনে বসে থাকে। যদিও নীড়ের জানালার পর্দা ফেলা থাকে তবুও বসন্তের দক্ষিণা বাতাস মাঝে মাঝে নীড়ের চুল সমতে উড়িয়ে নিয়ে আসে পটার বুকের বাম দিকে। ঠিক সে সময়টার জন্যই বোধহয় নীড়ও অপেক্ষা করে। একটু চোখাচোখি হতেই এক ঝলক বিদ্যুতের মতোন হাসি খেলে যায় দু দিকের জানালার দু পাশে।


নীড় বেশ স্বাস্থ্যবতী, লাবণ্যময়ী, হাসিখুশি একটা মেয়ে। নাকটা টিকালো হলেও চোখটা বিড়ালের মতো কটা। গায়ের রঙ উজ্জ্বল। ছোট্ট একটা টিপ পড়লে খুব মিষ্টি লাগে। সবচেয়ে ভালো লাগে পটার যেটা। তা হলো ও খুব প্রাণবন্ত একটা ছটফটে মেয়ে। মাঝে মাঝেই ফড়িং এর হিরো রেঞ্জার টা দোলাদের বাড়ির নীচে দেখতে পায় পটা। দোলার মা কাকিমা কেমন যেন। ওদের বাড়ির আশেপাশে পটাকে দেখতে পেলেই


দরজা বন্ধ, জানালার পর্দা সব ফেলে দেয় হুড়মুড়িয়ে। ইশস ! দোলাকে যে এতদিন পাত্তা দেয়নি পটা এমন কি বাইকে তুলতে পারেনি কেন? তার কারণ গুলোর মধ্যে বোধহয় ঐ দোলার মায়ের অসভ্য আচরণ একটা। তাছাড়া পটার ছোট মামা এবিষয়ে পটাকে আগে থেকেই সাবধান করে বলেছিলেন ঃ 'ভাগ্নে যেখানে বাস সেখানে চাষ করতে নেই ।'


পটা সে কথা মেনে চলেছে ঠিকই কিন্তু আজকাল আফসোস হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় দোলাকেই যদি তার বাইকে করে ঘুরতে যাওয়ার ছোট খাটো একটা অফার করে তবে তো নীড় কে বাইক এ তুলতে পারবে ৷ এক এক সময় মামার উপর হেব্বি রাগ হয়, কেন যে আগে বাড়িয়ে ঐ সব জ্ঞানটা দিয়ে গেল। সামনের সপ্তাহে দোলা কে বাইকে করে বেড়াতে যাবার অফার টা করে অপেক্ষা আর করবে না। সরাসরি বসিয়ে নিয়ে ঘুরে আসবে নদীর পাড়ে।


চাইলে রেস্টুরেন্টেও নিয়ে যেতে হবে। একদিন কষ্ট করলেই না, কেষ্ট মিলবে। তবে নীড় কতটা জলখাবে এ বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। ফড়িংটাকে তার আগে একটা কাজে ভেরিয়ে দিতে হবে। নইলে ও ব্যাটা নীড় কে ব্যাগড়া দেবে। মনে মনে পটা নীড় কে নিয়ে সিমলা টু সুইজারল্যান্ড ঘুরে এসেছে কতবার। নিজের মন কে প্রশ্ন করে সে, নীড় কি তাকে নিয়ে এতটাই চিন্তা করে? না কি সবটাই খেলা চলছে তার! যেমন ভাবা তেমন কাজ। দোলাকে বাইকে তুলতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না তার। দোলা কে বাইকে বসিয়ে একথা সেকথার পর নীড়ের সব পছন্দ অপছন্দ জানাই তো ছিল আসল উদ্দেশ্য যাতে সে পাশ করেছে ১০০%। এদিকে দোলার মা, পটার সাথে দোলা কে বাইক থেকে নামতে দেখে দুন্ধুমার কাণ্ড ঘটালো। পটা তা বলে হাল ছাড়বার পাত্র নয়। নীড়ের সাথে কথা হয় পটার। তবে সবটাই সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে। এত দিনে পটা এবং নীড় দুজনেই বুঝে গেছে দিল তো হ্যায়। তবে যতক্ষণ না সরাসরি কেউ কাউকে প্রপোজ করছে ততক্ষণ যেমন চলছে চলুক।






হঠাৎ দোলের দু দিন আগে ফড়িং এসে পটাকে জানালো তার বাইকটার দরকার। পটা অবশ্য কোনদিন বন্ধুদের ফিরিয়ে দেয়নি ফলে সে বলল তেলের টাকাটা এবার তুই দিস ফড়িং। একটু চিন্তা করলো ফড়িং তারপর বলল 'কেন বস তোমার কি কোন কেস স্যুটকেস হয়েছে?' পটা হাসতে হাসতে বলল "এখনও হয়নি তবে সব কিছু ঠিক ঠাক থাকলে হয়ে যাবে দু দিনের মধ্যে। কিন্তু তুই বললি না তো বাইকটা কেন দরকার?"


---একটু রং, বেলুন, আবীর কিনতে যাবো আমি আর নীড়। তাছাড়া চারপাশটা একটু ঘুরে দেখাতে চাই নীড়কে সাইকেলে সে আমেজটা আসেনা যেটা বাইকে বসলে হয়। বলল ফড়িং।


একটু হাসি দিল পটা আর বলল নিয়ে যা বাইক।




পটার বাবা এক্স সার্ভিস ম্যান। বাইরে বাইরে কাটিয়েছেন জীবনের বেশীর ভাগ সময়। এখনও আছেন লখনৌতে। মা স্কুল টিচার। টাকার অভাব নেই তার তবে সরল মানুষ তাই ঠোকে যায় বেশী।




দোলের দিন নীড় ওদের বাড়ির ছাদে উঠে বেলুন মারছে নীচের রাস্তার লোকজনকে। ফড়িংরা সবাই এসেছে পটাকে ডাকতে দোল খেলতে। দরজা খুলতেই দেখে সবার সাথে নীড় এসেছে পটার বাড়িতে। পটা যে কি করবে নীড়কে নিয়ে তা ভেবে পেলো না। অবশেষে গতবারের কেনা শালিনীর জন্য লাল আবীরটা নীড়ের সারা মুখ থেকে কপালে তুলে দিয়েই বলল ঃ 'হৃদয়ের ঘরটা ফাঁকা ভাড়াটে চাই। তুই নিবি নীড়?'


ফড়িং সমেত সকলেই পুরো হতবাক এমন কাণ্ডে। শুধু নীড়ের হিক্কা টা এখন ওদের পরপোকার করতে বাধ্য করছে। নীড়ও যে উত্তেজিত হলে হিক্কা তোলে সেটা পটা জেনে গেছে। আজ পটা সাহসী উত্তেজিত হয়েও তোতলায়নি এতটুকু শুধু নীড়ের মাথায় ফু দিয়ে চলেছে সাধ্যমতো।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance