হলদে রাঙা বউ (২)
হলদে রাঙা বউ (২)
পরেরদিন সকালে, ব্যানার্জী বাড়িতে তুলুম কান্ড! এত চেঁচামেচি হচ্ছে যে ঐশীর সাধের কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গেছে। ঘুম ভেঙেছে কিন্তু চোখ খুলছে না। তাছাড়া এই চেঁচামেচি তো রোজকার রূপকথা গল্পের মতো এই বাড়িতে। এই বাড়িতে যেদিন আওয়াজ হবে না , সেদিন ভাবতে হবে খুব ভালো কিছু হয়েছে। ঐশীর মাথায় কিছুই আসছে না, ওর মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছে, তাই আবার বিছানায় ধপাস ।
ঐশী- উহুম , স্বপ্নের মধ্যে কেউ এত চেঁচায়। বাড়ির দেওয়ালে ফাটল দেখা যাচ্ছে, মা তোমার বাঁশি বাজানো বন্ধ করতো । একদম চুপ থাকো , কী সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। আদি স্যার কাঁদার মধ্যে গড়াগড়ি খাচ্ছে । তুমি এখন যাও তো , যাও ভাগো ..!
এরপর ঐশী মিনিট দুই শান্তির ঘুম ঘুমিয়েছে। তারপরই বাঁশ ফাটা কান্নার আওয়াজ । ঐশী শোয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলো । হঠাৎ ঘুম ভেঙেছে তো তাই মাথায় কিছুই আসছে না, আবার যখন কান্নার আওয়াজ শুনলো ! দৌড়ে নীচে গেল ,
অর্ধেক গিয়ে সিঁড়িতেই বসে বুঝতে চেষ্টা করলো কী নিয়ে ঝগড়া লাগলো দুজনের মধ্যে ।
বাবা- মা ঐশী ঘুম ভেঙেছে তোর, আসলেই তো এত বাঁশের আওয়াজে কেউ কী শুয়ে থাকতে পারে ।
মা - এই বুড়ো তুমি বাঁশের আওয়াজ কাকে বললে । আমি কী বাঁশের মত কটকট শব্দ করি। ঝাটাটা কোথায় গেল ।
বাবা - আর কী পারো খালি ঝুড়ি ঝুড়ি খেতে পারো , আর ঝটা দিয়ে ঝাড়ু দিতে পারো। তবে ঝাড়ুদার হিসেবে দারুণ মানায় কিন্তু ।
মা - তুমি আমাকে খাওয়ার খোটা দিলে । আমি কী এই বাড়ির কাজের লোক , যে আমি ঝাড়ু দেবো । তোমার বাড়ি আজ তুমি ঝাড়ু দেবে । এই নেও ঝাড়ু , শুরু করো । ঝাড়ু না দিলে আজ পেটে তালা দিতে হবে কিন্তু ।
বাবা- ওই সব অখাদ্য খেয়েই তো আমার গ্যাসের সমস্যা হচ্ছে ।
মা - কীইইইইইইইইই। এই বুড়ো এই কী বললে । সারা জীবন হাত পুড়িয়ে রান্না করে খাওয়ালাম এই জন্যে । আমি আর থাকবোনা এই বাড়িতে, চলে যাবো বাবার বাড়ি।
বাবা- ঐশী সিঁড়ির থেকে নেমে আয় ,তোর মা ঘরে যাবে । কত গোছানো বাকি !
মা - গোছানো বাকি মানে।
ঐশী- এই তোমরা চুপ করবে , সকাল সকাল কী শুরু করলে বলতো ! মা চা কই আমার ..
মা - ওই বাপের চেলি তুই চুপ থাক । নিজের চা নিজে করে খা । এই তুমি গোছানোর কথা বললে কেন??
বাবা- মা ঐশী আমাকে এক কাপ দিস তো! সকালে চা তো নয় ,করলার রস খেলাম মনে হল।
ঐশীর মা রাগে বোম হয়ে , গজগজ করতে করতে এক কাপড়েই বেরিয়ে গেল। ঐশী আর ওর বাবা চুপিচুপি হাসতে লাগল । ওর মা চলে যাওয়ার পর বাবা বলল ,যা মা এক কাপ চা খাওয়া । তোর মা এলো বলে , এসেই প্যা প্যা করতে শুরু করবে। ঐশী ঢুকলো রান্না ঘরে , সে খুব সুন্দর রান্না করতে পারে । শুধু চা আর ম্যাগি। যাই হোক, মায়ের চোদ্দোগুষ্টি উদ্ধার করতে করতে চা করে নিয়ে এসে কেবল মাত্র চুমুক দিয়েছে। এই সময় ,..!
মা - আমি কেন যাব , আমি যাব না । বাবার বাড়ি থেকে কত কী নিয়ে এসেছি , সব ফেরত দেও তারপর যাবো ।
বাবা- এত লেট করলে কেন , তুমি জানো আমি কতক্ষন ধরে তোমার পথ চেয়ে বসে আছি। তোমার বিরহে আমি রোগা হয়ে গেলাম তো গিন্নি ।
মা - একদম ঢং করতে আসবে না , আমি চলে যাবো এই বাড়ি থেকে। আমার সব ফেরত দেও!
বাবা - সব তো গিন্নি তুমি খেয়ে ফেলেছো । উল্টে আমি পাই তোমার কাছে , তারপর সেদিন যে গয়না নিলে ! ওটার টাকাও তো পাই তোমার কাছে ।
মা - কী এত বড়ো অপমান ! তিনি টেবিলের খবরের কাগজটা তুলে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন । আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না মানে যাব না । তোমার মাথা খারাপ করে তবেই যাব !
বাবা- বলো যে এই বুড়ো কে মিস করবে তাই যাবে না , হু জানি জানি আমার টাক টাই তোমাকে আকৃষ্ট করে ।
মা - হঠাৎ লজ্জায় লাল হয়ে গেলেন , বললেন যাহ, কী যে বলোনা তুমি । বুড়ো বয়সে ভিমরতি।
ঐশী- মা তোমাদের ড্রামা শেষ হলে আমাকে খেতে দেও আমার অফিস আছে ।
মা - এই কাল তোর প্রথম অফিস কেমন কাটলো !
ঐশী- কেমন আবার , বাড়িতে যেমন কাটে ! কাজ করে ।
বাবা - হুম , কিন্তু মা আমরা তো তোকে কাজ করতে দেখি তাও স্বপ্নে , এত পরিপাটি কজ কেউ করতে পারবেনা ।
ঐশী- বাবা , তুমি আমাকে কী বলতে চাইছো ! আমি কিছু পারি না ।
বাবা- তেমন কিছু না , শুধু তোমার কাজ দেখে আমি ভয় পাই যে মা ।
ঐশী - ভ্রু কুঁচকে জিঞ্জেস করল! ভয় পাও কেন ?
বাবা- একটু আগেই তুই যে চা করে এনেছিস , সেটা খুব সুন্দর হত যদি তুই নুন না দিয়ে চিনি দিতি।
ঐশী ভাবছে এই রে , মাকে বকতে গিয়ে চিনির বদলে নুন দিয়ে ফেলেছি । আমার দ্বারা আর রান্না হবে না ,
ঐশী- সব দোষ মায়ের , মা কে বকতে গিয়েই তো সব উল্টে গেল । আমাকে দিয়ে না তোমরা কাজ করিও না , মনে নেই আগের বার মাংস সেদ্ধ করতে গিয়ে পেশার কুকার কেমন সুন্দর করে ফাটিয়ে ফেলেছিলাম । তার পর আর আমি কোন কাজেই হাত দেই না , দেখেছো আমি কত ভালো মেয়ে।
মা - হয়েছে হয়েছে , আর দাত বার করতে হবে না। টেবিলে বস খাবার দিচ্ছি!
ঐশী খেয়ে রেডি হয়ে স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো অফিসের উদ্দেশ্যে।
ঐশী রাস্তা দিয়ে স্কুটি চালাচ্ছে আপন মনে। ওর কোন দিকে খেয়াল নেই! সেদিন যে অফিসে কী করেছে তাও মনে নেই। আজ ঐশী আকাশি রঙের একটা শাড়ি পড়েছে, সদ্য স্নান করেছে তাই ওকে খুবই স্নিগ্ধ লাগছে। ঠোঁটে হালকা লাল রঙের দরুন , ফর্সা মুখখানি আরো সুন্দর লাগছে। আজ ওর মন খুব ভালো । গুনগুন করতে করতে ও অফিসের কাছে চলে এল।
হঠাৎ করেই ঐশীর ভয় করছে। কালকের
কথা মনে করে , আজও ২০মিনিট লেট। কী হবে কে জানে! অফিসে ঢোকার পর থেকে ঐশী খেয়াল করছে সবাই কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে । নিজের কেবিনে বসার সাথে সাথেই পিয়ন এসে বলে গেল ! ম্যাডাম আপনাকে স্যার ডাকছেন।
ঐশী- আসতে না আসতেই ব্যাটার কী এমন দরকার পরলো , উহুম শান্তি মত একটু পাও দোলাতে দেবে না দেখছি। কোন কাজ না থাকলে ওর বাবরি চুল আমি ছিঁড়ে ফেলবো!মনে মনে আদির গুষ্টি উদ্ধার করে , বসের কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল।
ঐশী- মে আই কামিং স্যার ।
আদি- ইয়েস কামিং..
ঐশী - স্যার আমাকে কেন ডেকেছেন?
আদি - ওও মিস ঐশী , আমি তোমাকে আমার চেয়ারে বসার জন্য ডেকেছি , কারন তুমি তো অনেক কাজ করো , একদম লেট করো না । আর কাজ করে করে তোমার কোমর ব্যাথা করে । কত্ত ভালো তুমি তাইনা।
ঐশী- সত্যি স্যার ঠিক বলেছেন , আমি অনেক ভালো । কিন্তু স্যার , আমি আপনার চেয়ারে বসলে আপনি যদি কান্না করে দেন! তখন লোকে দেখলে আপনার উপর হাসবে ! তাই থাক স্যার আপনাকে আমি কাঁদাতে চাই না ।
আদি- স্টপপপপপ ইটস ননসেন্স । আজকেও লেট !
ঐশী আদির ধমকে চোখ মুখ খিঁচিয়ে বন্ধ করে বসে আছে। আর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে ! আদি অবাক চোখে ওর সামনে দাড়ানো এই রুপসীর দিকে তাকিয়ে আছে । এত্ত কিউট কেন মেয়েটা , ছোট ছোট টানা টানা চোখ দুটো বন্ধ করে আছে, গাল বেয়ে জল পড়ছে । খোলা জানালার হাওয়ায় চুল গুলো উড়ছে। আদি খেয়াল করলো ঐশী আজ শাড়ি পড়েছে, আকাশি রঙের শাড়ি তে লাল ঠোঁটটায় ফর্সা মুখখানি আরো মায়া মায়া লাগছে । কিন্তু , ওর চোখের জল আদির কেন যেন সহ্য হচ্ছে না । আদি যে কখন ধিরে ধিরে ঐশীর সামনে চলে এসেছে তা দুজনের কেউ বুঝতে পারেনি।
ঐশী কারো গরম নিঃশ্বাস অনুভব করে চোখ খুলে দু কদম পিছিয়ে গেল। আদি স্যার ওর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে । আর মুখে সেই মুচকি হাসি । ঐশী খানিকক্ষন ডাকলো কিন্তু, ওর বস ওরই মায়ায় জড়িয়ে বসে আছে । ঐশীর মাথায় একটা দারুন বুদ্ধি খেলে গেল । ওর পায়ের গোড়ালি দিয়ে আদির বাম পায়ে দিল এক পারা। আদি হঠাৎ এমন কিছু হওয়াতে বোঝার আগেই ধপাশ করে মেঝেতে শুয়ে পরলো । আর এদিকে ঐশী খিলখিল করে হাসছে, আদি রাগ করার বদলে আবার হাড়িয়ে গেল ঐশীর জালে। ঐশী তাকিয়ে দেখে ব্যাটা খাটাসটা লাথি খেয়ে ও ড্যাব ড্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে ।
ঐশী- স্যারএএএএ, ওও স্যার এএ।
আদি- এই মেয়ে এই আস্তে কথা বলতো পারো না ।
ঐশী- আমি তো কখন থেকেই ডাকছি , আপনি শুনতে পাচ্ছেন না ।
আদি ধিরে ধিরে ঐশীর সামনে চলে এল , ঐশী ভ্রু কুঁচকে জিঞ্জেস করল -
ঐশী- আপনি এগিয়ে আসছেন কেন?
আদি- কেন মিস ঐশী ব্যানার্জী ভয় পাচ্ছে নাকি!
ঐশী - আমি ভয় পাব কেন ? এই আপনার মতলব কী হ্যা । আমার কাছে কিন্তু পেপার স্প্রে আছে।
আদি- ওর কথা শুনে হা হা করে হাসতে লাগলো।
ঐশী মনে মনে বলছে , এই লোকটা এত সুন্দর করে হাসে কেন? ব্লু কোটে হোয়াইট সার্ট এ দারুন লাগছে তো। আমার হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে কেন, মনে হচ্ছে কেউ ডাকছে । এত সুন্দর সময় কোন ব্যাটা ডিস্টার্ব করে রে।
আদি- মিস ঐশী , এই যে মিস ঐশী
ঐশী- এই হনুমানের ডাকার আর সময় হয়না , আমার ভালো সময় গুলোতেই ওর ডাকতে হবে । যতসব । কী হয়েছে ষাঁড়ের মত চেঁচামেচি করছেন কেন ।
আদি - স্যাটাপ , যাও এই ফাইলটা রেডি করে নিয়ে আসো। আর কালকের সিডিউলটা যেন রেডি থাকে।
ঐশী- আমি সিডিউল রেডি করবো কেন?
আদি- বিকজ আপনি আমার পি. এ । মিস ঐশী
ঐশী - আমি তো পি. এ হিসেবে জয়েন করিনি। তবে পি.এ কীভাবে হলাম ।
আদি- আমি করেছি ।
ঐশী- কেন?
আদি - সে প্রশ্নের উত্তর আমি তোমাকে দেবো না। যাও ফাইলটা রেডি করে নিয়ে আসো!
ঐশী গাল ফুলিয়ে একটা মুখ ভেঙচি কেটে । আদির গুষ্টির পেছনে পরে গেল।
আদি- আমি সবসময় তোমাকে আমার সামনে , আমার সাথে রাখতে চাই । চোখের আড়ালে করতে রাজি নই। আমি মনে হয় তোমার মায়াতে জড়িয়ে যাচ্ছি । আগে আগে দেখো কী হয় আমার মিষ্টি পাখি।
নিজেকে কী ভাবে , একটা ভাঙাচোরা অফিস করেই নিজেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী ভাবছে ছাগলটা ।
আদি- ছাগলটা কে মিস ঐশী ।
ঐশী- এই ছাগল হল রাম ছাগল , আমার বববববব...। স্যার আপনি । আপনি বুড়ো বয়সে কষ্ট করে এতটা পথ এলেন কেন। আমি তো কাজ করছিলাম স্যার। এই বলে ঐশী টেবিলের উপর রাখা কী বোর্ডটা উঠিয়ে দেখালো।
আদি- এই মেয়ের সব নাটবল্টু ঢিলে মনে হয়। মিস ঐশী আপনি বুড়ো কাকে বলছেন। আর ওটাকে কী বোর্ড বলে ।
ঐশী হাতের দিকে তাকিয়ে নিজেই অবাক , ফাইল রেখে কী বোর্ড দেখাচ্ছে। আমার যে কী হয় এই লোকটার কথা শুনলে । সব এলোমেলো হয়ে যায় ।
আদি- কী হল বলুন হা করে আছেন কেন? আমাকে কী আপনার বুড়ো মনে হয়।
ঐশী- তা একটুউউউউ। না না স্যার আপনি তো কচি একদম মাসুম বাচ্চা । ইয়ে মানে স্যার আপনি এখানে কেন এসেছেন ।
আদি ভ্রু কুঁচকে ভাবলো , এই মেয়ের সাথে বেশি কথা বললে আমারও ফিউজ উড়ে যাবে।
আদি- মিস ঐশী , আমাদের এখনি বেরোতে হবে ,একটু পরে । খান গ্ৰুপের সাথে আমার একটা মিটিং আছে । ল্যেটস গো
ঐশী- আমি কেন যাব , আপনি যান ওসব মিটিং ফিটিং এর মধ্যে আমি নেই । আমি এখন কাজ করবো আমার অনেক কাজ , আমি আপনার মত ফাঁকি বাজ নই ।
আদি জানে এই মেয়েকে সহজে নেওয়া যাবে না , তাই এক ছাটকায় কোলে তুলে নিয়ে হাটা ধরলো । আর অফিসের সব স্টাফ গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে রইল।
#মন_সায়রের_পারে